বসুশ্রীর পয়লা বৈশাখের জলসা আর জিয়া নস্ট্যাল কৌলিন্যের বিচারে তখন এই জলসাই ছিল পয়লা নম্বরে। নতুন বছরের শুরুতে জাস্ট দুনিয়ার জন্য সেই নস্টালজিয়ার স্রোতেই গা ভাসালেন অমৃত হালদার।
কলকাতা, সালটা ১৯৫০ ৷
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের উপর বসুশ্রী হলের গায়ে সবে তারুণ্যের রং লাগতে শুরু করেছে ৷ ইউরোপিয়ান ধাঁচে তৈরি হলটির একটি ঘরে রোজ সন্ধ্যাতেই তাবড় তারকাদের ভিড় জমে যেত ৷ এমনই এক সন্ধ্যায় আড্ডায় হাজির হলের সর্বেসর্বা মন্টু বসু, শ্যামল মিত্র, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অজিত চট্টোপাধ্যায় ৷ তবুও আড্ডাটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা তখনও ৷ আসলে আড্ডার প্রাণ পুরুষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে এখনও এসে পৌঁছননি ৷ অবশেষে বসুশ্রীতে এসে হাজির হলেন ৬ফুট ২ ইঞ্চির মানুষটা ৷
সান্ধ্যকালীন আড্ডা বসবে, আর একটু খাওয়া-দাওয়া হবে না! এটা বিলকুল নাপসন্দ ছিল হেমন্তবাবুর ৷ তিনি আসতে না আসতেই চলে এল ভাঁড়ে চা আর পূর্ণ ঘোষের খাস্তা শিঙাড়া ৷ চায়ের ভাঁড়ে চুমুক লাগিয়ে হেমন্তবাবু বললেন, ‘‘শোন মন্টু তোর হলে তো অনেক জায়গা৷ সামনেই তো পয়লা বৈশাখ৷ একটা জমজমাট জলসা করা যায় না?’’ সবাই তো হেমন্তবাবুর সেই প্রস্তাবে দারুণ খুশি৷ কিন্তু জলসা জিনিসটা আসলে কী, তখনও জানেন না কেউই৷ আসলে তখনও এ দেশে তেমনভাবে জলসা রং জমাতে শুরু করেনি৷ তবে হেমন্তবাবু যখন বলেছেন, তখন বিরাট একটা ব্যাপার হবে৷ হেমন্তবাবুর এক কথায় রাজি মন্টু বসু৷ তবে তাঁর আবদার, ‘‘দাদা, গোটা ব্যাপারটা কিন্তু তোমাকেই দেখতে হবে৷’’ হেমন্তবাবুও নিরাশ করলেন না৷ কথা দিলেন, যদি বোম্বেতেও থাকেন পয়লা বৈশাখের সময় বসুশ্রীর জলসায় হাজির হবেনই৷ সেই থেকে শুরু হল বসুশ্রী সিনেমা হলে পয়লা বৈশাখের জলসা৷
সে এক রমরমা ব্যাপার৷ এই একটা দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন বহু মানুষ৷ এই আসরে তো টিকিটের কোনও ব্যাপার ছিল না৷ হল খোলার কিছুক্ষণের মধ্যেই হাউসফুল৷ অনুষ্ঠানের দিন ভোর থেকে রাজ্য তো বটেই অন্যান্য রাজ্যের বাঙালিরা এসে ঠাই গাড়তো বসুশ্রীর সামনের ফুটপাথে৷ বাংলা বছরের প্রথম দিনে বাঙালির সেই বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো৷ ভিড়ের চাপে বন্ধ হয়ে যেত গোটা এলাকা৷ এক বছর তো উত্তম কুমারকে দেখার জন্য এমন হুড়োহুড়ি হল, বহু মানুষ চোট পেয়েছিলেন৷ এরপর থেকে সোজা গেট দিয়ে উত্তমবাবুকে আর জলসায় আনা হত না৷ এমনকী ঘোষণাও করা হত না যে তিনি আসছেন এ বার৷ খুবই সন্তর্পণে হলের পিছনের গেট দিয়ে আনা হত মহানায়ককে৷ তবু গুরুকে দেখতে চাইছেন সকলেই৷ তবে হাজার হাজার লোক হলের ভিতর ঢুকবেন কী করে? হলের সামনে রাস্তায় উপর সামিয়ানা টাঙানোর ব্যবস্থা হল৷ লাগানো হল বেশ কতগুলো মাইক৷ সেই মাইকেই তখন শোনা যাচ্ছে উত্তম কুমারের গলা৷ শোনা যাচ্ছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কিংবা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান ৷ এতেই খুশি সবাই৷
কৌলিন্যের বিচারে তখন এই জলসাই ছিল পয়লা নম্বরে৷ কত যে তাবড় তাবড় তারকা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন তা বলে শেষ করা যাবে না৷ শ্যামল মিত্র থেকে শুরু করে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন এই জলসার পরিচিত নাম৷ আর শিল্পীরাও এই অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতেন ৷ স্বর্ণযুগের শিল্পীরা এখনও এই অনুষ্ঠান নিয়ে নস্ট্যালজিয়ায় ভোগেন ৷ সে দিনগুলো স্মৃতিতে অমলিন এখনও৷
