বিজ্ঞাপন

রহস্যময় পুতুলবাড়ি নিয়ে রয়েছে অনেক ভৌতিক গল্প, সত্যি আসলে কোনটা

রহস্যময় পুতুলবাড়ি (Putul Bari) ঘিরে রয়েছে নানা কাহিনী। কিন্তু আসল সত্যের খবর এখনও কেউ দিতে পারেননি। যে কারণে তৈরি হয়েছে নানা ভৌতিক গল্প। কিন্তু কী পুতুল বাড়ির নেপথ্যের আসল গল্প।
বিজ্ঞাপন

পুতুল বাড়ির সামনের অংশ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

রহস্যময় পুতুলবাড়ি ঘিরে রয়েছে নানা কাহিনি। কিন্তু আসল সত্যের খবর এখনও কেউ দিতে পারেননি। যে কারণে তৈরি হয়েছে নানা ভৌতিক গল্প। কিন্তু পুতুল বাড়ির নেপথ্যের আসল গল্প কী? কেনই বা তৈরি হয়েছে নানা জল্পনা? সেটাই খতিয়ে দেখতে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন আমাদের লেখক। পুতুলবাড়ির অন্দরের গন্ধ তাঁর কলমে তুলে আনলেন জিকো রায়


পুতুলবাড়ির বিষয়ে আমরা তেমন কিছু জানি না। যেটুকু জেনেছি হয় নেট ঘেঁটে অথবা লোকমুখে। কিন্তু, আজ আমি আপনাদের পুতুলবাড়ির আসল এবং সত্যি ঘটনার কথা জানাব।

প্রায় ২০০ বছরের পুরনো বাড়িটি সাড়ে ৯ কাঠা জমির উপর দাঁড়িয়ে। মূলত তিনতলা, কিন্তু, এখনকার তিনতলা বাড়ির সঙ্গে তুলনা করলে বাড়িটি প্রায় ছ’তলার সমান। রোমান স্থাপত্যশিল্পের আদলে তৈরি বাড়ি। বাইরের তুলনায় ভেতরের অংশে কারুকার্যের বহর অনেকটাই বেশি। ভেতরের দেওয়ালে হিন্দু দেবদেবীর নানান ছবি, মূর্তি খোদাই করা!

বাড়ির ভিতরের রোমান স্থাপত্য ও তার কারুকার্য

পুতুলবাড়ির সম্মুখভাগে একাধিক দরজা থাকলেও বাড়িতে ঢোকার দরজা একটাই। বাকিগুলো নকল। কোনও কালেই এগুলো দরজা ছিল না। মূল প্রবেশদ্বার ছাড়া বাড়িতে ঢোকার আর একটি গোপন পথ আছে, পেছনের অংশ অর্থাৎ রেললাইনের দিক থেকে।

বর্তমানে বাড়ির মালিক ‘নট্ট পরিবার’। এর আগে এই বাড়ি সাহা পরিবারের হাতে ছিল। ১৮৬৯ সালে স্বর্গীয় বৈকুণ্ঠনাথ নট্টের হাত ধরে প্রথম এক যাত্রাদলের অভিযান শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের বরিশালে। সেই যাত্রা দলের নাম ছিল ‘মার্চরং বৈকুণ্ঠ সঙ্গীত সমাজ’। ধীরে ধীরে তাদের অভিনয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা, যশোহর, খুলনা-সহ কলকাতাতেও। বাংলা ভাগের অনেক আগে এই নট্ট পরিবারের একটি শাখা কলকাতায় চলে আসে এবং তাদের মতো করে যাত্রাদলকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই যাত্রা দলের বর্তমান নাম হচ্ছে ‘নট্ট যাত্রা কোম্পানি’। এই যাত্রাদলের নানান সাজসরঞ্জাম রাখা ও রিহার্সালের জন্য এই বাড়ির উপরের কয়েকটি ঘর ভাড়া নেওয়া হয়।

পুতুলবাড়ির অন্দরমহল

তার পর ১৯৭৮-এ ওই বাড়ির তৎকালীন মালিক সাহা পরিবারের প্রায় ৭৮ জন সদস্যের লিখিত সম্মতিতে মালিকানা পেয়েছিলেন বিখ্যাত যাত্রাশিল্পী স্বর্গীয় মাখনলাল নট্ট। তিনি ২০১৫ সালে প্রয়াত হন।

বর্তমানে এই বাড়ির একতলায় একটি সুতোর কল আছে। এ ছাড়া বেশ কিছু ঘর বিভিন্ন কোম্পানির গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাড়ির দোতলাটা সেই মাখনলাল নট্টের আমল থেকেই কিন্তু ভাড়াটেদের অধীনে। বাড়ির তিনতলায় নট্ট পরিবারের বেশ কিছু সদস্যের বাস এবং যাত্রাদলের জন্য বরাদ্দ দু’টি ঘর কিন্তু আজও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

(একটু অন্য ধরনের অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)

