বিজ্ঞাপন

সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দুর্গাপুজো ৪১১ বছরে পড়ল, ফিরে দেখা সেই ইতিহাস

সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দুর্গাপুজো এ বার ৪১১ বছরে পড়ল। লক্ষ্মীকান্ত দেব ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বড়িশা গ্রামে পরিবারের প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা করেন।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দুর্গাপুজো এ বার ৪১১ বছরে পড়ল। লক্ষ্মীকান্ত দেব ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বড়িশা গ্রামে পরিবারের প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। আটচালার পুজো হিসেবে তা পরিচিত। সেই ইতিহাসই ঘুরে দেখলেন অমৃত হালদার


১৬০৮ খৃস্টাব্দ। তখন দিল্লির মসনদে মুঘলদের অধিষ্ঠান। গোটা দেশের শাসনভার রয়েছে সম্রাট জাহাঙ্গিরের হাতে। সেই সময় পণ্ডিত বেদগর্ভের অধস্তন দ্বাবিংশতম পুরুষ লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আদেশে রাজা মানসিংহের তরফে দক্ষিণবঙ্গের জায়গিরদারি লাভ করেন। সেই সঙ্গে ‘রায়’, ‘মজুমদার’ ও ‘চৌধুরী’ উপাধির প্রাপ্তি লাভ করেন। লক্ষ্মীকান্ত দেবই ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বড়িশা গ্রামে পরিবারের প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। আটচালার পুজো হিসেবে তা পরিচিত। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দুর্গাপুজো এ বার ৪১১ বছরে পড়ল।

পরবর্তী কালে তাঁর পুত্র গৌরী রায় হালিশহর থেকে নিমতে-বিরিটি (বর্তমানে বিরাটি) অঞ্চলে এসে প্রাসাদ নির্মাণ করেন। যেটি এখন রয়েছে ঠিক বিরাটির কলেজ মোড়ের কাছে। যে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হবে যেন একরাশ ইতিহাসের পাহাড়। তখনকার সুদৃশ্য প্রাসাদ এখন ভগ্নপ্রায়! কোথাও কোথাও নতুন রং-সিমেন্টের প্রলেপ পড়েছে। তবে বাড়িটা এখনও একটা আস্ত ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে। এই বাড়িতেই পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন গৌরী রায়। আর তিনিই একটি কাছারিবাড়ি নির্মাণ করেন দমদমা ঢিপিতে। যেটি এখন দমদমের ক্লাইভ হাউস। পরবর্তী কালে তাঁর বংশের উত্তর পুরুষেরা ডিহি কলকাতা এবং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। তবে তৎকালীন নিমতে-বিরিটী দুর্গাপুজোর সূচনা তাঁর হাত ধরে।

সেই তখন থেকে এখনও পর্যন্ত বিরাটির রায়চৌধুরী পরিবারে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্য শঙ্কর ভট্টাচার্য রায়চৌধুরী জানালেন, আটচালাবাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার বহু বছর পর বিরাটির বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হয়। কিন্তু সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী দুর্গাপুজোর শুরুটা ওই আটচালাবাড়ি দিয়েই হিসেব হয়ে আসছে। সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের আদিপুজো ‘আটচালাবাড়িতে’ শুরু হলেও পরবর্তী কালে সাবর্ণ পরিবারের পুজো বড়িশার ‘বড়বাড়ি’, ‘মেজবাড়ি’, ‘মাঝেরবাড়ি’, ‘বেনাকিবাড়ি’ এবং ‘কালীকিঙ্করভবন’-এ হয়ে আসছে। এ ছাড়াও পুজো হয় নিমতা ও বিরাটির বাড়িতে। বিরাটি অঞ্চলের জমিদারি ছিল এই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের হাতে। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার আগে এই এলাকার শেষ জমিদার ছিলেন শৈলেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী।

