একটা অসাধারণ টেস্ট সিরিজ শেষ হল সোমবার। ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতের অদম্য লড়াইয়ের নজির রেখে গেল যে সিরিজ তার সঙ্গে লেখা হয়ে গেল আরও অনেকগুলো কাহিনী। যেখানে যেমন ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, একে অপরকে সমস্যায় ফেলার চেষ্টা আবার স্পোর্টসম্যান স্পিরিট। সব মিলে England vs India ২০২৫ টেস্ট সিরিজ জুড়ে থাকল একগুচ্ছ গল্প। যা আগামীতে বার বার আলোচিত হবে ক্রিকেট বিশ্বে, লেখা থাকবে বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে। প্রথম ম্যাচে ৫ উইকেটে হারের পর দ্বিতীয় ম্যাচ জিতে সিরিজে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। যে ম্যাচ ৩৩৬ রানে জিতে নিয়েছিল ভারত। প্রথম ম্যাচে হারের পর এই ভারতীয় দল নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। প্রশ্ন ওঠেনি তৃতীয় ম্যাচ হারের পরও। যে ম্যাচ ৩৬ রানে হারে ভারত। কারণ অবশ্যই তিন ম্যাচ জুড়ে নবাগত ভারতীয় দলের অদম্য লড়াই।
তিন টেস্টের পর ভারত পিছিয়ে পড়েছিল ১-২-এ। পাঁচ ম্যাচের সিরিজে তখনও বাকি আরও দুই ম্যাচ। শুধু ম্যাচ নয়, বাকি ছিল দুই দলের জেদ, লড়াই, চোট, বাদ পড়া, নতুন মুখের সংযোজন আর একগুচ্ছ চমক সঙ্গে নাটকীয়তা ভরপুর ১০টা দিন। যা শুরু হয়ে গিয়েছিল চতুর্থ টেস্ট থেকেই। চতুর্থ টেস্ট ড্র-তে শেষ করে ভারত ও ইংল্যান্ড। সেই ম্যাচও ছিল নাটকীয়তার ভরা। যে ম্যাচে ব্যাট করার সময় পায়ের পাতায় ক্র্যাকের জন্য মাঝ পথেই ম্যাচ ছাড়তে হয় ভারতের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান ঋষভ পন্থকে। কিন্তু প্রথম ইনিংসেই সেই ভাঙা পা নিয়ে মাঠে নামতে হয় তাঁকে, দলের স্বার্থে, নেমে হাফ সেঞ্চুরিও করেছিলেন তিনি। যাঁর উদাহরণ শেষ টেস্টে টেনে এনেছিলেন স্বয়ং ইংল্যান্ডের জো রুট। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি, তার আগে চতুর্থ টেস্টের যে নাটকীয় মোর তৈরি হয়েছিল শেষ মুহূর্তে সেটা ছিল ইংল্যান্ড শিবিরের হতাশার বহিঃপ্রকাশ।
ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ম্যাচ ড্র হচ্ছে। ব্যাট করছেন ভারতের রবীন্দ্র জাডেজা ও ওয়াশিংটন সুন্দর। দু’জনেই দাঁড়িয়ে সেঞ্চুরির কাছাকাছি। জাডেজা ৮৯ ও সুন্দর যখন ৮০ রানে ব্যাট করছেন, তখন ইংল্যান্ড অধিনায়ক বেন স্টোকস এসে খেলা বন্ধের অনুরোধ জানান। ম্যাচ যে ড্র হবে তা তো নিশ্চিত হয়েই গিয়েছিল, ইংল্যান্ডের দাবি ছিল তাহলে আর খেলা চালিয়ে কী লাভ? কিন্তু জাডেজা ও সুন্দর তাতে রাজি হননি। তাঁরা খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, স্বাভাবিকভাবেই সেঞ্চুরির লক্ষ্যে। তা নিয়ে ভারতের দুই ব্যাটারকে ব্যাঙ্গ করতেও ছাড়েননি ইংল্যান্ড ক্রিকেটাররা। কিন্তু দু’জনে সেঞ্চুরি করেই মাঠ ছাড়েন।
