ধানফুলের গন্ধ মাতাল করে স্বপ্ন দেখার এই খামারবাড়িতে

ধানফুলের গন্ধধানফুলের গন্ধ

অতুলনীয় রায়


ধানফুলের গন্ধ, ওয়াগনার থেকে নামতেই কোথা থেকে যেন ভেসে এল। চোখটা বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিলাম, যাতে মিষ্টি ওই গন্ধটাকে নিজের ভেতরে নেওয়া যায়।
সরু যে রাস্তাটা পেরিয়ে অনেকটা ওপরে এলাম, তারই পাশের ধাপে ধাপে ধান ফলানো হয়েছে। গন্ধটা আসছে ওখান থেকেই। তখনও জানি না, ফুরিয়ে আসা দুপুরে পাহাড়ের ঢালে বসে ডিমের ঝোলের সঙ্গে যে গরম ভাতটা খাব, সেটা আসলে এই ধাপ চাষেরই ফসল।

তিস্তা বাজার নামব শুনে শরৎ তখন বলেছিল, ‘‘বাজারে নয়, ব্রিজের উপর নামিয়ে দেব।’’ তিস্তা ব্রিজ। তার ঠিক কয়েক মিটার পিছনেই মোড়টা। যার একটা হাতা চলে গিয়েছে তিস্তা বাজার, পেশক, লামাহাটা হয়ে সোজা দার্জিলিং। আর একটা হাতা, তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে গ্যাংটক। তবে, শরৎ যাবে কালিম্পং। তিস্তা ব্রিজ পেরিয়েই চিত্রে মোড় থেকে ডান দিকে উঠে যাবে ও। আমরা নেমে যাওয়ার পর আরও মিনিট চল্লিশেক গাড়ি চালাতে হবে ওকে। তত ক্ষণে যদিও আমরা ব্রিজের এ মাথা থেকে রুবেনের ওয়াগনার চেপে তিস্তা বাজার থেকে বাঁ হাতে উঠে পড়ে পৌঁছে গিয়েছি বড়া মাঙ্গওয়া।

বড়া মাঙ্গওয়া

এখা‌নে মেঘ গাভীর মতো চরে…

রুবেনের হাত এই পাহাড়ি পথে ঠিক স্টিয়ারিং ধরে থাকে বলে মনে হয় না। যেন প্রেমিকার হাত ধরে থাকে ও সব সময়। সে ভাবেই তিস্তা বাজার থেকে ও নিয়ে এসেছে আমাদের। আর নামানো মাত্রই ধানফুলের গন্ধ নাকে এল।

চোখটা খুলতে হল, পায়ের কাছে একটা সুড়সুড়ি মতো লাগল বলে। দুটো লোমশ কুকুর! যেন কত দিনের চেনা, এমন ভাবে পায়ের কাছে লুটোপুটি খাচ্ছে। মেঘ তো ‘হ্যাট… হ্যাট’ করে ওদের বকাও শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কে কার কথা শোনে!

ওদের লুটোপুটি আর জাপ্টাজাপ্টি যেন থামছেই না। তার মধ্যেই একটি কিশোর আমাদের লাগেজগুলো রুবেনের কাছ থেকে নিয়ে ওই ধান খেতের মধ্যে দিয়েই বয়ে যাওয়া পাকা-হাঁটাপথে এগিয়ে চলেছে পাহাড়ের কোলের কাছে।

আগে থেকে বলে রাখলে ফার্ম হাউসের গাড়ি তিস্তা বাজার শুধু নয়, শিলিগুড়ি, নিউ জলপাইগুড়ি বা বাগডোগরা থেকেও নিয়ে আসতে পারে। আমরা যদিও একটু ‘লোকাল গাড়ি’তে চড়তে চেয়েছিলাম। তাই শিলিগুড়ির পানি ট্যাঙ্কি থেকে শরতের টাটা সুমোয় চড়া। ওর বাড়ি কালিম্পঙে। রোজ এক বার করে শিলিগুড়ি নামে। আবার ফিরেও যায়। ওর পাশেই সামনের দুটো সিট ‘বুক’ করে আমি আর মেঘ বসে এলাম তিস্তা ব্রিজ পর্যন্ত। আসতে আসতে শরতকে খুব ঈর্ষা হচ্ছিল। রোজ কী সুন্দর পাহাড়ের মধ্যেই বেঁচে থাকে!

