স্যামুয়েল হ্যানিম্যান চিকিৎসা জগৎকে নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। হোমিওপ্যাথির আবিষ্কারক। কিন্তু তাঁর জীবনটা ঠিক কতটা কঠিন ছিল? জানুন হ্যানিম্যানের জীবনকাহিনি ডাঃ ধ্রুবজ্যোতি লাহিড়ির কলমে, আজ চতুর্থ ও শেষ পর্ব…
ইতিমধ্যে লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অধ্যাপক হ্যানিম্যানকে সেখানে তাঁর নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে বলার বা পড়ানোর জন্য আবেদন জানান, কিন্তু অধ্যাপকদের একাংশ এই কাজে বাধা সৃষ্টি করেন। শেষ পর্যন্ত বক্তব্য রাখার অনুমতি দেওয়া হল। কিন্তু দুঃখের বিষয় ছাত্রদের মধ্যে অধিকাংশই তার মতবাদকে গ্রহণ করতে চাইলেন না। কারণ তাঁদের মধ্যে প্রচলিতকে ছেড়ে নতুন কিছু গ্রহণ করার মতন মানসিকতা ছিল না। সামান্য কয়েকজন ছাত্র হিসেবে স্যামুয়েল হ্যানিম্যান যাঁদের পেলেন তাঁরা উত্তরকালে তার চিকিৎসা ব্যবস্থার ধারক-বাহক হয়ে উঠেছিলেন।
এই সময় ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেশে ফিরেছিল তাঁদের মধ্যে বহু সংখ্যক সৈন্য টাইফাস নামক একটি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রচলিত কোন চিকিৎসাতেই তাদের রোগের প্রকোপ কমছিল না শেষে হ্যানিম্যানকে চিকিৎসার জন্য ডাকা হয়। তিনি অল্প দিনের মধ্যেই হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করে সুস্থ করে তোলেন অনেককেই। এতে তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
অস্ট্রিয়ার যুবরাজ সোয়াজেনবার্গ অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় কোন উপকার না পেয়ে শেষে হ্যানিম্যানের কথা শুনে তাঁকে চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগ করেন। হ্যানিম্যানের চিকিৎসায় অল্প দিনের মধ্যেই তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন, কিন্তু সামান্য সুস্থ হতেই হ্যানিম্যানের নির্দেশ অমান্য করে আবার মদ্যপান করতে আরম্ভ করলেন। হ্যানিমান ক্ষুব্ধ হয়ে তার চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন এবং যুবরাজের চিকিৎসার জন্য আর তার প্রাসাদে গেলেন না। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই যুবরাজ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। এই ঘটনায় অস্ট্রিয়ানদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হল। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকরা এই সুযোগে হ্যানিম্যানের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার পাশাপাশি যুবরাজের মৃত্যুর জন্য সরাসরি হ্যানিমানকে দায়ী করলো।
হ্যানিমানের উপর আবার নিষেধাজ্ঞা জারী করল জার্মান সরকার। স্যামুয়েল হ্যানিম্যান বুঝতে পারলেন তাঁর পক্ষে আর লিপজিগে থাকা সম্ভব হবে না। তার জীবন সংশয়ও হতে পারে। নিরুপায় হ্যানিম্যান ১৮২১ সালের জুন মাসে লিপজিক পরিত্যাগ করে জার্মানির কোথেন শহরে এসে বাড়ি ভাড়া নিলেন।
হোমিওপ্যাথির এই দুর্দিনে হ্যানিম্যানের পাশে এসে দাঁড়ালেন কোথেন শহরের মেয়র ডিউক ফার্দিনান্দ। তিনি কোথেন শহরে হ্যানিমানকে শুধু বাস করার অনুমতি নয়, তারওষুধ তৈরী করার এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করার অনুমতিও দিলেন। তাঁকে রাজসভার চিকিৎসক হিসাবেও মনোনীত করলেন ।
১৮২২ সালে হ্যানিম্যান প্রকাশ করলেন প্রথম হোমিওপ্যাথি পত্রিকা। এর কয়েক বছর পর প্রকাশ করলেন তার শ্রেষ্ঠ রচনা- ক্রনিক ডিজিজ, দেয়ার নেচার অ্যান্ড হোমিওপ্যাথিক ট্রিটমেন্ট। স্যামুয়েল হ্যানিম্যান বললেন, সোরা সিফিলিস, এবং সাইকোসিস হল মানবদেহের যাবতীয় রোগের কারণ, এবং এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকারক হলো সোরা। তাঁর এই অভিমতের বিরুদ্ধে আবার তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হল । তাঁর কিছু প্রিয় ছাত্র ও অনুগামীরা তার এই সব থিওরি বা মতের বিরুদ্ধাচারণ করে তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বহু চিকিৎসক অনুভব করতে পারলেন হ্যানিমানের কথার ও রচনার গুরুত্ব ।
১৮৩০ সালে হ্যানিম্যানের স্ত্রী হেনরিয়েটা ৬৭ বছর বয়সে মারা গেলেন। হ্যানিমানের জীবনের অন্ধকারময় দিনগুলিতে হেনরিয়েটা ছিলেন তাঁর চলার সঙ্গি, আর হ্যানিমানের জীবনে যখন অন্ধকার দূর হয়ে আলোর দেখা মিলল, হেনরিয়েটা তখন হারিয়ে গেলেন চির অন্ধকারের জগতে ।
অবশেষে হ্যানিম্যানের জীবনে এল নতুন বসন্ত। তখন তার বয়স ৮০ বছর। ১৮৩৪ সালের ৮ অক্টোবর এক সুন্দরী ফ্রেন্স যুবতী, নাম মাদাম মেলানি দূরারোগ্য চর্ম রোগের চিকিৎসার জন্য হ্যানিম্যানের কাছে এলেন। তিনি ছিলেন ফ্রান্সের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও তৎকালীন আইনমন্ত্রীর পালিতা কন্যা। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৫। মিলানি ছিলেন কবি, এবং শিল্পী । বয়সের বিরাট ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও দু’জনে দু’জনের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভায় মুগ্ধ হলেন, এবং ১৮৩৫ সালের ১ জানুয়ারি দু’জনের বিয়ে হয়ে গেল। মিলানি হ্যানিমানকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিতে নিয়ে গেলেন। সেখানে সরকারীভাবে তাকে ডাক্তারি করার অনুমতি দেওয়া হল।
জীবনের এই অন্তিম পর্বে এসে হ্যানিমান পেলেন– জীবনব্যাপী সংগ্রামের পুরস্কার —- খ্যাতি, সম্মান, অর্থ, আরাম, সুনাম, যশ, এবং সাংসারিক সুখ। ক্রমশঃ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল চারিদিকে। হ্যানিম্যানের জীবদ্দশায় চারটি হোমিওপ্যাথি কলেজ গড়ে উঠেছিল। তার কয়েকজন ছাত্র প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক হিসেবে সুনাম অর্জন করলেন।
১৮৪৩-এর ২ জুলাই শেষ রাতে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন হোমিওপ্যাথির জনক, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, শ্রেষ্ঠ এক বিজ্ঞানী।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি শে, বাক্য উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন, ” আমার জীবন বৃথা যায়নি।’’
(বিখ্যাত মানুষদের জীবন সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন)
(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)
This post was last modified on June 26, 2020 1:03 pm