প্রতারণার জাল, ভুয়ো ভ্যাকসিন থেকে কল সেন্টার—নিরুপায় মানুষ

প্রতারণার জাল

প্রতারণার জাল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে যুব প্রজন্মকে। সকালে খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় শুধু প্রতারণার খবর। টেলিভিশন চ্যানেলে ভেসে ওঠে প্রতারকদের মুখ। শোনা যায় প্রতারিতদের হাহাকার। এ যেন সম্প্রতি চূড়ান্ত বেড়ে গিয়েছে। চারদিকে শুধুই প্রতারণার  খবর উঠে আসছে। ‘ফেক’ খবর, ‘ফেক’ টিকা, ‘ফেক’ কল সেন্টার, ‘ফেক’ চাকরি। ফেক ফেক আর ফেক। একদল মানুষ প্রতারণা করছে আর একদল মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। যখন সম্বিত ফিরছে ততক্ষণে অনেকটা দেড়ি হয়ে গিয়েছে। সততা শব্দের মূল্য ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে। অচেনা মানুষ অচেনা মানুষকে ঠকাচ্ছে, চেনা মানুষ কেড়ে নিচ্ছে চেনা মানুষের আস্থা। বিশ্বাস শব্দটা কি মুছে যাবে জীবন থেকে? প্রশ্ন তুললেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


মানুষ আজ বড্ড অসহায়। শব্দটা অসহায় না হয়ে দিশাহারাও হতে পারে। আসলে দিশাহারাই, এই ভেবে যে কাকে বিশ্বাস করবেন। কেন মানুষ প্রতারক হয়ে উঠছে, এর পিছনের মনস্তত্ব ঠিক কী তা মনোবিদরাই বলতে পারবেন। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে যে প্রশ্নটা ক্রমশ মনের মধ্যে দানা বাধছে আর দিশেহারা করে তুলছে তা হল, আর কি মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করবে না? এর পর তো পাশে শুয়ে থাকা মানুষটাকেও প্রতিনিয়ত সন্দেহের চোখে দেখবে মানুষ। বিশ্বাস না থাকলে বাঁচবে তো সম্পর্কগুলো?

এই তো গত মাসের কথা। এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম কসবায়। সেখানে গিয়য়েই প্রথম শুনলাম দেবাঞ্জন দেবের কীর্তি। তার পর তো বাকিটা চলমান ইতিহাস। সে নাকি ভুয়ো ভ্যাকসিন দিয়ে দিয়েছে ১০০-র উপর মানুষকে। সকলেরই সন্দেহ হয়েছে, কেউ প্রতিবাদ করেননি। শেষ পর্যন্ত বিপাদটা ঘটিয়ে ফেললেন নিজেই। ডেকে ফেললেন সাংসদ-অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীকে। আর তিনিই দিলেন সব পর্দা ফাঁস করে। তার পর থেকে তোলপাড় রাজ্য, রাজনীতি। জড়াতে জড়াতেও জড়াল না কত নাম। শ্রীঘরে পৌঁছে গেলেন ভুয়ো ভ্যাকসিন কাণ্ডের মাথা।

এটাই তো একটা উদাহরণ নয়। ফেক, প্রতারণা, ভুয়ো শব্দগুলো জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। আসলে মানুষ সব সহজে পেতে চায়। না খেটে না লড়ে। আর তাকেই কাজে লাগিয়ে ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিভিন্ন স্তরের প্রতারণা। কিছু মানুষ সহজে চাইছে সফল হতে আর কিছু মানুষ তা ব্যবহার করে সাময়িক সাফল্য পাচ্ছে। কিন্তু শেষটা কারও ভাল নয়। সাময়িক স্বস্তি, সুখ, টাকা, গাড়ি, বাড়ি, আর তা ধ্বংস হতে লাগছে মাত্র কয়েক মুহূর্ত। একটা কথা আছে না, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না।’’—এর থেকে বড় সত্যি আর কিছু হতে পারে না।

এবার আসি সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার কথায়। যদিও ভুয়ো ভ্যাকসিনকে কোনওটাই ছাপিয়ে যেতে পারেনি। তবে যা ঘটেছে তাও কম কী। ভুয়ো কল সেন্টারের অন্দরে মোটা টাকার লোন পাইয়ে দেওয়ার ফাঁদ। রমরমিয়ে নিউটাউনের অফিস এলাকায় জমিয়ে চলছিল ব্যবসা। ‘সহজেই পান লোন, কোনও গ্যারেন্টার ছাড়া’—এমন বিজ্ঞাপন তো মাঝে মাঝেই দেখা যায়। ফোনে এমন কত অফার। নিঃস্ব হয়ে মানুষ পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু কেন? ব্যাঙ্কে সোজা পথে লোন নিতে গেলে যে অনেক হ্যাপা, তা পোহাতে চায় না মানুষ। ওই যে সহজে সব পেয়ে যাওয়ার খিদে।

এক ছাত্রী প্রবেশিকা পরীক্ষা না দিয়েই ভেবেছিলেন ডাক্তারি পড়বেন। ব্যস তাঁর এ হেন সহজে পেয়ে যাওয়ার ইচ্ছের কথা জেনে গেল প্রতারকরা। অফার এল কোনও প্রবেশিকা ছাড়াই ভর্তি হওয়া যাবে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে। এবার শুরু হল সহজে পেয়ে যাওয়ার খেসারত দেওয়া। চলে গেল সেই ছাত্রীর বাবার কষ্টের ১৪ লাখ টাকা প্রতারকদের কবলে। নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে দেখলেন কিছুই নেই। চাই আরও টাকা, আরও অনেক অনেক টাকা। তার পরও সহজে পাওয়া কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয় না।

কিছুদিন আগের ঘটনা। এতক্ষণ তো শুধু বললাম  এ রাজ্যের সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কথা। তবে কিছুদিন আগে গোটা দেশের পুলিশ, প্রশাসনকে নাস্তানাবুদ করে রেখেছিল এটিএম জালিয়াতির ঘটনা। মাঝে মাঝেই সাধারণ মানুষের অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছিল টাকা। কীভাবে, কোথা থেকে তা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের হাতে উঠে এল দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এমনই এক প্রতারক গ্যাংয়ের ক্রিয়াকলাপ। যারা অভিনব উপায়ে এটিএম থেকে তুলে নেয় টাকা। না বুঝতে পারছে ব্যাঙ্ক না অ্যাকাউন্টের মালিক।

ব্যক্তি জীবনের প্রতারণার ক্ষত তো আরও অনেক গভীর। এখানে তো শুধু মানুষের টাকা নয়-ছয় হচ্ছে। কিন্তু ব্যাক্তিগত সম্পর্কে বাজি ধরতে হচ্ছে বিশ্বাস, ভালবাসা, এমনকী জীবনেরও। তা নিয়ে অন্য কোনওদিন কথা বলা যাবে। এই এত প্রতারণার যে বিস্তার, তার পিছনে মানুষের বদলে যাওয়া মনস্তত্বটা ঠিক কী? এক্ষেত্রেও সহজে টাকা রোজগার, সহজে সাফল্যের সিঁড়িতে উঠে পড়ার একটা লক্ষ্য তো রয়েছেই তার সঙ্গে আরও একটা জিনিস হয়তো নেপথ্যে কাজ করছে। আর তা হল এই প্রজন্মের কাছে চাকরী নেই, রোজগার নেই। পড়াশোনা শিখেও সঠিক চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে যুব প্রজন্ম। কোভিড সেই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। যাঁদের চাকরী ছিল তাঁরাও আজ বেকার। অদূর ভবিষ্যতও দেখা যাচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে সাহস, বুদ্ধি, শিক্ষাকে ভুল পথে চালিত করছে একদল মানুষ। আর তার সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়ছে, যা আতঙ্কের।

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)