বিরাটির বাড়ির দুর্গাপুজোতে আজও দেবী শরতের সোনা রং গায়ে মেখে আসেন। দেবীর গায়ের রং হয় কাঁচা হলুদের মতো। একচালা ঠাকুর। দেবীর ডান পাশে লক্ষ্মী-গণেশ, বাঁ পাশে সরস্বতী ও কার্তিক। পদতলে সিংহ এবং সবুজ বর্ণের অসুর।  বিরাটির বাড়ির পুজোর কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। লক্ষীকান্তের নাতি বিদ্যাধর রায়চৌধুরীর সময় এই পরিবারের পুজোতে ত্রিধারা সঙ্গম হয়। অর্থাৎ শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব— এই তিন মত মিলে যায় পুজোতে। বড়বাড়ির মতোই বিরাটির বাড়িতে নবমীতে হয় কুমারীপুজো। এ ছাড়া এই বাড়িতে হয় ধুনো পোড়ানো। বাড়ির বৌয়েরা মায়ের সামনে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে বসেন। মাথায় ও হাতে থাকে মালসা। যাতে থাকে জ্বলন্ত ধুনো। যা দিয়ে মায়ের আরতি করেন তাঁরা। অপূর্ব ভক্তিতে ভরে যায় চার দিক।

আরও একটি ভিন্ন নিয়ম রয়েছে। অষ্টমী ও নবমীর দিন বিশেষ পুজো ‘মাস ভক্ত বলি’ হয়। ১০৮টা খুড়িতে মাসকলাই এবং দই দিয়ে এই পুজো করা হয় অপদেবতা আর উপদেবতাকে সন্তুষ্ট করতে। যাতে তারা পুজোয় বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দুর্গাপুজো-তে আগে ছাগল বলি হত। এখন আর হয় না। এখন শুধুই চালকুমড়ো,কলা,শসা— এই সব বলি হয়।

নিমতার বাড়ি বাদে বাদ বাকি সব বাড়ির মতোই বিরাটির বাড়িতেও আমিষ ভোগ হয়। একটা সময় সে ভোগের বাহারে চোখ কপালে উঠত। এখন আর সেই রমরমা নেই। তাই প্রাচুর্যও পড়েছে। যার প্রভাব এসে পড়েছে পুজোর গায়ে। কিন্তু এখনও নিয়ম মেনে যা আয়োজন হয়— তাও অন্যান্য পুজোকে হার মানাবে। দেবীর ভোগে থাকে রুই, ভেটকি, পার্শে, বাটা, ইলিশ— এমন ৫ রকমের মাছ। নবমীর রাতে তৈরি হয় খেসারির ডাল, চালতার অম্বল, কচুরশাক আর রুইমাছ।

দশমীর সকালে দেবীকে উৎসর্গ করা হয় এগুলিই। রাতে হয় লুচি। সঙ্গে বেগুনভাজা, পটলভাজা আর ছানার ডালনা। সারা বছর ভিন্ন স্থানে থাকলেও এই চারটে দিন বিরাটির রায়চৌধুরী বাড়ির উঠোনে ম্যারাপের তলায় সবার একসঙ্গে পাত পড়ে। এই পরিবারের বিজয়াটাও হয় এক্কেবারে অন্য ভাবে। দশমীর দিন সকালে ঘট বিসর্জনের পর প্রতিমার সামনেই শুরু হয় বিজয়া পর্ব।

তবে এই করোনা পরিস্থিতি এ বার থাবা বসিয়েছে সমস্ত পুজোতে। বাদ পড়েনি বিরাটির সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারও। এই পরিবারের তরফে শৌভিক রায়চৌধুরী ও পিঙ্কি দত্ত জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সতকর্তামূলক কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে পরিবারের তরফে। দেবীমূর্তির মাপ অনেকটাই ছোট হচ্ছে এ বার। ঠাকুর দালানে তিন-চার জনের বেশি মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। বাইরের মানুষকে ঢুকতে দেওয়ার আগে বিবেচনা করা হবে। অঞ্জলি হবে ঠাকুর দালানের নীচে দাঁড়িয়ে। চার দিন পরিবারের সদস্যদের খাওয়ার একটা আয়োজন হত। এ বার সেটা হচ্ছে না। তবে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দুর্গাপুজো এ বার পরিবারের ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে নিয়মমাফিক।

ছবি: পিঙ্কি দত্ত ও অমৃত হালদার।

(আরও ফিচার পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)

0
0

This post was last modified on October 18, 2020 1:50 am

বিজ্ঞাপন
admin:
বিজ্ঞাপন
Related Post

This website uses cookies.

বিজ্ঞাপন