Train Station 13-তে বাঙালির চিরকালের প্রিয় সেই সমুদ্র লাগোয়া স্টেশন। তখন এত জমজমাট ছিল না পুরী। তবুও শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় বাঙালির সবেধন নীলমণি। এখন তো পাহাড়, জঙ্গলেও বিপুল ভিড়। সিজ়ন বলে কিছু নেই। কিন্তু আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগে এমনটা ছিল না। তখন দার্জিলিং যেতে গেলেও ১০ বার ভাবতে হত। কিন্তু পুরী যেন হাতের মুঠোয়। আমরা সেই সময় উত্তরবঙ্গে থাকতাম। তা-ও দার্জিলিং নয়, বাবা নিয়ে যেতেন পুরী। ওটা বাবার অন্যতম প্রিয় জায়গা ছিল। তাই বাবা চলে যাওয়ার পর পুরীতে আর যাওয়া হয়নি। শেষ গিয়েছিলাম ২০০৩ সালে। দোলের সময়। সপরিবারে। তার পর কর্মসূত্রে অনেক বার ভুবনেশ্বর গিয়েছি। কিন্তু পুরী যেতে মন চায়নি। এ বার কেন জানি না, চলেই গেলাম। কাজ শেষে ভুবনেশ্বর থেকে ট্রেনে গিয়ে এক বেলা কাটিয়েই এলাম চির চেনা পুরীতে।
আমার তখন সাড়ে তিন বছর বয়স। মায়ের কাছে শুনেছি। সেই প্রথম আমার পুরী যাওয়া। বোন তখন মাত্র ছ’মাস। সেই স্মৃতি মনে থাকার কথাই নয়। স্মৃতি শক্তপোক্ত হতে হতে আরও বার কয়েক যাওয়া হয়েছে। কিন্তু মনে থাকার মতো বয়সে প্রথম যখন পুরী গেলাম, তার আগেই একটা গল্প মাথায় গেঁথে গিয়েছে। বাবা বলতেন, পুরী স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পরেই শোনা যায় সমুদ্রের গর্জন! আমার উত্তেজনা, সেই গল্পকে সামনে থেকে অনুভব করার।
সে বার ভোরবেলা ট্রেনের বার্থে শুয়েই চোখ চেয়ে দেখলাম পৌঁছে গিয়েছি পুরী। তখন সঙ্গে থাকত বিশাল বেডিং। তার মধ্যে থাকা আস্ত একটা সংসার আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত। হলিডে হোম বুক করা থাকত আগাম। সেখানে পৌঁছে সেই সংসার কয়েক দিনের জন্য তার ঝাঁপি খুলে বসত। লোটাকম্বল নিয়ে স্টেশনে নামতেই কানে ভেসে এল সমুদ্রের গর্জন! এমন ঘোর কাটতে আমার অনেক দিন সময় লেগেছে। যেন এখনই সব কিছু পেরিয়ে এই স্টেশন চত্বরেই ঢুকে পড়বে উত্তাল জলরাশি! এক বার শব্দটা আসছে। চলে যাচ্ছে আবার। সেই শব্দ কানে নিয়েই স্টেশন চত্বরের বাইরে চলে এলাম। তখন ট্রেন থেকে নামলে পর্যটক-পুণ্যার্থীদের ঘিরে ধরতেন রিকশাওয়ালারা। তাঁদের এক জনকে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম হলিডে হোমের দিকে।
অনুভব করলাম, স্টেশন যত পিছিয়ে পড়ছে, ততই বাড়ছে সমুদ্রের গর্জন। বুঝতে পারলাম, আমরা এগিয়ে চলেছি সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র এগিয়ে আসছে না। তত ক্ষণে পিছন থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে পুরী স্টেশন। রিকশা একটা মোড় ঘুরতেই চোখের সামনে খুলে গেল বিপুল সেই জলরাশি। যা দেখে অনেক ক্ষণ হাঁ হয়ে ছিলাম! এত জল, এত ঢেউ আগে তো কখনও দেখিনি। এ পারে কত মানুষ। আর ও পারটাই নেই! বিস্ময় সে যাত্রায় কাটেনি। তার পর পুরী যেতে যেতে ক্রমশ কেটেছে চমক।
