কোভিড-১৯ আর ট্রেনযাত্রা, এক অন্য রকম অভিজ্ঞতার কাহিনি

কোভিড-১৯ আর ট্রেনযাত্রা

কোভিড-১৯ আর ট্রেনযাত্রা যেন একটা ভয়ের পরিবেশ মনে মনে আগে থেকেই তৈরি হয়ে রয়েছে। তার মধ্যেই মানুষকে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে হচ্ছে প্রয়োজনে। তেমনই ব্যক্তিগত কারণে গুরগাঁও থেকে কলকাতা ফিরতে হওয়ায় ট্রেনের টিকিট কাটতে হয়েছিল। সেই দীর্ঘ রাস্তার ট্রেনযাত্রার অভিজ্ঞতা ঠিক কেমন শোনালেন তনয় সরকার


ঘড়িতে তখন দুপুর ১২টা। ক্যালেন্ডার বলছে ১৭ জুলাই, ২০২০। নয়াদিল্লি স্টেশন থেকে হাওড়া আসার জন্য রাজধানী এক্সপ্রেসের সময়সূচি বিকেল ৪টে ৫৫। পথে ট্রাফিক জ্যাম হতে পারে, কিংবা লকডাউনের জন্য গুরগাঁও-দিল্লি সীমানায় চেকিং হতে পারে। তাই হাতে প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম নয়াদিল্লি স্টেশনে আসার উদ্দেশে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে বসে জলের বোতল থেকে এক ঢোক জল খাওয়ামাত্রই মনে হল, সব কিছু ঠিকঠাক নিয়েছি তো? ল্যাপটপের ব্যাগ, জামাকাপড়ের ট্রলি, আগে থেকে রান্না করে রাখা খাবারের ব্যাগ… আর হ্যাঁ স্যানিটাইজারের বোতল, ফেস শিল্ড, গ্লাভস এবং হেড ক্যাপ— এইগুলো তো সবার আগে পিঠের ব্যাগে ভরে নিয়েছি। না হলে যে উপায় নেই। কারণ এগুলো ছাড়া ট্রেনে উঠতেই দেবে না।

সম্প্রতি কিছু পারিবারিক কারণের জন্য নিজের শহরে ফিরেছি। পেশাগত সূত্রে বিগত কয়েক বছর ধরে আমি ভিন্‌রাজ্যের বাসিন্দা। আগে থাকতাম রাজস্থানের জয়পুরে আর এখন হরিয়ানার গুরগাঁওতে। গাড়ি থেকে নামার পরে নয়াদিল্লি স্টেশনে আসার পূর্ব অভিজ্ঞতাগুলো কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। স্টেশনে ঢোকার আগে সিটিং এরিয়া পুরোপুরো সিল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর হাতে, পিঠে এবং কাঁধে ব্যাগের বোঝা। রংবাহারি মাস্কের আড়ালে ঢেকে রাখা মুখগুলো থেকে থেকে পকেটে রাখা স্যানিটাইজার বার করে নিজেদের শরীরে দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাগেও স্প্রে করছেন।

তাঁদের দেখাদেখি আমিও করতে শুরু করলাম। মেন বিল্ডিং দিয়ে স্টেশনের ভেতরে ঢোকার জন্য মাত্র একটাই গেট খোলা, যার মুখে এক রেলকর্মী হাতে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে সবার শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করছেন। সবার মতো আমিও থার্মাল স্ক্যানিং টেস্টে ঠাকুর ঠাকুর করে উতরে যাওয়ার পরে ভেতরে ঢুকেই ল্যাগেজ স্ক্যান করে সোজা হাঁটা লাগলাম ৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৪ ঘণ্টা আগে স্টেশনে হাজির, তাই ফুটব্রিজের পাদানিতে বসে থাকা থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। তবে পুরো সময়টাই মাস্ক পরে থাকার জন্য শ্বাস নিতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। শুধু তাই নয়, গ্লাভস পরার জন্যও হাতের তালুতে ঘাম জমে চুলকাচ্ছে। বাধ্য হয়েই ক্ষণিকের জন্য খুলে ফেলি হাতের গ্লাভস আর মুখের মাস্ক।


আরও ফিচার পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে

নির্ধারিত সময়ের প্রায় দু’ঘণ্টা আগে স্টেশনে হাজির নয়াদিল্লি হাওড়া স্পেশাল এক্সপ্রেস (০২৩০২)। ফুটব্রিজের একদম সামনেই এ-ওয়ান কামরা, তাই লাগেজের বোঝা নিয়ে খুব ঝক্কি পোহাতে হয়নি। তবে সেই ট্রেনে সহযাত্রীদের দেখে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। কারণ, বেশির ভাগ যাত্রীর পরনে ছিল পিপিই কিট, হাতে লাগেজের সঙ্গে ছিল ৫ লিটারের স্যানিটাইজার জার। কেউ কেউ তো আবার ছোট বালতিতে স্যানিটাইজার ঢেলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে সিট পরিষ্কার করেছেন। এই ছবি দেখার পরে মনে হয়েছিল, এঁরাই একমাত্র বাঁচবেন। আমার আর কোনও সুযোগ নেই। অবাক এবং হাসি মিলিয়ে মিশিয়ে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন।

