Train Station 6: আস্তিনে ইতিহাস গুটিয়ে অপেক্ষায় একলা স্টেশন

Train Station 6

গাড়িটা যখন হেলতে দুলতে লেভেল ক্রসিং পেরোচ্ছিল, তখনই খেয়াল করলাম, ডান দিকে শ’খানেক মিটার দূরে একটা স্টেশন (Train Station 6)। গাড়িচালকের কাছে জানতে চাইতেই তিনি জানালেন, ওটা কাশিমবাজার স্টেশন। আমার তো জানাই ছিল না কাশিমবাজার নামে একটা আস্ত স্টেশন আছে! যে কাশিমবাজার রাজবাড়ির অন্দরে রাত কাটানোর উত্তেজনা নিয়ে এখানে আসা, সেখানকার স্টেশন না-ছুঁয়ে দেখলে হয়! তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, ফেরার পথে আর বহরমপুর কোর্ট নয়, এখান থেকেই ট্রেন ধরব। আমাদের থাকার জায়গা থেকে খুব বেশি দূরেও নয়। হেঁটেই পৌঁছনো যাবে ক্ষণ।

সকালে যখন রিকশায় এই পথে গিয়েছি, তখন কিন্তু নজরে এড়িয়ে গিয়েছে স্টেশনটা। প্রথম দর্শনে ধরা না-দিলেও, এই গোধূলি আলোয় কাশিমবাজার স্টেশনকে দেখে খুবই সাদামাটা মনে হল। মফস্‌সলীয় প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্টেশন যে খুব একটা প্রাণবন্ত নয়, তা দূর থেকেই মালুম হয়। সামনে গেলে আরও স্পষ্ট। নবাব নগরীতে যাঁরা ঘুরতে আসেন, তাঁরা সাধারণত বহরমপুর কোর্ট বা মুর্শিদাবাদ স্টেশনে নেমেই বিভিন্ন জায়গায় যান। হাজারদুয়ারি-সহ একাধিক জায়গা ঘুরে থেকে যান শহরের ভিতরেরই কোনও হোটেলে। তবে আমার পছন্দ ছিল, শহরের ঘিঞ্জি থেকে দূরে, ইতিহাসের সঙ্গে একটা পুরো দিন-রাত কাটানো। তখনও জানতাম না, রোমাঞ্চকর কোন অভিজ্ঞতা হবে আমাদের।


কাশিমবাজার রাজবাড়িতে থাকব। স্থানীয়দের কাছে ছোট রাজবাড়ি। ভোরের হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসের এসি চেয়ারকার আগে থেকেই রিজার্ভ করা ছিল। কলকাতা থেকে ট্রেন ছাড়লেও আমি উঠি ব্যারাকপুর থেকে। বাড়ি থেকে ওটাই কাছে হয়। বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে নেমেছিলাম সাড়ে ১০টার মধ্যেই। স্টেশন চত্বরে তো হাজারো মানুষের ভিড়। সাইকেল রিকশা থেকে টোটো— সবেরই ছড়াছড়ি। এখানে আবার টোটোর আদরের নাম টুকটুক। নানা হাঁকডাকের মধ্যে এক রিকশাওয়ালাকেই বেছে নিলাম। তাঁর রিকশায় টুকটুক করে পৌঁছলাম কাশিমবাজার রাজবাড়ি। মিঠে এক সফর!

রাজবাড়ির একটা অংশ পর্যটকদের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। অভ্যর্থনায় সে এক এলাহি ব্যাপার। যাই হোক, রিসেপশনে পৌঁছনোর আগেই মূল রাজবাড়ির ধবধবে সাদা অংশ। বাড়ির প্রকৃত বাসিন্দারা যখন শহর থেকে আসেন, তখন এখানেই থাকেন। তবে পর্যটকরা ঘুরে দেখতে পারেন রাজবাড়ির ঘরে-বাইরে। ভেবেই কেমন গা ছমছম করছে! কত ইতিহাস সাজানো রয়েছে এ বাড়ির অন্দরমহলে! রিসেপশন থেকে সইসাবুদ সেরে নির্দিষ্ট ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য সিঁড়িতে পা দিতেই ইতিহাসের গন্ধটা নাকে এসে ধাক্কা মারল! দীর্ঘ লম্বা ব্যালকনি আলোআঁধারি পেরিয়ে দাঁড়া‌ল রাজবাড়ির ঐতিহাসিক ঘরের সামনে। এক দিন-রাতের জন্য যে ঘর শুধুই আমার!