বড়া মাঙ্গওয়া

বারান্দায় বসে আরাম পোহানো…

বিকেল তখন সবে নামছে বড়া মাঙ্গওয়ার শরীরে। ওই হাঁটাপথ বেশ কিছুটা ঘুরে ফিরে মিনিট দশেকের মধ্যে আমাদের যেখানে পৌঁছে দিল, সেটা একটা বিরাট চওড়া বারান্দা। তারই হাতায় পাহাড়ের গায়ে প্রায় হেলান দিয়ে বসে রয়েছে আস্ত একটা বাংলো! ছাইরঙা দেওয়ালের ছাদের রং যেন ইচ্ছে করেই পাহাড়ের সঙ্গে কনট্রাস্ট করে রাখা হয়েছে। ঠিক যেন সবুজ টিয়ার লালচে ঠোঁট।

চার দিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। ছোট, ফুল, রাঙা, ন, মেজো, বড়…। চওড়া এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে উল্টো দিকে সর্ব ক্ষণ দেখা যায় কালিম্পঙের পাহাড়। রেলিং-এর ওপারটায় এখন ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। কোথাও পেঁজা তুলোর মতো, কোথাও দলা পাকিয়ে, কোথাও আবার দুধের পাতলা সরের মতো। আর নীচে, অনেকটা নীচে, দেখা যাচ্ছে সরু ফিতের মতো সবজে রঙের তিস্তাকে। একটু নজর করলে দেখা যাচ্ছে তিস্তা ব্রিজও। যার মাথায় মিনিট পঁয়তাল্লিশেক আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল শরৎ। আর তুলে নিয়েছিল রুবেন।

বাংলোরই একটা অংশে খাওয়ার জায়গা। সেখান থেকেও দেখা যায় পাহাড়ের সারি। এই শেষ দুপুরে সেখা‌নে বসে ডা‌ল, আলুভাজা আর ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খাচ্ছি আর একই রকম ভাবে চেটেপুটে নিচ্ছি উল্টোদিকের পাহাড়গুলোর রূপ। মেঘ তো ওদিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ও আসলে পাহাড়ে এসে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এমন সময়েই জিনস আর সাদা টি-শার্টের এক যুবক এসে নমস্কার করে বললেন, ‘‘ওয়েলকাম টু বড়া মাঙ্গওয়া। ম্যায় কেশর হু।’’

বড়া মাঙ্গওয়া

‘‘ওয়েলকাম টু বড়া মাঙ্গওয়া। ম্যায় কেশর হু।’’

ইনিই তা হলে কেশর! রুবেন তখন গাড়িতে আসতে আসতে এঁর কথাই বলছিল। আসলে বড়া মাঙ্গওয়ায় যেখানে আমরা উঠেছি, সেটা একটা ফার্ম হাউস। কয়েক জন মিলে এই ফার্ম হাউসটা চালান। তাঁদেরই অন্যতম এই কেশরভাই। স্থানীয় বাসিন্দা। যে জমিতে এই বাংলোটা করা হয়েছে, সেটা একটা সময়ে কেশরভাইদেরই ছিল। পরে ফার্ম হাউস করা হয়। এখানে আসা অতিথিদের দেখভালের দায়িত্বটা নিজের হাতে সামলান কেশরভাই। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সবটাই।

রান্নাঘরটা এই খাওয়ার জায়গা থেকে দেখা যাচ্ছে। গল্পে গল্পে জানা গেল, রান্না যিনি করছেন তিনি কেশরভাইয়ের দিদি। দু’জনের কেউই সংসার বাড়াননি। দু’জন আরও কিছু মানুষের সাহায্যে এই ফার্ম হাউসের অনেকটা দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ‘‘ডিমটা কিন্তু আমাদের ফার্মের। কেমন লাগছে?’’—হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন কেশরভাই।