তবে, এত গাড়ি-বাড়ি-হইহট্টগোলের মধ্যে পুরী স্টেশনে নেমে শুনতে পাওয়া সমুদ্রের গর্জনটা হারিয়ে গিয়েছে। সে বারের পর থেকে প্রতি বার টের পেয়েছি, একটু একটু করে কমছে সমুদ্র-শব্দ। তার পর এক দিন হারিয়েই গিয়েছে পুরী স্টেশনে নেমেই সমুদ্রকে শুনতে পাওয়ার অনুভূতি।
এ বার যখন প্রায় ২০ বছর পর আবার পুরী স্টেশনে নামলাম, একদম একা, তখনও কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছিলাম! যদি কোনও ভাবে এক বার স্টেশনে দাঁড়িয়ে সেই ছোটবেলার মতো শুনতে পাই সমুদ্রের গর্জন! কিন্তু না! সব কিছু পেরিয়ে সেই শব্দ আর এসে পৌঁছয় না পুরী স্টেশনে।
ভাল ছিল আমার ছোটবেলার পুরী। ওড়িশার সব থেকে পুরনো ‘ট্র্যাভেল ডেস্টিনেশন’। ১২৬ বছরের পুরনো পুরী স্টেশনে কত শত-হাজার-লক্ষ পর্যটকের ভালমন্দের স্মৃতি বুকে নিয়ে এখনও নির্মীয়মাণ… ঘোষণা হয়— যাত্রী গণ কৃপায়া ধ্যান দেওন্তু…।
১৮৯৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এই স্টেশনের সূচনা। খড়্গপুর থেকে পুরী— এই অংশটি এখন পূর্ব-উপকূল (ইস্ট-কোস্ট) রেলের মধ্যে পড়ে। শুরুর সময় যা ছিল বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়েজ। তবে এই পথের অভিভাবকত্ব বার বার বদলেছে। কিন্তু তা নেপথ্যের কাহিনি। পুরী বেড়াতে যাওয়া পযর্টকদের উপর সেই বদলের কোনও প্রভাবই পড়েনি। ২০১২ সালে পুরী স্টেশনকে ঢেলে সাজানো হয়। এখন কাজ চলছে অমৃত ভারত স্টেশন প্রকল্পের আওতায়। এখন স্টেসটিকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, যেন কোনও হিন্দু মন্দির। রাতে আলো জ্বলে উঠলে প্রথম দেখা কোনও পর্যটক তাকে মন্দির বলে ভুল করতেই পারেন। স্টেশনের প্রবেশপথ একটা বিশাল চত্বরের মধ্যে দিয়ে। যে চত্বর সব সময় ভিড়ে থিক থিক করে। সারা বছরের সেই ভিড়টাই কয়েক গুণ বেড়ে যায় রথের সময়।
তবে ওই ভিড়ে আমার কোনও দিন যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। বরং যখন লোক কম যায়, তখনই আমার বেশি পছন্দ পুরীর সমুদ্র সৈকত। তবে আজকালকার দিনে কোনও পর্যটনকেন্দ্রই আর কোনও সময়ে ফাঁকা থাকে না। মনে মনে আরও এক বার বলি, ‘‘বেশ ভাল ছিল ছোটবেলার পুরী।’’ পুরীর সমুদ্রে ঝড়ের স্মৃতিও এখনও তাজা। ভালবাসার সমুদ্র কীভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে সেবার না দেখলে বুঝতে পারতাম না। সালটা ১৯৯৯ যত দূর মনে পড়ছে। সেই ঝড়ের রাতটা আজও মনে আছে। কিন্তু পুরীর প্রতি টান কমেনি।
