বিজ্ঞাপন

Ross Island: অভিশপ্ত সেই দ্বীপে কয়েক ঘণ্টা

সাগরের জল কোথাও উজ্জ্বল, কোথাও বা ধূসর। ছোট্ট নৌকা করে সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম পোর্ট ব্লেয়ার থেকে রস আইল্যান্ডে (Ross Island)।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

তানিয়া রায় ভট্টাচার্য: সাগরের জল কোথাও উজ্জ্বল, কোথাও বা ধূসর, মেঘলা আকাশের রঙে রঙ মিলিয়ে। ছোট্ট নৌকা করে সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ছোট্ট দ্বীপ রস আইল্যান্ডে (Ross Island)। আজকে আর চারপাশে আমুদে উড়ুক্কু মাছের ঝাঁকগুলো আমাদের মনোরঞ্জন করছে না। হয়ত ইলশেগুরি আবার কখনও বা ঝমঝমে বৃষ্টি র জন্য ওদের খেলাধুলো আজ বন্ধ। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই অবশেষে পৌঁছে গেলাম রস আইল্যান্ড যার পোশাকি নাম এখন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস আইল্যান্ড। ছোট্ট জেটি, সমুদ্রের নোনা জলে ক্ষয়ে গিয়েছে পিলারগুলো আর কাঠের সাজ সজ্জা, ফোকলা দাঁতের বুড়ো ভিখারির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। মানুষের বসবাসের অযোগ্য এই ছোট্ট দ্বীপে ব্লেয়ার সাহেব প্রায় ২৫০ বছর আগে একটি সেনেটরিয়াম আর হসপিটাল তৈরি করেন যা কালক্রমে পরিত্যক্ত হয়েই পড়ে রয়েছে।। এরপর ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশরাজ এখানে অফিসার্স তৈরির উদ্যোগ নেয়।

দ্বীপের মাটিতে পা রাখতেই অভ্যর্থনা জানালো চিতল হরিণের দল। পোর্টব্লেয়ারের সেলুলার জেলের প্রাচীরের অন্তরালে যখন চলছে ব্রিটিশদের অকথ্য অত্যাচার, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হাহাকার আর ক্রন্দনে ভরে উঠছে আকাশ বাতাস, তখন উল্টোদিকের রস আইল্যান্ডে ব্রিটিশ অফিসাররা মগ্ন নানাবিধ বিলাসিতায়। দ্বীপে নিয়ে এসেছে চিতল হরিণ, ময়ূর ময়ূরীর দল, যাতে শিকার ক্রীড়ায় মগ্ন হয়ে উপভোগ করতে পারে তাদের অবসর যাপন। এইসব হরিণগুলো তাদেরই বংশধর।

ব্যাটারি চালিত গাড়িতে ঘুরে দেখা যায় পুরো দ্বীপ। গাড়ি যত এগোচ্ছে, চোখে পড়ছে ব্রিটিশ স্থাপত্যের নানাবিধ ভগ্নাবশেষ । ভগ্নাবশেষ বললে ভুল হবে, সামুদ্রিক শ্যাওলা আর গাছের শিকড়বাকর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে ভগ্নপ্রায় পরিত্যক্ত ব্রিটিশ বেকারী, পাওয়ার হাউস, অফিসারদের নাচ ঘর, বিলাসবহুল বাংলো। মেঘলা দিনে ঝুপঝুপ বৃষ্টির মধ্যে সে এক ভৌতিক পরিবেশ। ছবি দেখেছিলাম জলের তলায় কয়েকশো বছর পড়ে থাকা পরিত্যক্ত টাইটানিক জাহাজের, সেই দৃশ্যটাই মনে পড়ছে। যদিও এটা জলের তলায় নয়। বঙ্গোপসাগরের অভিশপ্ত এক দ্বীপে রাজকীয় স্থাপত্য আর ব্যসনের পরিত্যক্ত ভগ্নদশা।

