নিউ ইয়র্ক করোনায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ, দীর্ঘদিন ধরে এই ব্রুকলিনেই বাস, পৃথিবীকে এভাবে বদলে যেতে অতীতে কখনও দেখেননি। জীবনের অনেক ওঠাপড়ার মধ্যেও স্বস্তি ছিল কিন্তু করোনাভাইরাসের আক্রমণে যখন মৃত্যু নগরীতে পরিনত হল নিউইয়র্ক তখন বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল এটাই সেই চেনা শহর, ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক থেকে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন মুক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিউ ইয়র্ক আমেরিকার এক নম্বর শহর। এখানে সারা পৃথিবীর লোক থাকে। এই শহরে আমরা গত ২০ বছর ধরে আছি। এর আগে বিভিন্ন ছোট ছোট শহরে আমরা ছিলাম। নিউ ইয়র্কের সঙ্গে আমাদের ভারতের বড় বড় শহরের বেশ মিল। এখানে যেমন খুব বড়লোক থাকে, আবার গরিবস্য গরিবরাও জীবন কাটাতে পারে। করোনাভাইরাসের শুরু থেকে আমরা এর মধ্যে দিয়ে গেলাম। জীবনে কোনও দিন এ রকম অভিজ্ঞতা হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। আর যেন কখনও না হয়!
মার্চের প্রথমে আমার স্বামী পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দেশ থেকে ফিরে এল, তখন নিউ ইয়র্কের এয়ারপোর্টে কোনও রকম সাবধানতা অবলম্বন করা হয়নি। সবাই কোনও রকম টেস্টিং ছাড়াই এই দেশে ঢুকে গিয়েছে। এ দেশের প্রেসিডেন্ট সবাইকে বুঝিয়েছেন যে, এটা অন্য ফ্লুয়ের মতো আর একটা রোগ। ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন (হু)-এর সতর্কতা কানে তোলেনি এই দেশ। মিডিয়াতে কোনও বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হয়নি। আর নিউ ইয়র্ক যে হেতু সব থেকে বড় শহর, সারা পৃথিবী থেকে এখানে লোকেদের আগমন, ফলে এখানেই সব থেকে বেশি মানুষ বাইরে থেকে ঢুকে পড়েছেন। এ ছাড়া এখানকার মানুষকে অবহিতও করা হয়নি এই রোগের ব্যাপারে।
সুনসান নিউইয়র্কের রাস্তা
ওই যে বললাম, এই শহরে খুব গরিব মানুষও থাকেন। অনেক জায়গা এখানে আছে যেখানে হিস্পানিকরা থাকেন শুধু। তাঁরা ইংরেজি বলতে বা বুঝতে পারেন না। ওখানে স্প্যানিশ জানেন যাঁরা সে রকম সোশ্যাল ওয়ার্কাররা গিয়ে গিয়ে সে রকম ভাবে কাজ করেননি। তা ছাড়া ওঁদের থাকবার জায়গাগুলো অস্বাস্থ্যকর। একটা ঘরে অনেকে মিলে থাকেন। তাই ওঁদের মধ্যে অনেক তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে গিয়েছে করোনাভাইরাস। কোনও স্প্যানিশ দিদিমা হয়তো পার্কে তাঁর নাতনিকে নিয়ে যাচ্ছেন, অথচ তিনি জানেনই না যে, এই শহরে এখন কী চলছে!
আবার আফ্ৰিকান-আমেরিকান গরিব লোকেদের অনেক প্রাণ চলে গিয়েছে। তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা এত করুণ যে, তাঁরা ভাল করে খাবার থেকে পুষ্টি পান না। তাঁরা ভাল স্কুল যেতে পারেন না। অল্প জায়গায় সবাই ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকেন। খুবই মর্মান্তিক ভাবে এদের প্রাণ চলে গিয়েছে।
আমি এখানে ‘ব্রুকলিন ফর পিস’ নামে একটা সোশ্যাল জাস্টিস অ্যান্ড পিস মুভমেন্ট অর্গানিজশনের বোর্ডে আছি। আমাদের জুম-এ মিটিং হয়েছে অনেক বার। কী ভাবে এই সব জায়গায় লোকেদের সাহায্য করা যায়— সে ব্যাপারে অনেক আলোচনা হয়েছে। এখানে এসেনশিয়াল ওয়ার্কারদের বাধ্যতামূলক ভাবে কাজে যেতে হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত এই আফ্ৰিকান-আমেরিকান আর হিস্পানিক লোকেদের বেশির ভাগই এসেনশিয়াল ওয়ার্কারদের মধ্যে পড়েন। তাঁরা কেউ অনলাইনে কাজ করতে পারেননি। তাঁদের বাড়ি থেকে বেরোতেই হয়েছে। আমার জানা একটা মিটিংয়ে এক জন আফ্ৰিকান-আমেরিকান, আর সবাই সাদা মহিলা ছিলেন। সবাইকে যখন জিজ্ঞেস করা হল যে, তাঁদের পরিবারের কেউ আক্রান্ত হয়েছে কি না, সবাই না বললেন। কিন্তু ওই আফ্ৰিকান-আমেরিকান মহিলা বললেন যে, তাঁর পরিবারে পাঁচ জন মারা গিয়েছে। এখানকার সরকার এই সব দরিদ্র লোকেদের জন্য কখনওই সে ভাবে চিন্তা ভাবনা করেনি। ফলে তাঁদের জীবনযাপন এতটাই দারিদ্রের মধ্যে কাটে যে, তাঁদের ভগ্ন স্বাস্থ্য, অশিক্ষার ফলে তাঁরা আরও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েন এই সব সময়ে।
