শঙ্খ ঘোষ রেখে গেলেন তাঁর প্রতিবাদের ভাষা আর ভালবাসা

শঙ্খ ঘোষ

শঙ্খ ঘোষ নেই। যেতে একদিন সবাইকেই হয় তবুও করোনার কালো থাবা ক্রমশ টিপে ধরছে গলা। গিলে ফেলছে একটার পর একটা ইনস্টিটিউশনকে। হ্যাঁ, তিনি তো তাই। একটা ইনস্টিটিউশন। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে এক টেলিভিশন চ্যানেলে বলতে শুনলাম, ‘‘তিনি ছিলেন আসল শিক্ষক।’’ উদাহরণ দিতে গিয়ে একটা গল্প শোনালেন শীর্ষেন্দু। ‘‘একদিন ফোনে কথা হচ্ছিল শঙ্খদার সঙ্গে। বললেন, কবিতা সংশোধন করছেন। নতুন কবিদের কবিতা কোন কবি সংশোধন করে? তিনি করতেন কারণ তিনিই ছিলেন আসল শিক্ষক।’’

সদ্য বই-এর আলমারিটা গুছিয়েছি। কোথায় যে সব কবিতার বইগুলো রেখেছি কিছুতেই মনে পড়ছে না। লিখতে গেলে তো শঙ্খ ঘোষের কবিতার বইগুলো লাগবে। ভাবতে ভাবতেই আলমারিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি হাতের কাছে না পেলে মন থেকে আর নেট ঘেটেই লিখতে হবে। বিশ্বাস করুন আমি নিজে এতটা অবাক অনেকদিন হইনি। সবার সামনে দাঁড় করানো রয়েছে নীল মলাটের ‘ছন্দের ভিতর এত অন্ধকার’। পিছনে জীবনানন্দ উঁকি দিচ্ছেন। কেন, কীভাবে এই বইটা সবার সামনে রয়েছে আমার মনে পড়ছে না। হয়তো সময়ের এ এক অদ্ভুত খেলা। শঙ্খ ঘোষই কেন জীবনানন্দও তো থাকতে পারত সামনে।

তবে, লিটল ম্যাগাজিন করার সময় কবিদের দরজায় দরজায় হানা দেওয়ার অভ্যেস ছিল আমার আর বোনের। একটু যদি আমার ম্যাগাজিনটা দেখে, যদি তাঁর মতামত দেন। আর এই করতে করতে যদি একটা কবিতাও দিয়ে দেন। না সে সৌভাগ্য হয়নি। তবে, তাঁর বই কিনতে গিয়ে যখন পাবলিশারের স্টলে দেখা হয়েছে তখন হাসি মুখে অটোগ্রাফ দিয়েছেন বইয়ের উপর। অটোগ্রাফ করা সেই বইটা খুঁজে পেলাম না। রয়েছে কোথাও আত্মগোপন করে। আর সেই সুযোগেই তাঁর হাতে গুজে দিয়ে এসেছিলাম আমার ম্যাগাজিন ‘প্রেরণা’। দেখে নামটা উচ্চারণ করে বলেছিল, ‘‘এটা পড়লে প্রেরণা পাব তো?’’ একরাশ গর্ব নিয়ে বলেছিলাম, ‘‘অবশ্যই।’’ বলেছিলেন, ‘‘বেশ।’’

পরবর্তী সময়ে জানতে চাওয়া হয়নি কেমন লেগেছিল। এ আমার চরিত্রের দোষ। খবরের ভাষায় ফলো-আপ করার অভ্যেস মোটেও নেই। তাই সম্পর্কগুলো হালকা হয়ে যায় দ্রুত। তবে কবির কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক হালকা করবে কার সাধ্যি। যতবার ম্যাগাজিন করার সময় দেখা হয়েছে, হাতে গুজে দিয়েছি, ‘প্রেরণা’। আর আজ ‘ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার’ হাতে নিয়ে বদলে যাওয়া সমাজটাকে আরও একবার উপলব্ধি করি।

কবি লিখেছিলেন, ‘‘সকলে না, অনেকেই কথার ভিতরে কথা খোঁজে/সহজের ভাষা তুমি ভুলে গেছ। এই বৃষ্টি জলে/এসো স্নান করি।’’ কবিতা, কথার ভিতর কথা। কিনারা-র লাইনগুলোও কী অদ্ভুত। সেখানে তিনি লিখছেন, ‘‘এই দিনগত ক্ষয়—সে তো আর অন্য কিছু নয়/ প্রদীপের সামনে মোম ধরে রাখা অধিক সময়।’’ কবির গলায় বার বার যখন উঠে আসত প্রতিবাদের ছন্দ তখন বড্ড আপন মনে হত তাঁকে। এভাবে প্রতিবাদ কতজন করতে পারে। পাত্তা দেননি কিছু। মৃদুভাষী মানুষটার কলমটাই থাক, অতটা তাঁর কাছের মানুষ নাই বা হলাম কিন্তু ওই কবিতার মতো কাছের আর কে হতে পারে। তিনি ছিলেন, আছেন থাকবেন—কবি, কবিতার অভিভাবক আর শীর্ষেন্দুর কথায় শিক্ষক হয়ে।

শেষ করি তাঁর শহিদশিখর কবিতার লাইন দিয়ে, ‘‘আমি এই শতাব্দীর শেষ প্রান্ত থেকে কথা বলি/ আমি এই শালপ্রাংশু মধ্যরাত্রি থেকে কথা বলি/ আমার মায়ের রক্ত হাতে নিয়ে আমি কথা বলি/ হোলি খেলেছিল যারা আমার মেয়ের রক্ত নিয়ে/ আগুন জ্বালিয়ে যারা শবের উপর নেচেছিল/ এই শেষ অন্ধকারে তাদের সবার কথা বলি…’’

‘…দেখো এ মৃত্যুর মধ্যে কোথাও মৃত্যুর নেই লেশ…’

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)