তাই! আচ্ছা মুরগি পোষেন তবে?হালকা হেসে কেশর বললেন, ‘‘ শুধু কি মুরগি? পোল্ট্রির পাশাপাশি গোটারি আছে। একটা বড় গোয়ালে কয়েকটা গরুও আছে। এর পর যে পায়েসটা খাবেন, সেটাও ওই ডেয়ারি থেকে আসা। আর হ্যাঁ রাতে যে চিকেন কষা হবে, সেটাও ফার্মেরই পোল্ট্রির। এই ডালটাও গত মরসুমে এখানে হয়েছে।’’

তা হলে যে ধানফুলের গন্ধ পেলাম, সেটাও কি… ‘‘স্যর, সারা বছর এখানে যত অতিথি আসেন, সকলে এই ফার্ম হাউসে ফলানো জিনিসপত্রই খান। সেটা চাল হোক বা ডাল, মাংস হোক বা ডিম, দুধ হোক বা মিষ্টি, এমনকি ফলও। সে কারণেই এখানে আপনি মাছ পাবেন না। কারণ আমাদের ফিশারি নেই।’’

বড়ামাঙ্গওয়া, আমার ভালবাসার বারান্দা, আমার খাদের ধারের রেলিংটা

হাসিটা ভারী মিষ্টি কেশরভাইয়ের। এ কথাগুলো যখন কেশরভাই বলছিলেন, রান্নাঘর থেকে তত ক্ষণে তাঁর দিদি পাঠিয়ে দিয়েছেন, দু’বাটি পায়েস। সে যে কেমন খেতে বলে বোঝানো যাবে না। অমৃত কখনও খাইনি। না হলে অমৃতের সঙ্গে তুলনা করাও যেত।

বড়া মাঙ্গওয়া

সব খেলার সেরা….

তত ক্ষণে বিকেল নেমে এসেছে বড়া মাঙ্গোয়ায়। খেয়েদেয়ে আমরা আর ঘরে ঢুকলাম না। নেমে এলাম পাহাড়ি পথে, সেই নীচের রাস্তায়। যেখানে রুবেন আমাদের নামিয়েছিল। ও মা, কুকুর দুটোও নেমেছে পায়ে পায়ে। কী জ্বালা! মেঘ তো ভীষণই বিরক্ত। ‘হাই, হ্যাট’ করেও সরানো গেল না। পায়ের ফাঁক দিয়ে দৌড়চ্ছে কখনও, কখনও বা পিছিয়ে পড়ছে ইচ্ছে করে। আবার ওদের এগোতে দিলেও এগোচ্ছে না কিছুতেই। ঠিক পায়ে পায়ে হাঁটছে। ধানফুলের গন্ধ আবার নাকে এল।

নীচের পাকা রাস্তা ধরে এগোলাম কিছুটা। কিন্তু, ওই লোমশদের কয়েক জন বন্ধু এসে জুটল। মেঘ হাতে গাছের ডাল ভেঙেও কিছু করতে পারল না। কিছুটা রাস্তা দিয়ে উঠে, ফের নেমে এলাম। অনেকটা নীচে নেমে একটা মোড়ের মতো জায়গায় গিয়ে উঠে গেলাম ফের। এই ওঠানামার পুরোটাতেই দু’জন তাদের বন্ধুদের নিয়ে সঙ্গে ছিলেন। তবে, আমাদের বিরক্তিটা কেটে গিয়েছিল কিছু ক্ষণের মধ্যেই। তত ক্ষণে সন্ধে নেমেছে। এখনও ধানফুলের গন্ধ ভেসে আসছে।

মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে যখন বাংলোয় পৌঁছালাম, বারান্দায় তখন অপেক্ষা করছেন কেশরভাই। আর উল্টো দিকের কালিম্পং পাহাড়ও। চেয়ারে বসতেই এসে গেল গরম গরম চা আর ভেজ পকোড়া। কেশরভাইকেও আমাদের সঙ্গে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো গেল। আর সেই চা পর্বেই নতুন করে চেনা গেল কেশরভাইদের।