সে সময় শিল্পীদের জন্য কোনও গ্রিনরুমের ব্যবস্থা ছিল না৷ সামনের সারিতেই বসে থাকতেন সবাই৷ ডাক পড়লে স্টেজে উঠতেন৷ তখন ‘সপ্তপদী’ বেশ কিছুদিন রিলিজ হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সে সময় খ্যাতির শীর্ষে৷ মঞ্চে তখন ‘গীতশ্রী’৷ আর সামনের সারিতে স্বপ্নের নায়ক উত্তম কুমার৷ তাঁকে দেখে প্রেক্ষাগৃহে রীতিমতো গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। মন্টুবাবু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ইশারা করে বললেন, ‘‘স্টেজ থেকে এখন নেমো না৷’’ মঞ্চের উপর চুপচাপ বসে রয়েছেন সন্ধ্যাদেবী এবং রাধাকান্ত নন্দী৷ প্রায় ঠেলেই উত্তমকুমারকে স্টেজে তুলে দিলেন মন্টু বাবুরা৷
কী করতে হবে? না ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গাইতে হবে। এই রে গানের খাতা তো আননেনি মহানায়ক৷ তায় আবার অনুরোধ, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গাইতে হবে ৷ স্টেজে উঠেই উত্তম কুমার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কানে কানে বললেন, ‘‘আমার কাছে গানটা লেখা নেই৷’’ গায়িকার উত্তর, ‘‘আপনি চিন্তা করবেন না গানটা আমার লেখা আছে।’’ হারমোনিয়ামটা বাজানো শুরু করলেন সন্ধ্যাদেবী। মহানায়ক গান গাইতে শুরু করলেই প্রেক্ষাগৃহ হাততালিতে ফেঁটে পড়ছে৷ যখন ‘তুমি বলো, না তুমিই বলো’ ওই জায়গাগুলো আসছে গোটা প্রেক্ষাগৃহের দর্শক-শ্রোতারা আনন্দে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। দর্শক-শ্রোতাদের ওই উচ্ছ্বাস দেখে উত্তমবাবু এবং সন্ধ্যাদেবী রীতিমতো তখন চার্জড। গান চলল বেশ কিছু সময় ৷
এই অনুষ্ঠানে একবার এসেছিলেন লতা মঙ্গেশকরও৷ শোনা যায় মহানায়িকা সুচিত্রা সেন একবারের জন্যই এসেছিলেন বসুশ্রীতে পয়লা বৈশাখের জলসায়৷ কলকাতায় থাকলে এই অনুষ্ঠানে গান গাইতেন কিশোর কুমার৷ অনুষ্ঠানের এক্কেবারে শেষে মঞ্চে উঠতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ গাইতেন বহু গান৷ আসলে এই অনুষ্ঠানের প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনিই৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মারা যাওয়ার পর বেশ কিছু বছরের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বসুশ্রীর পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান৷ আসলে মন্টু বসু হেমন্তবাবু ছাড়া এই অনুষ্ঠান চালিয়ে নিয়ে যেতে চাননি৷
পয়লা বৈশাখের জলসা নেই বসুশ্রীতে ৷ ভাবতেই পারতেন না তখনকার তারকারা৷ মন্টু বসুও এদিনটায় প্রচণ্ড মনোকষ্টে থাকতেন৷ হঠাৎ একদিন একটা ফোন এল তাঁর কাছে৷ ‘‘দাদা এ বার পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানটা হচ্ছে তো?’’ না বলে ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে দিয়ে চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন তিনি৷ সারাটা বছর ভালো থাকলেও, পয়লা বৈশাখের দিনটায় ভীষণ কষ্ট পেতেন৷ তাঁর এই কষ্ট দেখেই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জোরাজুরিতেই ফের চালু হল বসুশ্রীর জলসা৷ অজয় বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে শুরু জলসা৷ ধীরে ধীরে সেই চেনা জৌলুস হারিয়েছে বসুশ্রীর পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান৷ তবে এখনকার তারকা এখনও এই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন৷
(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)
(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)