জর্জ ফ্লয়েড ও আমেরিকার নতুন জনবিপ্লব, কী বলছে গোটা দেশ

জর্জ ফ্লয়েড

জর্জ ফ্লয়েড কোভিড-১৯ অতিমারির মধ্যেই আমেরিকায় বিপ্লব তৈরি করেছেন, আসলে বিপ্লবটা নিয়ে এসেছে ১৭ বছরের এক স্কুল ছাত্রী তার অদম্য সাহস দিয়ে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার ভিডিও নিজের ফোনে ধরে রেখে। একদিকে করোনাভাইরাসে  লক্ষাধিক মৃত্যু তার উপর কৃষ্ণাঙ্গ খুন নিয়ে তোলপাড় গোটা দেশ, ব্রুকলিনে বসে সেই অনুভূতির কথাই লিখলেন ড: পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


কোভিড-১৯-এর সঙ্কট আমেরিকায় আজ পর্যন্ত ১ লক্ষ ১৫ হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মানুষ কেবলমাত্র নিউ ইয়র্কেই শেষ হয়ে গিয়েছে গত দু’তিন মাসে। এ এক অবিশ্বাস্য এবং ইতিহাসে নাম তুলিয়ে ফেলা বিষয়।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম যতই এই বিভীষিকাকে শুধুমাত্র একটা ক্রমবর্ধমান সংখ্যা হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করুক না কেন, আর আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমে যতই এই ভয়াবহ ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, বাস্তব তবু বাস্তবই থেকে যাবে। ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পৃথিবীর মহাপরাক্রমশালী দেশে ২০২০-র মার্চ থেকে মে কিংবা জুন— এই দু’তিন মাসে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ইতিহাসে এটাও লেখা থাকবে, সে দেশের শাসকশ্রেণি তাঁদের বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছিল।

এ সব মানুষের নাম সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি। কেবলমাত্র ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ তাদের এক দিনের কাগজের প্রথম পাতায় প্রতীকী হিসেবে কয়েক’শো মানুষের নামের তালিকা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু টিভিতে এ সব মানুষের নাম কখনও আসেনি। ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার এক যুগ পরেও প্রতি বছর ওই দিনে মার্কিন সংবাদমাধ্যম, শাসকযন্ত্র এবং এলিট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ঘটা করে নিহত ব্যক্তিদের নাম উচ্চারণ করেন। বেদনার সুর বাজে ব্যাকগ্রাউন্ডে। মিলিটারি স্যালুট জানানো হয়। ওই দিনে নিহত প্রায় তিন হাজার মানুষের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে আসা হয়ে বিশেষ আমন্ত্রণে নিউ ইয়র্কের গ্রাউন্ড জিরোতে। ঘরে ঘরে আমেরিকানরা তাদের হাজার কাজের মধ্যেও ওই দিনটিকে জাতীয় শোকপ্রকাশের দিন হিসেবেই স্মরণ করে থাকে। করাই উচিৎ।

কিন্তু করোনাভাইরাসে মৃত এই লক্ষাধিক নিরীহ মানুষের নাম কখনও কোথাও পাঠ করে শোনানো হবে না। তাদের পরিবারের কারওকে টিভিতেও দেখানো হবে না। এবং সবচেয়ে বড় কথা, কোন নিষ্ঠুর, অমানবিক, দানবীয় আর্থ-সমাজব্যবস্থার বলি হল এই অবিশ্বাস্য সংখ্যার মানুষ— সে আলোচনা-বিশ্লেষণ কোথাও তেমন করা হবে না। এই মহাসঙ্কট আস্তে আস্তে এক বার কেটে গেলেই আমেরিকার মানুষ ও বাকি পৃথিবী আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাদের সাবেক, দৈনন্দিন জীবনে।

এই ভয়ঙ্কর স্মৃতি মানুষের মন থেকে ক্রমে মুছে যাবে। মুছে দেওয়া হবে।

একটু একটু করে আতঙ্ক দূর হচ্ছে হয়তো। একটু একটু করে মানুষের মুখে হাসি, আশার আলো ফিরে আসছে। কিন্তু মানবসভ্যতা যে সম্মিলিত জীবনযাত্রা, সমাজ, একসঙ্গে ওঠাবসার বহু হাজার বছরের জীবনপদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত, সে পদ্ধতি আবার ঠিক আগের মতো কখনও হবে কি না, বলা যায় না।

প্রথাগত স্কুল-কলেজ-ট্রেনিং সেন্টার সব কিছুই অনলাইন, ভার্চুয়াল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স চালিত হতে চলেছে। ছোট ছোট বাজার, সেলুন, রেস্তোরাঁ, পার্লার, জামাকাপড়ের দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আস্তে আস্তে সব কিছুই জায়গা ছেড়ে দেবে বিশাল কর্পোরেশনগুলোর হাতে। ইতিহাসের প্রথম পর্ব থেকে মানুষ যে ভাবে তার সভ্যতা আর জীবনদর্শন গড়ে তুলেছে, আমার ধারণা, তা একেবারেই বদলে যাবে, যদি না মানুষ একেবারে যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নতুন, অন্যতর সমাজ ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের উপর নির্মম পুলিশি অত্যাচার এবং হত্যা আমেরিকার মানুষের বিবেককে আর এক বার ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে গিয়েছে। আমেরিকা আর একবার ফুঁসে উঠেছে। জনসমুদ্র গর্জে উঠেছে আমেরিকার শাসকশ্রেণি এবং তার বর্ণবিদ্বেষী পুলিশি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই ঘটনা আমেরিকার সাম্প্রতিক যুগের এক প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা। এই জনবিক্ষোভকে যদি অহিংস বিপ্লব না বলি, তা হলে আর কাকে বলব?

আজ আমেরিকার ক্রান্তিকাল। এক দিকে করোনাভাইরাসে ১ লক্ষেরও বেশি নির্দোষ সাধারণ মানুষের মৃত্যু, চার কোটিরও বেশি লোকের রাতারাতি কাজকর্ম ব্যবসা দোকান রুজি শেষ হয়ে যাওয়া, আর এখন দেশ জুড়ে ইয়ং আমেরিকানদের বর্ণবিদ্বেষ ও পুলিশি বর্বরতা-বিরোধী আন্দোলন— এই লকডাউনের মধ্যেও, আমেরিকার শাসকশ্রেণির আসল কুৎসিত ভয়াল চেহারাটা উলঙ্গ করে দিয়েছে।

১৭ বছরের হাইস্কুল ছাত্রী কৃষ্ণাঙ্গী ডার্নেলা ফ্রেজিয়ার যদি অপরিসীম সাহস বুকে নিয়ে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সেই ৯ মিনিট ধরে তুলে না রাখতেন এবং ছড়িয়ে না দিতেন, এই বিশাল জনসমুদ্র আজ আমরা দেখতে পেতাম কি?

এই সাহসী নাগরিক সাংবাদিকতাই ভবিষ্যৎ। এই নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাই আমাদের আশার আলো।

(আরও ফিচারের জন্য ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)

জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)