২-১-এ সিরিজে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় এই ড্র ভারতকে বাড়তি অক্সিজেন পেতে সাহায্য করে। সঙ্গে সিরিজ ড্রয়ের আশা তৈরি হয় ভারতীয় শিবিরে। কারণ তখন বাকি শুধু শেষ ম্যাচ। পঞ্চম টেস্ট জিততে পারলেই সিরিজ ড্র। এই লক্ষ্যেই শেষ ম্যাচ খেলতে নেমেছিল ভারত। ইংল্যান্ডের সামনে ছিল ৩-১-এ সিরিজ জয়ের হাতছানি। যার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। ধরেই নেওয়া হয়েছিল চতুর্থ দিনই খেলা শেষ করে দেবে ইংল্যান্ড। কিন্তু তখনও বাকি ছিল ক্লাইমেক্স। ব্যাড লাইট থেকে বৃষ্টি। চতুর্থ দিন অনেকটা আগেই থামতে হল দুই দলকে। বৃষ্টির জন্য পুরো সময় ম্যাচ করা সম্ভব হল না। যার ফলে পঞ্চম দিনে পৌঁছল ম্যাচ। যখন জিততে হলে ইংল্যান্ডের দরকার ৩৫ রান, হাতে রয়েছে চার উইকেট। আর ভারতের জিততে দরকার সেই চার উইকেট।
প্রাথমিকভাবে চার উইকেট হাতে নিয়ে ৩৫ রান করে ম্যাচ জিতে নেওয়া সহজ লক্ষ্য বলেই মনে হচ্ছিল ইংল্যান্ডের সামনে। সেক্ষেত্রে তার মধ্যে চার উইকেট তুলে নেওয়া ভারতের জন্য অতটাও সহজ হবে না বলেই মনে করা হয়েছিল। কিন্তু ক্রিকেট দেবতা অন্য কিছু লিখে রেখেছিল এই সিরিজের জন্য। ভারতীয় বোলাররাও ছিলেন বিধ্বংসী মেজাজে, বিশেষ করে মহম্মদ সিরাজ ও প্রসিধ কৃষ্ণা। চতুর্থ দিনের শেষে পর পর উইকেট তুলে নিয়ে ইংল্যান্ড শিবিরকে বড় ধাক্কাটা দিয়ে রেখেছিলেন কৃষ্ণা। আর পঞ্চম দিন বাকি কাজ করে দিলেন সিরাজ। কৃষ্ণার বলে নিশ্চিত ক্যাচ ধরেও নিজের দেহের ভারসাম্য রাখতে না পেরে বাউন্ডারির বাইরে চলে যান সিরাজ। ছয় হয়ে যায় কঠিন সময়ে। তবে সেই ভুল দারুণভাবে শুধরে নিয়ে ভারতকে কঠিন ম্যাচে জয় এনে দিলেন তিনিই।
যশস্বী জয়সওয়ালের সেঞ্চুরি, আকাশ দীপ, জাডেজা, সুন্দরের হাফ সেঞ্চুরি তো ছিলই দ্বিতীয় ইনিংসে। যার ফলে বড় রানের লক্ষ্যমাত্রা রাখতে পেরেছিল ভারত। এই ম্যাচে চোটের জন্য ছিলেন না ইংল্যান্ড অধিনায়ক বেন স্টোকস। দলে একগুচ্ছ পরিবর্তন করেই দল নামিয়েছিল ইংল্যান্ড টিম ম্যানেজমেন্ট। শেষ পর্যন্ত লড়াই দিল সবাই। জবাবে দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের তরফে এল জোড়া সেঞ্চুরি, জো রুট ও হ্যারি ব্রুকের ব্যাটে। হাফ সেঞ্চুরি করলেন বেন ডাকেট। এর পরও ম্যাচ হারতে পারে ইংল্যান্ড তা হয়তো অতি বড় ইংল্যান্ড বিরোধীও ভাবেনি। কিন্তু ওই যে প্রথমেই বললাম ক্রিকেট দেবতা এই ম্যাচের জন্য অন্য কিছুই লিখে রেখেছিল। দিনের চারটি উইকেটের মধ্যে তিনটি নিলেন সিরাজ ও একটি কৃষ্ণা। ৬ রান বাকি থাকতে ইংল্যান্ডকে অলআউট করে শেষ ম্যাচ জিতে সিরিজ ২-২ করে ভারত।
আর এদিন ইংল্যান্ড শিবিরের তরফে দেখা গেল আরও একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। প্রথম ইনিংসে হাত ভেঙে মাঠে নামতে পারেননি ক্রিস ওকস। কিন্তু সেই ওকস গলায় হাত ঝুলিয়ে, তা সোয়েটারের ভিতর ঢুকিয়ে এক হাতে ব্যাট করতে নামলেন। শুরুতেই বলেছিলাম, ঋষভ পন্থের উদাহরণ টেনেছিলেন রুট। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভাঙা পা নিয়ে যদি পন্থ ব্যাট করতে নামতে পারে দেশের জন্য তাহলে ক্রিস ওকসও পারবে। দেশের জন্য ব্যথা ভুলে ব্যাট করতে নামতে।’’ তিনি নামলেও তাঁর ব্যাট করার সুযোগ হয়নি, তাই দর্শকদের এটা দেখার সুযোগ হয়নি তিনি কীভাবে এক হাতে ব্যাট করতেন। তবে ওই অবস্থায় ব্যাট করতে নামার সাহজ দেখানোটাই আসল স্পোর্টসম্যান স্পিরিট। যা পন্থের সঙ্গে প্রমান করলেন ওকস-ও। এই সিরিজ দীর্ঘদিন থেকে যাবে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে।
সব ছবি—বিসিসিআই এক্স
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google