দিল্লি ফের স্বমহিমায়, কোভিডের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে জনারণ্য মল-রেস্তরাঁয়

দিল্লি ফের স্বমহিমায়দিল্লি ফের স্বমহিমায়। কেনাকাটার ভিড় সরোজিনিনগর মার্কেটে।

জাস্ট দুনিয়া ব্যুরো: দিল্লি ফের স্বমহিমায়, অথচ এই তো কয়েক সপ্তাহ আগেই রাজধানীর শ্মশানগুলোয় দিন-রাতভর ব্যস্ত থাকত। কোভিড-মৃতদের শেষকৃত্যের কারণে। কিন্তু এখন, শপিং মল, রেস্তরাঁ, বাজার, মার্কেট ফের নাড়াচাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে। ফলে দিল্লি ফের স্বমহিমায় এবং কোভিডের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলেই।

তবে, চিকিৎসকেরা কিন্তু ভয়ানক দুশ্চিন্তায়। তাঁদের আশঙ্কা, ফের কোভিড-ঝড় উঠবে। এবং সেটা খুব শীঘ্রই। ঠিক যেমন ভাবে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বোঝা যায়নি এপ্রিল-মে মাসে কোন ভয়াবহতা অপেক্ষা করে আছে! স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ। চিকিৎসকদের মতে, এই সময়টাও ঠিক ঝড় ওঠার আগের পরিস্থিতি, সব কিছু থমকে রয়েছে।

হাতে সদ্য কেনা জামাকাপড় ভর্তি ব্যাগ। সদ্য বিবাহিত বরকে নিয়ে দিল্লির ব্যস্ত সিলেক্ট সিটি ওয়াক মলে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন সুরিলি গুপ্ত। ওই তরুণীর কথায়, ‘‘ঘরে বন্দি অবস্থায় কাটাতে কাটাতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। এই বেরনোটা আমার জন্য ভীষণ দরকার ছিল। কত দিন আপনি ঘরে বন্দি দশা কাটাতে পারবেন?’’ সুরিলি পেশায় সেলস এগ্‌জিকিউটিভ। কেনাকাটার পর মলের ভিড়ে ঠাসা ফুড হলে টেবিলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বছর পঁচিশের ওই তরুণী।

সুরিলির পিছনেই সপ্তাহান্তে বাইরে বেরনো একটা বড়সড় ভিড় চিৎকার করছে, হাসিঠাট্টা করছে, চাইনিজ নুডল্‌স আর ডোসা নিয়ে আনন্দে মশগুল। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলার পরামর্শটুকুও তাঁদের কানে গিয়ে পৌঁছচ্ছে না। জনপ্রিয় কোম্পানির বার্গারের দোকানের সামনে যে বিশাল লাইন, সেখানে এক দম্পতিকে দেখা গেল— মাস্ক ঝুলছে থুতনির কাছে। লাইনে দাঁড়ানো বেশির ভাগেরই মুখে নেই মাস্ক। হয় হাতে, নয় তো গলার কাছে বা থুতনিতে ঝুলছে।

মলকর্মীরা দায়সারা ভাবে আগতদের শরীরের তাপমাত্রা মাপছেন। বলতে হয় তাই যেন বলছেন, ‘‘হাতে স্যানিটাইজার দিন।’’ কিন্তু কে দিলেন বা কারা দিলেন না সে দিকে বিশেষ কোনও লক্ষ নেই মলকর্মীদের।

সিলেক্ট সিটি ওয়াক মল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। লাজপতনগর মার্কেটেও খোলা আকাশের নীচে জমে যাওয়া দোকানে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়। স্কার্ভস, বালা বা সস্তার প্রসাধন কেনাকাটায় চলছে রীতিমতো দরদাম। খাবার দোকানও রয়েছে। কুলচে-ছোলে, রুটির সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে মশলা ছোলা। এ ছাড়াও নানাবিধ খাবার। খাদ্যরসিকের ভিড় চোখে পড়ার মতো। আর খাওয়ার সময় কে-ই বা মাস্ক পরেন। যিনি খাবার কাচ্ছেন, তাঁর হাতেও ঝুলছে মাস্ক। যিনি অর্ডার করেছেন বা দামপত্র জিজ্ঞাসা করছেন, তাঁরও একই হাল।

