‘নাটক পরিচালনা করে যে রকম তৃপ্তি পাই, তেমনটা আর কিছুতে নয়’

‘নাটক পরিচালনা করে যে রকম তৃপ্তি পাই, তেমনটা আর কিছুতে নয়,’‘নাটক পরিচালনা করে যে রকম তৃপ্তি পাই, তেমনটা আর কিছুতে নয়,’

‘নাটক পরিচালনা করে যে রকম তৃপ্তি পাই, তেমনটা আর কিছুতে নয়,’— তিনি নিজে বার বার এ কথাটা বলতেন। আসলে একটা সময়ের পর সিনেমায় অভিনয় করাটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ছিল শুধুই পেশা। তিনি মনের খিদেটা মেটাতেন নাটক বা কবিতা থেকেই। আবার ফিল্মে কাজ না থাকলে তিনি অধৈর্য হয়ে পড়তেন। ৪০ দিনের লড়াই শেষে হেরে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সম্পর্কে কিছু অজানা কথা। জাস্ট দুনিয়া প্রতিবেদন।


সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে পরিবারে জন্মেছিলেন, সেই পরিবার ঘিরে ছিল অভিনয়ের বাতাবরণ। অভিনয় ছিল তাঁদের রক্তে। তাঁর বাবা আর ঠাকুরদা— দু’জনেরই ছিল মঞ্চে অভিনয় করার দুর্নিবার আগ্রহ। সৌমিত্রদেরও নাটক করতে উৎসাহিত করা হত। সৌমিত্র লিখেছেন, ‘আমরা ছোট ছিলাম, তাই পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোকজনরাই আমাদের শ্রোতা ছিলেন। একটা বেশ বড় মাপের নিচু খাটকে আমরা মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করতাম, আর বিছানার চাদর দিয়ে পর্দা তৈরি করতাম’। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারেই এটা একটা পরিচিত দৃশ্য ছিল সেই সময়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’-এর মতো শিশুদের অভিনয়যোগ্য নাটকও তখন পাওয়া যেত।

স্কুলেও তাঁদের নিয়মিত নাটকের অনুষ্ঠান হত। সৌমিত্র কৃষ্ণনগরের সিএমএস সেন্ট জোন্’স মিশনারি স্কুলে পড়তেন। মিশনারিরা এই বাংলা মাধ্যমের স্কুলটি চালাতেন। সব মরসুমেই নাটক হত সেখানে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে, দুর্গাপুজোর সময়ে, সরস্বতী পুজোয়, শীতকালে এমনকি বসন্ত কালেও। তিনি লিখেছেন, ‘খুদে অভিনেতা ছিলাম তো, তাই আমার অভিনয়ের জন্য অনিবার্য ভাবেই কিছু স্বীকৃতি জুটে যেত’। অভিনয় করে আনন্দ পেতেন সৌমিত্র।

১৯৪৫ সালে তিনি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। সৌমিত্রর বাবা তখন একটা সরকারি নিলেন। বদলির চাকরি ছিল। তাই কৃষ্ণনগর ছেড়ে ওঁরা বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমে বারাসত, তার পর সেখান থেকে হাওড়া। হাওড়াতে এসে স্কুলের বাঁধাধরা রুটিনে একটু পরিবর্তন এল। ওখানে ছিল কিছু ছোট ছোট নাট্যগোষ্ঠী। এই সব নাটকের দল সারা বছর ধরে প্রচুর নাটক মঞ্চস্থ করত। ছোটদেরও নিজস্ব কিছু গোষ্ঠী ছিল। তারা প্রত্যেক মাসে অন্তত দু’বার বা তিন বার তাদের নিজস্ব নাটকের অনুষ্ঠান করত। সৌমিত্র থিয়েটারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়লেন। তাঁর স্কুলজীবন শেষ হওয়া পর্যন্ত এই যোগসূত্র ছিল অব্যাহত।

ম্যাট্রিক পাশ করার পর সৌমিত্র কলকাতায় এসে আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজে ভর্তি হন। শুরু করলেন পেশাদারি নাটক দেখা। প্রথম নাটক দেখলেন শিশির ভাদুড়ীর ‘আলমগীর’। নাটকের নামভূমিকায় শিশির ভাদুড়ী স্বয়ং। এই নাটকটি দেখেই অভিনয়, নাট্যমঞ্চ এবং আরও অনেক কিছু সম্পর্কে তাঁর দৃষ্ঠিভঙ্গি তৈরি হয়। মঞ্চ সম্পর্কে তাঁর তত দিন পর্যন্ত যে সব ধারণা ছিল, তার প্রায় সবটাই ঝেড়ে ফেলতে হল। দু’তিন বছরের মধ্যে অর্থাৎ সৌমিত্র তখন স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র, তখন তিনি মনস্থির করলেন, ‘আমি অভিনেতা হব— অন্য কিছু নয়’। এক সময় যা ছিল ‘নেশা’, এখন সেটাই হয়ে উঠল ‘ধ্যান-জ্ঞান’।