দ্বীপের এই বিলাসবহুল স্থাপত্য, রাস্তাঘাট, বনবিতান..সবই কিন্তু তৈরি করানো হতো বন্দী ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দিয়েই। মানুষের বসবাসের অযোগ্য এই দ্বীপ তখন ছিল বিষাক্ত সামুদ্রিক সাপ, মশা আর কীট পতঙ্গের আস্তানা। নানাবিধ রোগ ভোগ, যেমন ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল খুবই বেশি।  জারোয়া অধিবাসীরা শিকার করতে বা নারকেল সংগ্রহ করতে আসতো এখানে। সাপের কামড়, ম্যালেরিয়ার প্রকোপে এবং জারোয়াদের তীরে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছিল বহু শ্রমিক স্বাধীনতা সংগ্রামীর। তাঁদেরই দীর্ঘশ্বাস আর যন্ত্রণার উপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়েছে ব্রিটিশদের এই বিলাসবহুল দ্বীপ যা একসময় পরিচিত ছিল প্রাচ্যের ‘দ্বিতীয় প্যারিস’ নামে।

এই নৃশংস অত্যাচার আর বৈষম্যের জন্যই কি আজ এই দ্বীপ এত অভিশপ্ত? ১৯০০ সালের গোড়া থেকে এখানে ব্রিটিশ অফিসাররা থাকতে শুরু করে। ১৯৪১ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর আস্তে আস্তে এই দ্বীপ পরিত্যক্ত হতে শুরু করে। মাত্র  একশো-দেড়শো বছরের ইতিহাস। দেখলে মনে হয় হাজার বছর সমুদ্রের তলায় চাপা পড়ে ছিল অভিশপ্ত এই পাতালপুরী। ১৯৪১ সালের পর কিছুদিন জাপানি সৈন্যদের অধিকারে ছিল এই দ্বীপ। স্বাধীনতার পরে ভারত সরকার হস্তগত করে এই দ্বীপ। এখন এটা ভ্রমণ কেন্দ্র। দ্বীপের এক কোণে রয়েছে ভারতীয় নেভির বেস।

সবুজ পান্নার মত গলফ কোর্স আজ শ্যাওলা পরিপূর্ণ ধ্বংসস্তূপ। আরে, গাছের আড়ালে ওরা কারা? চোখের ভুলে এক লহমায় মনে হল হাত ধরাধরি করে এক ভিক্টোরিয়ান শ্বেতাঙ্গিনী  ঘুরে বেড়াচ্ছে তার বাগদত্তা তরুণ অফিসারটির সঙ্গে। দূর থেকে ভেসে আসে চার্চের ঘন্টা ধ্বনি। নাহ,সবই বোধ হয় মনের ভুল। পুরো দ্বীপটা ব্যাটারি গাড়িতে করে ঘুরে দেখতে ঘন্টা দু’য়েকের বেশি সময় লাগে না । দ্বীপের প্রান্তে অপূর্ব সুন্দর লাইট হাউসটি দেখে ব্যাটারি গাড়িতে উঠতে উঠতেই নামলো আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। শনশন শব্দে ভৌতিক দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়তে লাগলো পুরো দ্বীপে। সমুদ্র এখন বেশ উত্তাল। নৌকা করে পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছতে যদিও আধ ঘন্টার বেশি সময় লাগবে না l দূরে দেখা যাচ্ছে সেলুলার জেলের প্রাচীর। মনে হল যেন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দৈনন্দিন দীর্ঘশ্বাসের মাঝখান থেকে ভেসে এলো উদাত্ত কণ্ঠে সম্মিলিত জয়ধ্বনি ‘জয় হিন্দ’।

১৯৩৯ সালে রাজনৈতিক চাপে এবং ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিদ্রোহের ফলে কালাপানি পার করে রাজবন্দীদের দ্বীপান্তরে কারাবরণ বন্ধ করতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ শাসকরা। ধিরে ধিরে জনশূন্য হয়ে পড়ে রস আইল্যান্ড। ১৯৪১-এর ভয়াবহ ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে বহু বাড়িঘর। ২০০৪ সালের ভয়ঙ্কর সুনামি তছনছ করে দেয় পুরো দ্বীপকে। তার পর থেকেই রস আইল্যান্ড পুরোপুরি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। আর আজ সামুদ্রিক শ্যাওলা, বট অশ্বত্থ গাছের পেঁচিয়ে ধরা শিকড়ে বন্দী অতীত একলা দাঁড়িয়ে রয়েছে অভিশপ্ত পাতাল পুরীর মতো। যেখানে গতীতে বয়ে চলেছে সামুদ্রিক নোনা বাতাস। কান পাতলে আজও বাতাসের সঙ্গে মিশে যায় কান্নার ইতিহাস।

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle

+1
0

This post was last modified on August 11, 2022 4:57 pm

বিজ্ঞাপন
admin:
বিজ্ঞাপন
Related Post

This website uses cookies.

বিজ্ঞাপন