পুরো ঘরটাকেই ঘিরে রেখেছে বারান্দা। সামনে, পিছনে। মাঝখানে পর পর তিনটি ঘর শুধু পর্যটকদের জন্য। এ রকমই একটা বারান্দায় বসে সকালের জলখাবার খেলাম। তার পর স্নান সেরে রাজবাড়িতে ঘোরার অনুমতি থাকা অংশে এ দিক ও দিক ঘুরতেই চোখে পড়ল সামনে একটা খালি ছাদ। সে ছাদে নামতেই দেখলাম দুটো বন্ধ দরজা। তালায় জং ধরেছে। না, এ সব নিয়ে আর তদন্তে নামিনি। বরং ঘরে এসে একটা টানা ঘুম। তার পর বিকেলে বেরোলাম মুর্শিদাবাদের জানা, অল্প জানা, অজানা ইতিহাসের স্বাদ নিতে।

তালিকায় অবশ্যই হাজারদুয়ারি, মতিঝিল, কাঠগোলা, খোসবাগ গার্ডেন…।

দিনটা শেষ করলাম মতিঝিল পার্কের ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শো দেখে। সময়টা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। ঠান্ডাটাও জাঁকিয়ে পড়েছে। খোলা আকাশের নীচে কনকনে ঠান্ডায়, আলোআঁধারি পরিবেশে কখনও দূর থেকে ভেসে আসছে ঘোড়ার খুরের শব্দ, কখনও অট্টহাসি! কখনও আবার রাজবাড়ির মহিলামহলের কলকাকলি।

ঘুরে ফেরার পথে কাশিমবাজার স্টেশনকে দেখলাম অন্ধকারে ডুব দিয়েছে। টিমটিম করে জ্বলছে অল্প আলো। অদ্ভুতুড়ে এক পরিবেশ। যেন এখনই ঘোড়ায় করে ছুটে আসবেন কোনও সিপাই। আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, এত রাতে এই এলাকায় কী করছি একা নারী?

তবে এ সবের মধ্যেই আমাকে টানছিল ছোট রাজবাড়ির অন্দরমহল। কেয়ারটেকার গোবিন্দদা বর্ধমানের মানুষ। থাকেন এই রাজবাড়িতেই। সবটা দেখভালের দায়িত্বও তাঁর উপর। তো গোবিন্দদা বলেছিলেন, রাতে আমাকে রাজবাড়ির অন্দরমহল দেখাবেন। দুরুদুরু বুকেই রাজি হয়েছিলাম। রাজবাড়ির রেস্তরাঁয় মাংস-ভাত খেলাম। তার পর গোবিন্দদার সঙ্গে সেঁধিয়ে গেলাম কাশিমবাজার রাজবাড়ির অন্দরে।

আমার ঘরের পাশ দিয়েই অন্য একটা দরজার তালা খুলে ঢুকে পড়ল গোবিন্দদা। ভিতরটা নিকষ কালো, অন্ধকার। আলো জ্বালিয়ে ভিতরে ডেকে নিলে‌ন গোবিন্দদা। হেঁশেল থেকে স্নানঘর, দুর্গাদালান থেকে কোর্টরুম— চোখের সামনে খুলে যেতে লাগল বাংলার ইতিহাসের অজানা কাহিনি। হাতে টানা পাখাটা কি নড়ে উঠল একটু? দূরে কোথাও ঢং ঢং করে রাত ১২টা বাজল। হুইস্‌ল দিতে দিতে গন্তব্যে ছুটে গেল ট্রেন! কাশিমবাজার স্টেশন ছুঁয়েই। হয় লালগোলা, নয়তো কলকাতা।

