পোস্তা উড়ালপুল: গড়ার মাঝেই ভেঙে পড়া, এ বার লক্ষ্য ধূলিসাৎ

পোস্তা উড়ালপুলপোস্তা উড়ালপুল

জাস্ট দুনিয়া ব্যুরো: পোস্তা উড়ালপুল, শব্দ দুটোয় মিশে রয়েছে চলকে ওঠা রক্তের অজস্র ছোপ। লেগে রয়েছে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচানোর আর্তি। লেপ্টে রয়েছে ২৭টি নিরীহ তরতাজা নিথর প্রাণ। আরও কত ক্ষয়ক্ষতির মানচিত্র! পাঁচ বছরের বেশি সময়ে এ সবই গাঢ় হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছে রোজকার নগরজীবনে। এ বার এই শব্দ দু’টিরও মিলিয়ে যাওয়ার পালা। এটাই নিয়তি!

ভাল নাম বিবেকানন্দ উড়ালপুল। তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ঠিক এক যুগ আগে। শুরুর দিনটির ১২ বছর পূর্তির ঠিক দু’মাস আগে সেই উড়ালপুলই ভেঙে ধূলিসাৎ করার কাজ শুরু হল। তার মাঝে যদিও পোস্তা উড়ালপুল ভেঙে পড়েছিল ২৭টি জলজ্যান্ত প্রাণের উপর। প্রাণঘাতী সেই ভেঙে পড়ার পর থেকেই সিদ্ধান্তের পেন্ডুলাম দুলছিল— নতুন করে উড়ালপুল বানানো হবে, নাকি ধুয়েমুছে সাফ করে দেওয়া হবে উড়ালপুলের সমস্ত চিহ্ন? শেষমেশ স্থির হয়— ধূলিসাৎ। সেই কাজই শুরু হল মঙ্গলবার।

একটা অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল ২০০৯-এ। তখনও রাজ্যে বাম-শাসন। উত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ অংশ, বিধাননগর এবং সংলগ্ন অঞ্চলের বাসিন্দারা নির্ঝঞ্ঝাটে যাতে হাওড়ায় যাতায়াত করতে পারেন, সে কারণেই পোস্তা উড়ালপুল তৈরির সিদ্ধান্ত। পরিকল্পনা মতো কাজও শুরু হয় সেই বছরের ২৪ অগস্ট। সাত মিটার চওড়া এবং ২.২ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই উড়ালপুল তৈরিতে ১৬৪ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা ছিল। প্রথমে ঠিক ছিল আড়াই বছরের মাথায় উড়ালপুলের কাজ শেষ হবে। কিন্তু অনেক আড়াই পেরিয়েও ২০১৬-র মার্চের একেবারে শেষ পর্যন্ত উড়ালপুলের কাজ শেষ হয়নি। তাই উদ্বোধনও হয়নি। সময় যেমন পেরিয়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে খরচের বহরও। আর মার্চের ঠিক শেষ দিন, সেই দুপুরে…

৩১ মার্চ, ২০১৬, বৃহস্পতিবার, বেলা সাড়ে ১২টা
আচমকাই গণেশ টকিজের কাছে ভেঙে পড়ল নির্মীয়মাণ পোস্তা উড়ালপুল। ভয়াবহ এক দৃশ্যের সাক্ষী হল কলকাতা। ভেঙে পড়া উড়ালপুলের চাঙড়ের তলায় চাপা পড়ে গেলেন প্রচুর পথচলতি মানুষ। এমনকি যানবাহনও। চার দিক থেকে ভেসে আসছে বেঁচে থাকার আকুতি। আর্তি না জানিয়েই তত ক্ষণে কারও কারও দেহ চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছে অ্যাসফাল্টের রাস্তা আর ভেঙে পড়া সিমেন্টের চাঙড়ের মাঝখানে। কারও কারও প্রাণ আছে, বেঁচে থাকার আর্তি জানাচ্ছেন। কিন্তু এমন ভাবে চাপা পড়েছেন, নিজে তো বেরতে পারছেনই না, সাহায্য করতে চাওয়ারাও প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ। সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে উদ্ধারের কাজে পৌঁছেছে পুলিশ। দমকল। স্থানীয় জনতা। কিছু ক্ষণের মধ্যে পৌঁছবে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। এমনকি শেষের দিকে সেনাও। ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছবেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখান থেকেই উদ্ধারকাজের তদারকি করবেন তিনি। কিন্তু কোনও তৎপরাতেই ওই পাহাড়প্রমাণ চাঙড় সরানো সম্ভব হয় না দ্রুত। কাজেই প্রাণ যায়। একের পর এক। বেঁচে থাকাদের নিয়ে যাওয়া হয় সার দিয়ে হাসপাতালে। গোটা এলাকা জুড়ে অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন। তাদের যাতায়াত। এলাকা জনারণ্য। কেউ এসেছেন উদ্ধার করতে তো কেউ বা শুধুই ভয়াবহ এই ঘটনার সাক্ষী হতে।