এভাবেই নামের তালিকা দিয়ে মৃতদের শ্রদ্ধা জানিয়েছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস
আমরা এখানে ব্রুকলিন শহরের মাঝখানের দিকে থাকি। এই শহরের অনেক এলাকায় খুব গরিবরা থাকেন। মাঝ মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত সারা রাত অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেনের আওয়াজে আমরা ঘুমোতে পারিনি। অনেকেই এক বার ভেন্টিলেটরে ঢুকলে আর সেখান থেকে বেরোতে পারেননি। সরকার নার্সদের জন্য উপযুক্ত গাউন বা মাস্ক দিতে পারেনি। তাঁরা গার্বেজ ব্যাগ পরে রোগীদের সাহায্য করেছেন নিজেদের জীবন বিপন্ন করে।
আমাদের বাড়ির কাছে অনেক বাংলাদেশি দোকান আছে। আমার এখনও মনে আছে, প্রথম যে দিন আমার এক পরিচিতের দোকানে ঢুকেছিলাম, কী ভয়ানক আতঙ্ক দেখেছিলাম, ওই দোকানের মালিক রাসেল ভাইয়ের মুখে। আমায় বললেন, ‘‘আপু, জানি না কী অপরাধ আমরা করলাম যে, আল্লা আমাদের এই রকম শাস্তি দিলেন। এই সব ছোট ছোট দোকানগুলো সব শেষ হয়ে যাবে। বড় বড় অনলাইন কর্পোরেশন, অ্যামাজন— এই সব থেকেই লোকেরা অর্ডার দেবে।’’
জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)
এই সব বাংলাদেশি মানুষদের অনেকেই খুব গরিব। তাঁদের অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় সামান্য কিছু রোজগারের জন্য। তাঁদের পুষ্টির অভাব, তাঁরা যেখানে থাকেন সেই সব জায়গা খুবই অস্বাস্থ্যকর। ফলে তাদের শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা খুব কম। আমাদের এই নিউ ইয়র্কেই দুশোর বেশি বাংলাদেশি লোক মারা গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু জনকে আমরা চিনতাম।
আমেরিকায় অনেক ‘ওল্ড এজ’ নার্সিংহোম আছে। এ দেশে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের তাঁদের ছেলেমেয়েরা নিজেদের কাছে রাখতে চান না। আর মা-বাবারাও ছেলেমেয়েদের উপর বোঝা হয়ে থাকতে চান না। এই সব নার্সিংহোমগুলোতে খুব বেশি সংক্রমণ হয়েছে। এঁরা প্রত্যেকেই খুব দুর্বল স্বাস্থ্যের, আর এত সংক্রমিত রোগ বলে এক জন থেকে আর এক জনের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে গিয়েছে। আমি এমনও শুনেছি যে, নার্সিংহোম থেকে বাড়িতে খবর দিলে ছেলেমেয়েরা তাঁদের বাবা-মাকে নিয়েও যাননি। তাঁরা ওখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এখানকার মর্গে মৃতদেহ রাখবার জায়গা হয়নি। আলাদা করে রেফ্রিজারেটর ট্রাকে সব মৃতদেহ রাখা হয়েছে। তার পর গণ কবর দেওয়া হয়েছে। তাঁদের পরিজনদের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। ফেস টাইমের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের বাবা-মাকে বিদায় জানিয়েছেন।
(আরও ফিচারের জন্য ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)
আমেরিকার মতো এত ধনী দেশে প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার লোক মারা গেলেন। আমাদের নিউ ইয়র্কে ২০ হাজারের মতো লোকের মৃত্যু হল, যাঁরা দু’মাস আগেও ভাবতে পারেননি যে, তাঁদের জীবন কিছু দিনের মধ্যেই চলে যাবে। আমরা রোজ চোখের সামনে দেখলাম, ক্রমশ মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি অ্যাম্বুল্যান্সের আওয়াজে। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, জীবনে কোনও দিন যে এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, কল্পনাও করতে পারিনি। মেনস্ট্রিম মিডিয়া শুধু মৃত্যু সংখ্যা বলেছে, কিন্তু কোনও গরিবদের, হতভাগ্যদের ছবি দেখায়নি। তাঁরা কী অবস্থার মধ্যে থাকেন, সে সব নিয়েও কোনও আলোচনা হয়নি। কেন গরিবদের, হতভাগ্যদের শুধু মরতে হবে আর সরকার আগে থেকে কোনও ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করেনি, তার জন্য এদের মাশুল দিতে হয়েছে। এই সব ব্যাপারে কোনও কথা টিভিতে শুনিনি। এই ঘটনা থেকে আমরা যদি কোনও শিক্ষা গ্রহণ না করি, আমরা যদি পরিবেশ সচেতন না হই, আবার আমাদের এর মুখোমুখি হতে হবে। চূড়ান্ত পুঁজিসর্বস্ব জীবন আর ধনী দরিদ্রের ব্যবধান না ঘোচালে এর থেকে মুক্তি নেই।
মানুষ কবে যে আবার সহজ করে কোনও ভয়ভীতি ছাড়াই সবার সঙ্গে মিশতে পারবে সেটার অপেক্ষায় আছি।