‘‘আমার আজ আসার কথা ছিল না। কিন্তু এমন জরুরি হয়ে গেল আসাটা, যে না বেরিয়ে পারলাম না,’’— বছর একুশের প্রেরণা জৈন এমনটাই বললেন। কলেজে পড়েন প্রেরণা। মায়ের সঙ্গে এই মার্কেটে এসেছেন। কেন? প্রেরণার কথায়, ‘‘আমারতুতো ভাইয়ের বিয়ে। তাই কিছু কেনাকাটার প্রয়োজন পড়ে গেল। আমি জানি, এই বেরনোটা এখনও পর্যন্ত খুব নিরাপদ নয়। কিন্তু কী করতে পারতাম! এটাও তো একই রকম ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।’’

দিল্লিতে ২ কোটি লোকের বাস। গত এপ্রিল-মে মাসে ভয়াবহ দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছে এই দিল্লি। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা আকাশছোঁয়া হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। আর মৃত্যু! শ্মশানগুলোতে জায়গা ছিল না। দিবারাত্র জ্বলছে। দেহ পুড়ছে। হাসপাতালের বাইরেই কত মানুষের অসহায়-মৃত্যু হয়েছে। অক্সিজেন নেই। হাসপাতালে বেড নেই। ওষুধ নেই। মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছিল। করোনা ভাইরাসের নতুন স্ট্রেনকে যেমন দোষারোপ করা হচ্ছিল, তেমনই সরকারের দিকেও গাফিলতির আঙুল উঠছিল ধর্মীয় নানা আচরণে ছাড় দেওয়ায়। খেলাধুলোর জায়গা, শপিং মল, পার্কের মতো জনসমাগমের জায়গাগুলোকে লাগামছাড়া ভাবে খুলে দেওয়ায়।

কয়েক সপ্তাহ আগে, এ ভাবেই গণচিতা সাজানো হচ্ছিল দিল্লিতে।

আবার করোনার তীব্রতা কমেছে রাজধানীতে। সরকার লকডাউনের বিধিনিষেধ শিথিল করতে শুরু করেছে। মানুষ আবার দোকানবাজারে, কাজে যাওয়া শুরু করেছে।

আর তাতেই ‘বিস্ফোরণ’! এখন রাঝধানীতে করোনায় মৃত্যুর কোনও খবর নেই। একটা সময় তো দিনে ৭০০ জনের মৃত্যু হচ্ছিল এই দিল্লিতেই।

সন্দীপ বুধিরাজা, দিল্লিতে ম্যাক্স হেল্থকেয়ারের মেডিক্যাল ডিরেক্টর। তিনি খুবই অবাক, মানুষের এই স্বল্প স্মৃতি দেখে। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষ এমন আচরণ করছে, যেন গত দু’-তিন সপ্তাহ আগে কোথাও কিছুই হয়নি। আশ্চর্য! সত্যিই বড় আশ্চর্য হচ্ছি!’’ সন্দীপের মতে, করোনা ভাইরাসের নতুন স্ট্রেনের কারণে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আবারও সম্ভবত সংক্রমণের শীর্ষে পৌঁছব আমরা যে কোনও দিন। এই সম্ভাবনাকে ভুলে যাওয়া চলবে না। ‘‘ডেল্টা প্লাস— নতুন আবিষ্কার হওয়া এই ভ্যারিয়েন্টই সকলকে চমকে দিতে পারে। চিকিৎসায়বাধা দেয় বড্ড এই ভ্যারিয়েন্টটি,’’— বলছিলেন সন্দীপ। তবে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির থেকে এখন দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কিছুটা হলেও উন্নত। সকলে প্রস্তুত। টিকার কাজও এগোচ্ছে। এটাকেই ভরসা হিসাবে দেখতে চাইছেন সন্দীপ।

তবে এখনও দেশে টিকাকরণের গতি অত্যন্ত শ্লথ। পরিসংখ্যান বলছে, করোনা টিকার দুটো ডোজ নিয়েছেন দেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ। সন্দীপের কথায়, ‘‘গোটা দেশে যত দিন না টিকাকরণ হচ্ছে, ১০০ কোটির উপরে টিকাকরণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কল্পনাতেও ভাবতে পারব না, অতিমারি শেষ হওয়ার পথে।’’

কিন্তু দিল্লি ফের স্বমহিমায়, কোভিডের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে গিয়ে রাজধানী নেমে পড়েছে শপিং মল-রেস্তরাঁয়।


(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)