শুরুতেই বলেছি, হলিডে হোমে এক বেডিং সংসার কয়েক দিনের জন্য পাতা হত। সেই বেডিংয়ের মধ্যে থাকত বিছানাপত্র থেকে থালা, বাটি, গ্লাস…। ভাড়া নেওয়া হত স্টোভ-হাঁড়ি-কড়াই। সকালে ঘুম থেকে উঠে সৈকত থেকে মাছ কিনে আনা হত। তার পর তা রান্না হত হলিডে হোমের স্টোভে। আমরা বাড়ির মতোই পাত পেড়ে খেতাম। ওই যে শুরুতেই বলেছিলাম, একটা ছোট্ট সংসার পাতা হত পুরীতে। টানা সাত দিন পুরীতে থাকার অভিজ্ঞতাও রয়েছে আমার।
সে বার যেমন আমাদের পাড়াতুতো জেঠু-জেঠিমা আর ওঁদের ছেলে গিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে। জেঠুর ছেলেকে আমরা দাদাভাই ডাকতাম। ওর খুব হাঁপানির সমস্যা ছিল। মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ত। জেঠুকে কোনও এক ডাক্তার বলেছিলেন, দাদাভাইকে নিয়ে পুরী যেতে। সমুদ্রে খুব বেশি করে স্নান করালেই নাকি ও সুস্থ হয়ে যাবে। বাবার কাছে এলেন জেঠু। বাবাও রাজি হয়ে গেলেন। আমরা চললাম পুরী। দুটো ঘর নিয়ে আমাদের একটা সংসার। মা আর জেঠিমা রান্না করতেন। বাবা আর জেঠু বাজার। আর দাদাভাই, বোন আর আমি শুধুই আনন্দ। আমরা রোজ সমুদ্রস্নানে যেতাম। দাদাভাইয়ের জন্যই স্নানের সময়টা অনেকটা পেতাম। জানি না, সে জন্যই কি না, তবে সত্যিই দাদাভাই সুস্থ হয়ে গিয়েছিল এর পর।
যে কোনও সমুদ্র সৈকতেই বিকেল, সন্ধেটা খুব সুন্দর হয়। স্নানের থেকেও আমার বেশি প্রিয় সৈকতে বসে ঢেউয়ের আসা-যাওয়া দেখা। গোনা। বিকেল হলেই চলে যেতাম সৈকতে। তখন পুরীর সমু্দ্র বেশ খানিকটা পিছিয়ে যেত। হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে বসতেন দোকানিরা। সৈকত জুড়ে শুধু শোনা যেত শঙ্খের ধ্বনি। বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ। আমরা অনেক শঙ্খ কিনতাম। এ বার গিয়েও শঙ্খ কিনেছি। এক দিকে সমুদ্রের উথালপাথাল ঢেউ। অন্য দিকে, সন্ধের শঙ্খধ্বনি। পরিবেশটাই বদলে দিত। এখন ভাবলেই মন কেমন করে!
আরও কত কিছু যে পাওয়া যেত! বিভিন্ন ধরনের পুতুল— তার মধ্যে বিখ্যাত, সুখী আর দুখী পরিবার। একটা পুতুলের ভিতর আর একটা পুতুল ভরা থাকত। এ ভাবে বড় থেকে ছোট— মোট পাঁচটা পুতুল থাকত একটার মধ্যেই। পাওয়া যেত বিভিন্ন ধরনের কাজ করা বাসনপত্র। আমার খুব প্রিয় ছিল, দাদুর জন্য আনা সুন্দর কাজ করা কালো একটা লাঠি। আর পাওয়া যেত কটকি শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফ্রক— আরও কত কী। একই সঙ্গে পুরী মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়াও ছিল।
পুরী স্টেশনে মানুষের পায়ে পায়ে চলে আসে বালি। সমুদ্রের শব্দ এখন আর স্টেশন থেকে শোনা যায় না। তবে সেই গর্জনের রেশ থেকে যায় ট্রেনের শেষ কামরাটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত। বাতাসে ভেসে থাকে নোনা জলের স্বাদ।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবর
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google