ভয়াবহ ১
ক্রেন দিয়ে কংক্রিটের চাঙড় তোলা হচ্ছে। নীচে চাপা পড়ে রয়েছেন এক জন। বাঁচার প্রবল আকুতি নিয়ে তখনও জীবিত। আর্ত স্বরে তখনও তাঁকে বাঁচানোর আর্তি। কিন্তু ওই চাঁই সরানো তো মুখের কথা নয়। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী ক্রেনের সঙ্গে লোহার চেন বেঁধে  সেই চাঙড় উপরের দিকে তুলে সরানোর চেষ্টা করছে। উপস্থিত জনতার মধ্যেও প্রত্যয়টা বাড়ছে। আর একটু হলেই বার করা যাবে ওই মানুষটাকে। একটি ফাঁক মিলতেই এক জন গিয়ে রক্তাক্ত মানুষটির গলায় এক ঢোক জল ঢেলে দিলেন। আশার আলো যখন নিশ্চিত জ্বলে উঠেছে, ঠিক তখনই গেল লোহার সেই চেন ছিঁড়ে। আবারও সজোরে উপর থেকে চাঙড় গিয়ে পিষ্টে দিল মানুষটিকে। সব আশা শেষ।

ভয়াবহ ২
ক্রেনে টেনে তোলা হচ্ছিল ভেঙে পড়া আর একটি চাঙড়। তার নীচে তখনও আটকে অন্তত তিনটি ট্যাক্সি। একটি সাদা আর দু’টি হলুদ। কংক্রিটের চাঙড় ট্যাক্সির ছাদ ফুঁড়ে ঢুকে গিয়েছে। ভিতরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কি বেঁচে? দেখা যাচ্ছে না কিছুই। ভিতরে না থেকে আর যাবেন কোথায়? পালাবার তো কোনও পথ ছিল না! আচমকা উপর থেকে যদি ভেঙে পড়ে উড়ালপুল, চাপা পড়া ছাড়া আর তো কোনও ‘উপায়’ নেই। পাশের ট্রাক থেকে তত ক্ষণে কেটে বার করা হয়েছে দেহ। দেহ না বলে দেহাংশ বলাই ভাল।

এ ভাবেই সে দিন পোস্তা উড়ালপুল-এ মারা গিয়েছিলেন ২৭ জন। আহতের সংখ্যা ১০০-রও উপরে। তাঁদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সঙ্গে সঙ্গে।

অভিশপ্ত উড়ালপুলের কপাললিখনও সে দিনই হয়তো হয়ে গিয়েছিল। তবুও দুলছিল পেন্ডুলাম। অবশেষে শেষের সে দিন…

১৫ জুন, ২০২১, মঙ্গলবার, বেলা ১২টা
পোস্তা উড়ালপুল ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হল। কয়েক’শো কোটি টাকা খরচ করে বানানো হচ্ছিল। প্রায় শেষের মুখে সেই উড়ালপুল ভেঙে পড়ল। এ বার একেবারে ধূলিসাতের পথে। আর কিছু দিনের মধ্যে ওখানে উড়ালপুলের কোনও চিহ্নই থাকবে না। মাঝখান থেকে খরচ হয়ে গেল প্রচুর টাকা। আচম্বিতে চলে গেল ২৭টি তরতাজা প্রাণ। ইতিহাসে রক্তাক্ত হয়ে থাকবে প্রাণঘাতী এই উড়ালপুলের নাম। অথচ তার কোনও অস্তিত্ব থাকবে না।

গড়া হচ্ছিল। মাঝেই প্রাণঘাতী ভেঙে পড়া। এ বার লক্ষ্য ধূলিসাৎ।


প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)