সৌমিত্র স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনার মধ্যবর্তী সময়ে হরেক রকম কাজ করেছিলেন। এমএ ক্লাস প্রায় যখন শেষ হয়ে এসেছিল, তখন তিনি আকাশবাণীতে ঘোষকের চাকরি নিলেন। এমএ পরীক্ষা দেওয়া হল না। তিনি লিখছেন, ‘আসলে আমার এমএ পরীক্ষা দেওয়ার কোনও ইচ্ছাই ছ্লি না’। পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করায় তাঁর প্রবল অনীহা ছিল। তবে বেতার নাটকও তিনি খুব একটা পছন্দ করতেন না। মাত্র কয়েকটি বেতার নাটকে তিনি অভিনয় করেন।

শিশু বয়স থেকে আবৃত্তি করতে ভালবাসতেন। তাঁদের বাড়ির সকলেই বাসত। কিন্তু তখনও পর্যন্ত তাঁর ধারণা ছিল না যে, আবৃত্তি একটা স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম। তিনি ভাবতেন, আবৃত্তি কবিতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এক জন অভিনেতা যা করতে পারেন, তা হল, আবৃত্তির মাধ্যমে কবিতাকে প্রাণবন্ত করে তোলা। ১৯৫৭ সালে সৌমিত্রর এমএ পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। আকাশবাণীর কাজও আর ভাল লাগছিল না। তিনটি অধিবেশনে অনুষ্ঠান প্রচার করা হত। তার মানে, সান্ধ্য অধিবেশনের সময় তাঁর রিহার্সাল বাদ দিতে হত।

এর পর সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে যে অফার পেয়েছিলেন তা বাস্তবায়িত হয়। সেটা ১৯৫৮ সাল। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সৌমিত্রকে। তিনি পুরদস্তুর পেশাদার হয়ে গেলেন। সৌমিত্র লিখেছেন, ‘অভিনয় জীবনের পরবর্তী ১৫ বা ২০ বছরে চলচ্চিত্রে আমার দারুণ কর্মব্যস্ততা এবং অনেক আগাম প্রতিশ্রুতির দরুণ থিয়েটার আমার জীবন থেকে দূরে সরে গিয়েছে— তা সে নাটকে অভিনয় করা বা নাটক পরিচালনা করা— যাই হোক না কেন’। ব্যস্ত নায়ক হিসাবে দিনের পর দিন তাঁর আউটডোর শ্যুটিং থাকত। মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করা আর তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু নাটক দেখার ব্যাকুলতা ছিল। মাঝে মাঝে নাটক করেছেন। কিন্তু নিয়মিত নয়।

বছর তিরিশেক পর তিনি ফের থিয়েটারে আত্মনিয়োগ করেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সৌমিত্র লিখছেন, ‘তার মানে এই নয় যে, আমি সিনেমাকে আগের তুলনায় কোনও অংশে কম ভালোবাসি। কিন্তু অতি সম্প্রতি যে সব ফিল্ম তৈরি হয়েছে সেগুলি আমার কাছে ক্লান্তিকর মনে হয়। বাণিজ্যিক ছবির মান ভয়ঙ্কর ভাবে নেমে গিয়েছে।’’ তিনি অবশ্য বাণিজ্যিক ফিল্ম আর আর্ট ফিল্মের মধ্যে কোনও কৃত্রিম পার্থক্যে বিশ্বাস করতেন না। চলচ্চিত্র বলতে তিনি বুঝতেন ভাল ফিল্ম বা খারাপ ফিল্ম— এমনকি গতানুগতিক ফিল্ম।

সৌমিত্র পেশাদার জীবনের অনেকগুলো বছর কাটানোর পর বলতেন, ‘‘ক্যামেরার সামনে অথবা মঞ্চে দর্শকের সামনে ভাবপ্রকাশ করার মধ্যে কোনটা আমি বেশি পছন্দ করি, সেটা বলা খুব কঠিন। আমি বলি, দুটোই আমি সমান ভাবে ভালবাসি। এই দুয়ের মধ্যে কী ভাবে পার্থক্য করব জানি না।’’ তাঁর কাছে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা হল অভিনয়। আর কিছু নয়। নিছক অভিনয় করার আনন্দ। কিন্তু তাঁকে প্রশ্ন করলে জবাব আসত, ‘নাটক পরিচালনা করে যে রকম তৃপ্তি পাই, তেমনটি আর কিছুতে নয়। এই প্রয়াসে আমার মনের সব সৃজনশীল তন্ত্রীগুলো উচ্চগ্রামে উঠে একটা ঐকতানের সৃষ্টি করে’।

 

বিনোদন জগতের আরও খবরের জন্য ক্লিক করুন এই লিঙ্ক

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)