কাশিমবাজার রাজবাড়ি তৈরি হয়েছিল রায়দের হাত ধরে। অযোধ্যারাম রায় এবং তাঁর ছেলে দীনবন্ধু রায় এখানে শুরু করেছিলেন সিল্কের ব্যবসা। সেই ব্যবসায় পসার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই রায় পরিবার ক্রমশ জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে কাশিমবাজারে। এর পর দীনবন্ধুর ছেলে জগদ্বন্ধু ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। তবে বেশি দিন তিনি ওই কাজ করতে পারেননি। সারেইল (এখন বাংলাদেশ)-এ জমিদারি কেনেন। সেখানেই ব্যবসা বাড়াতে থাকেন। পরবর্তীতে সেখান থেকেই চলে আসেন কাশিমবাজারে। এর পর ব্রিটিশ সরকার অন্নদাপ্রসাদকে রায় বাহাদুর সম্মান দেয়। কিন্তু সেই সম্মান প্রদানের অনুষ্ঠানের মধ্যেই প্রয়াত হন তিনি। তখন সেই সম্মান দেওয়া হয় তাঁর ছেলে আশুতোষনাথ রায়কে। তার পর থেকে যত দিন জমিদারি প্রথা ছিল, চলেছে রায় পরিবারের কাশিমবাজারের জমিদারি।

সেই রাতে ঘরে ফিরে বেশ গা ছমছম করছিল! বিশাল বিশাল জানলার পর্দা টেনে আলো জ্বালিয়েই ঘুমোতে গেলাম। মাঝে এক বার গোবিন্দদা এলেন। দরজায় আলতো টোকা। ভয় পাওয়ার জোগাড় আর কী! মনে করালেন, অনেক ভোরে বেরোতে হবে। আলো ফোটার আগেই ট্রেন কাশিমবাজার থেকে।

শীতের সকাল। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। রাজবাড়িকে বিদায় জানিয়ে পৌঁছলাম বার বার দূর থেকে দেখা সেই স্টেশনে। কাশিমবাজার। জীর্ণ অবস্থা। প্রচুর মানুষের স্পর্শ পায় না এই স্টেশন। বাংলার নবাবদের দাপট দেখা এই অঞ্চল সাক্ষী তাঁদের পতনের কাহিনিরও। হয়তো এই স্টেশনের বুকেই লেখা রয়েছে অজানা অনেক কাহিনি, যার কিছুটা জানা গেল। তবে অনেকটাই থেকে গেল নেপথ্যে।

যতটুকু জানা— কাশিমবাজার একটা সময়ে ছিল বাংলার বন্দর শহর। বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের পীঠস্থান। এখন এই কাশিমবাজারকে দেখলে অবশ্য সেই ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। তবে ইতিহাসের পরতে পরতে লেখা রয়েছে কাশিমবাজারের নাম। আর তাতে বড় ভূমিকা এই স্টেশনের। এই স্টেশনে পা পড়েছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও। মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অনুরোধে ট্রেনে করে এই কাশিমবাজার স্টেশনে নেমেই তি‌নি রাজবাড়িতে পৌঁছেছিলেন। সেটা ১৯০৭ সালের ৩১ অক্টোবর। পরের দিন অর্থাৎ ১ নভেম্বর তাঁর সভাপতিত্বে আয়োজিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন’। সেই অনুষ্ঠানে যত খ্যাতনামীরা উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই ট্রেনে করে এই কাশিমবাজার স্টেশনেই নেমেছিলেন। স্টেশন থেকে পাল্কি এবং এক্কাগাড়িতে করে পৌঁছেছিলেন রাজবাড়িতে। স্টেশনের প্রায়-শূন্য প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না-দেখা সময়ের পাতায়। অনেক ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে এই কাশিমবাজার স্টেশন। যেখানে এই মুহূর্তে হাতেগোনা কয়েকটামাত্র ট্রেন দাঁড়ায়। বাকি সময়টা শুধুই শূন্যতা। ইতিহাস বুকে রেখে হাহাকার শোনে এক সময়ের বন্দর শহর।

ট্রেন ঢুকছে সশব্দে। পিছন ফিরে সাদা বাড়িটার এক ঝলক দেখার চেষ্টা করলাম বটে। ভোরের ভাগীরথী এক্সপ্রেস পৌঁছে দিল আমার চেনা শহরে। পিছনে পড়ে রইল কাশিমবাজার। রাজবাড়ি। স্টেশন। প্রথম দেখাতেই যাকে মনে হয়েছিল বড্ড একা। আর আমার যাওয়া হয়নি। হয়তো এই এত্ত বছর ধরে আমার অপেক্ষায় একলা বসে রয়েছে কাশিমবাজার স্টেশন।

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle