ট্রাম্প পরাজয় স্বীকার করছেন না কেন? কেন ভোট জালিয়াতি বলে উগ্র দক্ষিণপন্থী সমর্থকদের ক্ষেপিয়ে তুলছেন? এর পিছনে আসল খেলাটা কী? বিশ্লেষণে নিউ ইয়র্ক থেকে ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
যে কথাগুলো অনেকেই বুঝতে পারেন না এবং আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো যে কথাগুলো বলে না, আমি আমার আমেরিকাবাস ও এ দেশে রাজনীতি করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে সে সব কথা সোজাসুজি বলি।
বিদেশের আরও খবরের জন্য এখানে ক্লিক করুন
ভোটের আগে এ বারেও বলেছি যে, ট্রাম্পবাহিনী বিজয়ী হতে পারে কারণ, বিশ্ব জুড়ে ফ্যাসিস্ট ও হিংস্র শক্তিগুলোর ভয়াবহ উত্থান হচ্ছে। তা সে ভারতে হোক বা ইউরোপ বা দক্ষিণ-উত্তর আমেরিকা। আমি লিখেছিলাম, যদি বাইডেনকে ভোট দেওয়ার জন্য অতি বিশাল সংখ্যায় মানুষ বেরিয়ে না আসেন, তাহলে ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টি জয়লাভ করবে।
বিশাল সংখ্যায় বেরিয়ে এসেছেন আমেরিকার মানুষ। তাই শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প ধরাশায়ী হয়েছেন। কিন্তু তাঁর রিপাবলিকান পার্টি ধরাশায়ী হয়নি। বরং, জাতীয় নির্বাচনে হাউস অব রিপ্রেসেন্টেটিভ (ভারতের লোকসভার মতো) এবং সেনেট (ভারতের রাজ্যসভার মতো)— দুটো জায়গাতেই রিপাবলিকানরা বেশি আসন পেয়েছে বা সমান-সমান। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে রিপাবলিকানরা আগের থেকে বেশি আসন দখল করেছে। কিন্তু ট্রাম্প হেরেছেন। কারণ, মধ্যপন্থী বাম ও দক্ষিণ— অর্থাৎ সাধারণ মানুষ তাঁকে আর চায়নি প্রেসিডেন্ট হিসেবে। কারণ আমরা সকলেই জানি।
এ বারে আসা যাক, ট্রাম্প কেন হার স্বীকার করছেন না? কেনই বা তার উগ্র সমর্থকেরা মাস্ক না-পরে আমেরিকার কোনে কোনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন?
ট্রাম্প আসলে এখন এই ভোট জালিয়াতি বা কারচুপির অভিযোগ তুলে তাঁর সমর্থকদের উত্তেজিত করে তুলছেন। যাতে সারা দেশ জুড়ে একটা অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি হয়। এবং কিছু মানুষ সেই ফাঁদে পা দেন। একটানা ‘গোয়েবলস প্রোপাগাণ্ডা’র ফলে মানুষের ধারণা হবে যে, হয়তো সত্যিই একটা বড় রকমের কারচুপি হয়েছে। যদিও গণ কারচুপির কোনও তথ্যই ট্রাম্পবাহিনী হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তাতে অশিক্ষিত লোকেদের ‘মগজধোলাই’ বন্ধ করা যায় না।
এখানেও ভারতের সঙ্গে আশ্চর্য মিল!
এই অস্থিরতা যদি খুব বেড়ে যায়, ট্রাম্প সেই ডামাডোলকে কাজে লাগিয়ে ডেমোক্র্যাটদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন যাতে তাঁর বিরুদ্ধে ঝুলে থাকা বিলিয়ন ডলার কর ফাঁকি দেওয়ার বহু মামলার হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। নচেৎ, প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে গেলেই তাঁর রক্ষাকবচ চলে যাবে। এবং তাঁকে গ্রেফতার করা হতে পারে। বৈধ কর ফাঁকি দিয়ে আমেরিকাতে কেউ ছাড় পেয়েছেন বলে শোনা যায়নি। বহু বড় বড় রুই-কাতলা জেলে গিয়েছেন। তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
ডেমোক্র্যাটরা এখন এই অবস্থায় কোনও রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা চাইবে না। বিশেষ করে, আমেরিকার করোনাভাইরাস মহাসঙ্কট— যা ট্রাম্প নিজেই তৈরি করেছেন। তার সমাধান করতে গেলে দেশজোড়া বিক্ষোভ ও অস্থিরতা বন্ধ করা জরুরি। তারা ট্রাম্পবাহিনীর এই কৌশলে তাঁর সঙ্গে গুপ্ত বোঝাপড়া করে নেবে যাতে তিনি বিচার ও জেল থেকে রেহাই পান। এবং তাঁর বদলে শেষ পর্যন্ত জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেয়। কারণ, কোর্টে গিয়ে তাঁর কোনও সুবিধা হবে না, তিনি জানেন। রিপাবলিকানদের মধ্যেই বুশ, রোমনি, জেমস বেকার জাতীয় বড় বড় রাঘব বোয়াল বাইডেনকে ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
ট্রাম্প পরাজয় স্বীকার করছেন না, আসলে ট্রাম্প এত রকমের অপরাধ করেছেন যে, মানুষকে ক্ষেপিয়ে না তুলে তাঁর নিজের বাঁচার আর কোনও উপায় নেই।
তা ছাড়া, আগেই বলেছি, কেবলমাত্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয় ছাড়া রিপাবলিকানরা কিন্তু অন্য সব নির্বাচনে বেশি ভোট পেয়েছে এবং জিতেছে। ফলে তাদের শক্তি এখন আগের চাইতেও বেশি। তাদের হাতে বহু চরমপন্থী সমর্থক আছেন, তাদের হাতে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন আছে, উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো আছে, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, কেটো ইনস্টিটিউট জাতীয় শক্তিশালী থিঙ্ক ট্যাংক আছে, ফক্স টিভি এবং হাজার অতি-দক্ষিণ রেডিও টক্ শো আছে, এবং গুপ্ত বিলিয়নেয়ার ধনিকশ্রেণি আছে।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এ সব বেশি কিছু নেই। তাদের আছে জর্জ সোরোস জাতীয় একশ্রেণির বিলিয়নেয়ার, আর টেড টার্নার জাতীয় সিএনএন এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস-জাতীয় মিডিয়া। কিন্তু রাস্তায় নেমে লড়াই করার শক্তি রিপাবলিকানদের অনেক বেশি।
এই রাজনৈতিক অস্থিরতা, মগজধোলাই, মিথ্যা প্রচার এবং সামাজিক ডামাডোল চলবে আগামী চার বছর। বাইডেন ও কমলা দেশের মধ্যে বড় ধরনের কোনও অর্থনৈতিক বা সামাজিক পরিবর্তন আনতেই পারবেন না, কারণ তাঁরা রিপাবলিকান সেনেটের সমর্থন পাবেন না। তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্ট এখন ৬-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণপন্থীদের হাতে। এই সব কারণে, আগামী চার বছর টালমাটাল চলবে।
ট্রাম্প পরাজয় স্বীকার করছেন না এ বার, কিন্তু ২০২৪-এ তিনি যদি আবার প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ান, তখন আর তাঁর সামনে কোনও বাধাই থাকবে না।
(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)