সমস্যার সূত্রপাত হয় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে। শোনা যায়, এই পরিবারের কোনও এক ব্যক্তি তাঁর শিশুকন্যাকে খুবই ভালবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। সেই মেয়েটিও পুতুল নিয়ে খেলতে খুবই ভালবাসত। ভালবাসার নিদর্শনস্বরূপ সেই বাবা এই বাড়ির বিভিন্ন স্থানে পুতুলের মূর্তি তৈরি করেন। কিন্তু সেই শিশুটির হঠাৎ মৃত্যুর পরেই শুরু হয় আতঙ্কের বাতাবরণ। শোনা যায়, মেয়েটির মৃত্যুর পরেই নাকি তার অশরীরী আত্মা বাড়ির অন্দরমহলে বিচরণ করতে শুরু করে। বাতাসে কান পাতলেই নাকি তাঁর খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যেত। এ ছাড়াও রাতের অন্ধকারে পুতুলগুলোর জীবন্ত হয়ে ওঠার কাহিনিও শোনা গিয়েছে।

পুতুলবাড়ির পেছনের অংশ

বাড়ির পেছনের দিক থেকে দেখলে পুতুল বা ওই জাতীয় কিছু মূর্তি এখনও দেখা যায়। মাঝখানে এক জন রাজা বা জমিদার, তার দু’পাশে দু’জন নারী এবং তার দু’পাশে নাকি সৈন্য বা পাহারাদারদের অবস্থান। এ ছাড়াও কথিত আছে যে, কলকাতার বাবু বা জমিদার আমলে বহু মহিলাদের এ বাড়িতে এনে তাদের উপর শারীরিক অত্যাচার চালানো হত এবং প্রয়োজনে তাঁদের মেরে ফেলা হত। তার পর থেকেই নাকি সেই নারীর অতৃপ্ত আত্মা আজও ঘুরে বেড়ায় ন্যায়বিচার পাওয়ার উদ্দেশে।

এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। কানাঘুষো শোনা যায় যে, ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে সরকারবিরোধী কার্যকলাপের জন্য বহু মানুষকে এ বাড়িতে এনে তাঁদের নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং সেই সমস্ত মানুষদের আত্মারা নাকি রাতের অন্ধকারে ফিসফিস করে কথা বলে এবং বিচিত্র সব আওয়াজের সৃষ্টি করে।

কি, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে?

সবই তো বুঝলাম। কিন্তু সেই মৃত শিশুটির হাসির শব্দ, নারীর অতৃপ্ত আত্মা কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামী শহিদদের এত কার্যকলাপ সত্ত্বেও এই বাড়িতে কেউ আত্মহত্যা করেননি, কেউ হার্ট আটাকে মারা যাননি কিংবা ভূতের ভয়ে কেউ পালিয়েও যায়নি। এ বাড়ির সব ভাড়াটেরা বছরের পর বছর ধরে দিব্বি স্বচ্ছন্দে বাস করছেন। এ ছাড়া রহস্যময় পুতুলবাড়ি-তে যারা রয়েছেন তারা কিন্তু কোনও ভুতুড়ে বা অলৌকিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীনও হননি। বর্তমানে বাড়িটি কলকাতা পুরসভার ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’-এর তকমা পেয়েছে। ১৯৯২-তে রোলান্ড জোফে নির্দেশিত ‘সিটি অব জয়’-এর শুটিংও হয়েছিল এই বাড়িতে।

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)

রহস্যময় পুতুলবাড়ি-র আনাচেকানাচে ঘুরে, বাড়িটিকে ভাল ভাবে চেনা ও জানার পর এটাই মনে হল যে, মান্ধাতার আমলে জং ধরে যাওয়া কিছু মনগড়া গল্পের গায়ে রঙিন রং লাগিয়ে সেটাকে ‘মগজ ধোলাই’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এত দিন। নিতান্তই কিছু সাধারণ ঘটনাকে সাসপেন্সের মোড়কে পুরে এড্রিনালিন হরমোন ক্ষরণের একটা দুর্দান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে কিছু অসৎ বাজে লোক। আর যে হেতু আমরা ভয় পেতে ভালবাসি, তাই সেই ভয় পাওয়া বা দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পুতুলবাড়িকে অযথা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলতে তাদের বিবেকে এক বারও বাধেনি। বাধ্য হয়ে এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। বলা হচ্ছে, ‘গুজবে কান দেবেন না। গুজবে ছড়াবেন না।’

পুতুলবাড়ির ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি

এ বার বলুন দেখি, পুতুলবাড়িতে কী আছে?

ভূত নাকি ভয়?

কুমারটুলির এই রহস্যময় পুতুলবাড়ি-র ভেতরের বেশ কিছু ছবি এবং বিশেষ কিছু তথ্য আমাকে দেওয়ার জন্য বাড়ির বর্তমান বংশধর এবং পরিবারের সদস্য শ্রীমতি উদিতা রায়কে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই।

ছবি ও ভিডিও: লেখক

0
0

This post was last modified on August 18, 2020 2:28 pm

বিজ্ঞাপন
admin:
বিজ্ঞাপন
Related Post

This website uses cookies.

বিজ্ঞাপন