কোভিড সংক্রমণের জন্য আজকাল ট্রেনে বালিশ, বেড শিট, তোয়ালে— কিছুই দেওয়া হচ্ছে না, এমনকি জানলাতে পর্দাও না। কয়েকটা মাস আগে পর্যন্ত দূরপাল্লার ট্রেন মানেই, যাত্রাপথে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ ছিল। মনোভাব মিলে গেলে অনেক সময় রাত জেগে আড্ডাও হত। খাবার নিয়ে যেতে না পারলে রেলের প্যান্ট্রি কারের ভরসায় নিশ্চিন্তে ট্র্যাভেল করতে পারতাম। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ ছবিটাই ৩৬০ ডিগ্রি বদলে গেছে। খাবার সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ। নেই সকালের জলখাবার কিংবা বিকেলের টিফিন। এমনকি রেল মন্ত্রকের নির্দেশে চা এবং জলের বোতলটাও দেওয়া হচ্ছে না। অথচ ট্রেনের ভিতর পাওয়া যাচ্ছে সবই। আপনাকে গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে কিনতে হবে সব কিছুই। অবাক লাগল যখন আইআরসিটির এক কর্মী কানের কাছে এসে হাঁক দিলেন, স্যানিটাইজার চাই? এই সব বিষয়ে আগে থেকে ওয়াকিবহাল ছিলাম, তাই রওনা হওয়ার আগে বিভিন্ন স্নাক্স, শুকনো ফল, ম্যাগি, ডিম সেদ্ধ, চকোলেটের পাশাপাশি পর্যাপ্ত জল মজুত করেছিলাম নিজের ব্যাগে।

ট্রেনে পাশের মানুষদের অতি সতর্কতামূলক আচরণগুলো দেখার পরে এক ঘণ্টা অন্তর অন্তর বসার জায়গা, ব্যাগ, জুতো, নিজের হাত, পা— এমনকি পড়ে থাকা পোশাকেও স্যানিটাইজার স্প্রে করেছি। আমার এক চিকিৎসক বন্ধুর পরামর্শ ছিল, ট্রেনে ওঠার পর থেকে নামার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত স্যানিটাইজার স্প্রে করতেই হবে। সঙ্গে হ্যান্ড গ্লাভস, হেড ক্যাপ এবং মাস্ক পরে থাকা আবশ্যিক। যথারীতি এই সব সুরক্ষাবিধি পালন করতে গিয়ে রাতের ঘুমটা ভাল হয়নি।

এমনিতেই ভয়ে লোকজন নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল, তবে সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ করেই আমরা সবাই রে রে হালকা চেঁচিয়ে উঠি। কারণটা হচ্ছে, ট্রেন তখন প্রয়াগরাজ স্টেশন সবে মাত্র ছেড়েছে। ঘড়িতে তখন রাত ১২টা ছুঁইছুঁই। এমন সময় আমার সামনের আপার বার্থের এক ভদ্রলোকের আপন মনে গড়গড় করে নাকে সুখ টান সবার ঘুম ভাঙাল। তার পরের ঘটনা কারওরই অজানা নয়। প্রায় ১৭ ঘণ্টার ট্রেন যাত্রায় এই একটাই মুহূর্ত ছিল, যেখানে আমরা সবাই একটু হেসেছিলাম। বাকি পুরোটাই কেটেছে স্যানিটাইজারের গন্ধে।

যাত্রী সুরক্ষা এবং নিরাপত্তাসূচক বিষয়টি আগের মতোই আছে। নিয়মিত অত্যাধুনিক বন্দুকধারীদের ভারী বুটের আওয়াজ আপনাকে আস্বস্ত করবে। সকাল ১০টা ২০ মিনিট নাগাদ হাওড়া পৌঁছনোমাত্র বড্ড কষ্ট হচ্ছিল আমার প্রাণের শহরের ব্যস্ততম রেলওয়ে স্টেশনটিকে খুঁজে পেতে। চার দিকে শুধুই পিপিই কিট পরা সাদা পোশাকের স্বাস্থ্যকর্মী। কোভিড সংক্রমণের ভয়ে রেলযাত্রার চিরাচরিত ঐতিহ্যের বদল বড়ই প্রাসঙ্গিক। তবে, আশ্চর্যও বটে। এই অভিজ্ঞতা আর পাঁচটা রেলযাত্রার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যা কোনও দিনও ভোলার নয়। তবে এই কাহিনি তোলা থাকল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, ভাইরাস-আক্রান্ত পৃথিবীর চেনা ছবি বদলে যাওয়ার জ্বলন্ত দলিল হিসেবে।

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)