বড়া মাঙ্গওয়া

ফার্ম হাউসের বেদানা…

এই ফার্ম হাউসের সঙ্গে জড়িত যাঁরা, তাঁরা সকলে মিলে এই গ্রামে একটা স্কুল চালান। পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়াশোনা করে। কারণ, এ গ্রাম থেকে সরকারি স্কুল অনেকটা দূরে। বাচ্চারা সেই স্কুলে যেতে চায় না। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেশরভাইরা এখানে স্কুল খুলেছেন। আছে ফুটবল কোচিং স্কুলও। ওই স্কুলের ছেলেরাই সেই ক্যাম্পে কোচিং নেয়। গোটা পাঁচেক মেয়েও আছে। তারা নাকি দারুণ খেলে! কেশরভাই বললেন, ‘‘এখন ভলিবলের মরসুম চলছে। তাই ফুটবলে একটু ঘাটতি পড়েছে। তবে মাসখানেকের মধ্যেই ফের চালু হয়ে যাবে।’’ কলকাতা শহরের কয়েক জন শুভাকাঙ্খী কেশরভাইদের ‘ফুটবল, জার্সি, জুতো, হেল্থড্রিঙ্কস’ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। স্কুলের জন্য বই-খাতা-পেনও দেন তাঁরা।

কেশরভাইয়ের মুখে আশ্চর্য এই দুনিয়ার কথা শুনে আমরা দু’জনেই কেমন মোহিত হয়ে যাই। কখন যে চা শেষ হয়ে গিয়েছে! ব‌লতে বাধ্য হই, আর এক কাপ হবে? সঙ্গে সঙ্গেই কেশরভাই তাঁর ব্যবস্থা করেন।

তার মানে, শুধু নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে এই ফার্ম হাউস নয়? কেশরভাই জানালেন, ‘‘একদমই না। বরং আমরা সবাই মিলে ভাল থাকব বলে, গোটা বড়া মাঙ্গওয়া ভাল থাকবে বলে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভাল থাকবে বলে এই ফার্ম হাউস, এই স্কুল, এই ফুটবল কোচিং।’’ শিলিগুড়ির এক উদ্যোমী তরুণ আছেন। তিনিও এই ফার্ম হাউসের সঙ্গে যুক্ত। তিনি মূলত পর্যটক আনার দিকটা দেখেন। আর বাকিটা সামলান কেশরভাই। আসলে পর্যটক না এলে কোনও দিকই সামাল দেওয়া যাবে না। কেশরভাই বললেন, ‘‘অনেকেই আমাদের সঙ্গে আছেন। পাশে আছেন। একা একা স্বপ্ন দেখা যায়, কিন্তু তা পূরণ করতে গেলে অনেককেই লাগে। সেই সব কাছের মানুষ আছেন বলেই আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি। আর স্বপ্ন পূরণও হয়।’’

রাতের খাবার খেয়ে যখন মেঘকে নিয়ে শুতে যাব, তত ক্ষণে কালিম্পং পাহাড়ে সন্ধেয় জ্বলে ওঠা হাজারো টুনি লাইট নিভে গিয়েছে। কয়েকটা মাত্র জ্বলছে। হঠাৎ করেই একটা আলোর আভা পাহাড়টার পিছনে দেখা গেল। মেঘকে ডেকে দেখালাম, ‘‘ওই দেখো।’’

তত ক্ষণে চাঁদের কণা আরও উজ্জ্বল হয়ে অনেকটা ঠিক বাঁকা বলের আকার নিয়েছে। ধীরে ধীরে উঠছে। আরও আরও… কেমন তর তর করে উঠছে এ বার। পাহাড়ে এসে সূর্যোদয় দেখেছি আমরা, কিন্তু, চন্দ্রোদয় এই প্রথম। কিছু ক্ষণের মধ্যে গোটা কালিম্পং পাহাড়কে আলো করে দিয়ে আকাশের বুকে ভেসে উঠেছে চাঁদ।

গোটা পাহাড়টা এ বার আলোকিত। সবটা যেন দেখা যাচ্ছে। ওর মধ্যেই কোথাও হয়তো শরতের বাড়ি। ছেলেটাকে এখন আর ঈর্ষা হচ্ছে না। নতুন করে ঈর্ষা করতে শুরু করেছি যে এই যৌথ খামারের শরিক কেশরভাইকে।

ধানফুলের গন্ধ যেন ভেসে আসছে, অনেকটা নীচ থেকে।