Batakrishna Pal Bari দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে

Batakrishna Pal Bari

সম্প্রীতি দত্ত: উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে লুকিয়ে রয়েছে বহু জানা অজানা বনেদী বাড়ি। তেমনই একটি শোভাবাজারে অবস্থিত বটকৃষ্ণ পাল বাড়ি (Batakrishna Pal Bari)। পাল বাড়ির আদিনিবাস ছিল হাওড়া শিবপুরে। ১৮৩৫ সালে গন্ধবনিক পরিবারে বটকৃষ্ণ পাল জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা লক্ষ্মী নারায়ণ পাল ছিলেন সুগন্ধি দ্রব্য ও মশলা ব্যবসায়ী। সেই আদিনিবাস ছেড়ে শোভাবাজার আসার কারণটা কী?

ছোটবেলায় বটকৃষ্ণের বাবা-মা প্রয়াত হওয়ায় তাঁর পড়াশোনা বেশি দূর হয়নি। কলকাতায় মামার বাড়িতে চলে আসেন এবং মামা রামকুমার দে-র কাছেই বড় হতে থাকেন। ক্রমশ মামার মশলার ব্যবসায় ঢুকে পড়েন। মাত্র ১৬ বছরেই মামার ব্যবসায় তাঁর হাত ধরে উন্নতি হতে শুরু করে। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি কলকাতার বড়বাজারের খ্যাংড়াপট্টিতে মাধবচন্দ্রের সঙ্গে অংশিদারীতে ব্যবসা শুরু করেন। তেলের কুপি, মশলা ছাড়াও তাঁর দোকানে পাওয়া যেত অ্যালোপ্যাথি ওষুধ, যা  সে সময় খুব সহজে অন্য কোথাও পাওয়া যেত না।

১৮৫৫ সালে ‘বটকৃষ্ণ পাল এন্ড কোম্পানি’ নামে খুলে ফেলেন ব্রিটিশ কলকাতার প্রথম অ্যালোপ্যাথি ওষুধের দোকান। সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁর ব্যবসার উন্নতি হতে থাকে এবং আরও সাতটি জায়গায় তিনি এই ব্যবসা শুরু করেন। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক ছাড়াও দন্ত চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসার বিভিন্ন সরঞ্জামও পাওয়া যেত সেখানে। ধীরে ধীরে তাঁর ‘বটকৃষ্ণ পাল এন্ড কোম্পানি’-এর খ্যাতিও চারিদিকে ছড়িয়ে পরে।

 

Batakrishna Pal Bari

এই সেই ওষুধের দোকান

১৮৮৭ সালে সেকেন্দ্রাবাদ ডিভিশনের সহকারি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ভারতে এসেছিলেন এডওয়ার্ড স্ট্যানলি। ওষুধ নিয়ে গবেষণা করতে ভালবাসতেন তিনি আর সে কারণেই বটকৃষ্ণ পালের দোকানে যাতায়াত ছিল তাঁর। সেই সময় জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল। স্ট্যানলি নিজের ফর্মূলায় তৈরি এমনি একটি ওষুধের কথা বটকৃষ্ণকে বলতেই তা এডওয়ার্ড টনিক নাম দিয়ে বিক্রি শুরু হয়। যা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল সে সময়।

এই ওষুধের দোকানের ঝুলতে থাকা বড় ঘণ্টাযি আজও বয়ে নিয়ে চলেছে সেই সময়ের ইতিহাস। বাড়ির একতলাতেই ছিল ওষুধের দোকান। সাধারণ মানুষ যাতে বেশি রাতে বিপদে- আপদে ওষুধ পায় তার জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাতে দোকান বন্ধ করে দেওয়া হত। কিন্তু দরকারে কী করে জানানো হবে? সেই ভাবনা থেকেই এই ঘণ্টার আবিষ্কার। এই ঘন্টার আওয়াজ বাড়ির অন্দরমহলে তিনতলা পর্যন্ত শোনা যেত। কারও মধ্যরাতে ওষুধের দরকার হলে বাইরে এসে ঘণ্টা বাজালেই বাড়ির ভিতরে থাকা লোকেরা টের পেতেন এবং বেরিয়ে এসে ওষুধ দিতে পারতেন। এছাড়াও ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবীদের ঘাঁটি ছিল এই পাল বাড়ি। ব্রিটিশদের হাত থেকে তাঁদের বাঁচানোর জন্য বিশাল এই বাড়িতে তাঁদের লুকিয়ে রাখার বন্দোবস্ত ছিল। সুযোগ বুঝে তাঁদের পালাতে সাহায্য করা হত। এমনকি বোমা তৈরির সরঞ্জামও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সরবরাহ করা হত এই ওষুধের দোকান থেকেই। এছাড়া রয়েছে ব্রিটিশ আমলের একটি গাড়ি যা এখনও ভিন্টেজ কার র‍্যালিতে অংশ নেয়।

যে ঘণ্টা লাগানো হয়েছিল দোকানে

এই বাড়িতে যেতে গেলে পৌঁছতে হবে শোভাবাজার। সেখান থেকে বাজার হয়ে হাটখোলা পোস্ট অফিস আর এখান থেকেই দু-মিনিট সোজা হাটলেই দেখতে পাওয়া যাবে সেই পুরনো দোকান আর বটকৃষ্ণ পালের এই বিশাল তিনতলা বাড়ি। যা অসাধারণ কারুকার্য, নকশায় সাজানো। আধুনিক ওষুধ আসার সঙ্গে সঙ্গে এই দোকানের চাহিদাও কমে গিয়েছে। কিন্তু তাতে পাল বাড়ির ঐতিহ্যের বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো যেমন বিখ্যাত তেমনই বিখ্যাত পাল বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো। পাল বাড়ির নাচ-গানের আসর বসার ঘর আজও অটুট। তবে বাইরে থেকে আর কেউ আসেন না বরং বিশেষ বিশেষ দিনে পরিবারের লোকেরাই আসর জমান। যা হয়ে এসেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এই মুহূর্তে বাড়ির দায়িত্বে পালেদের পঞ্চম প্রজন্ম।

১৯১৪ সালের ১২ জুন প্রয়াত হন তিনি। তখনও ভারত শাসন করছে ব্রিটিশরা। তাঁর নামে শোভাবাজারে রয়েছে বিকে পাল এভিনিউ। ব্রিটিশ শাসিত কলকাতায় আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন বটকৃষ্ণ পাল। ওষুধের ব্যবসা যেভাবে দেশ-বিদেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চালাতেন তেমনই গোপনে চালিয়ে গিয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলন। সামনে এসে কখনও তিনি লড়াই করেননি তাই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকায় তাঁর নাম নেওয়া হয় না। নেপথ্যে থেকে শুধু বাড়িয়ে গিয়েছেন সাহায্যের হাত। যা টেরও পায়নি ইংরেজরা। তিনি বটকৃষ্ণ পাল, পাল বাড়ির প্রাণ পুরুষ। যা আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে।

ছবি—লেখক

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle