জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: সিরিয়াল কিলার তো দূর অস্ত্, তিনি যে একটা মশা মারতে পারেন, পরিচিতরা সেটাই ভাবতে পারেন না। অথচ সেই মানুষটাই কিনা ৩৩ জনকে খুন করেছেন! এবং নৃশংস ভাবে!
এ যেন রোমহর্ষক কোনও হলিউডি সিনেমা। চিত্রনাট্যও যেন একেবারে সাজানো ছিল। যার প্রতিটা অক্ষর মেনেই কাজ করেছিলেন আদেশ খামরা নামের মূল চরিত্রটি। খুন করেছেন ৩৩ জনকে। আর সেই প্রতিটা খুনের মধ্যেই রয়েছে গা শিউরে ওঠা একাধিক মিল। যেমন— যাঁরা খুন হয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকে পেশায় ট্রাকচালক বা ট্রাকের খালাসি। প্রত্যেককে মাদক খাইয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। খুনের পর প্রত্যেকের দেহ নগ্ন করে কয়েক খণ্ডে কেটে ফেলা হয়েছে নৃশংস ভাবে… ইত্যাদি। গত ৮ বছর ধরে এ ভাবেই ৩৩ জন ট্রাকচালক-খালাসিকে খুন করেছে ওই সিরিয়াল কিলার আদেশ খামরা। পুলিশের দাবি, সে আসলে এক জন সাইকো কিলার।
মধ্যপ্রদেশে ভোপালের ছোট্ট পুরশহর মান্ডিদ্বীপ। সেখানেই ছোট্ট একটা টেলারিং-এর দোকান। বছর আটচল্লিশের মালিকের নাম আদেশ খামরা। সারা দিন সেই দোকানেই মগ্ন হয়ে মেশিনে জামা-কাপড় সেলাই করতেন তিনি। এলাকার লোকজন তাঁকে শান্ত-ভদ্র মানুষ বলেই চেনেন। কিন্তু, রাত হলেই সেই নিরীহ মানুষটাই হয়ে উঠত নৃশংস খুনি। গত ৮ বছরে নিজের হাতে একের পর এক খুন করেছে সে। পুলিশ যখন তাকে সিরিয়াল কিলার হিসাবে গ্রেফতার করে, এলাকাবাসী সে কথা শুনে রীতিমতো তাজ্জব হয়ে যায়। তাঁরা কোনও ভাবেই ভেবে উঠতে পারছেন না, তাঁদের প্রিয় আদেশ কী ভাবে এমন কাজ করতে পারে? এত দিন একই শহরে বাস করেও তাঁরা ঘূণাক্ষরেও টের পাননি আদেশের এমন সাইকো কীর্তির কথা।
কেন এ ভাবে খুন করত সে? জয়করণ নামে আদেশের এক সাকরেদকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জেরায় সে জানিয়েছে, ‘‘আমি যখনই ওকে জিজ্ঞেস করতাম, কেন ট্রাকচালকদের খুন করো? ওস্তাদ হাসি মুখে উত্তর দিত, ওদের অনেক দুঃখ এবং প্রভূত কষ্ট রে। সেই যন্ত্রণা থেকে ওদের মুক্তি দিচ্ছি আমি।’’ মধ্যপ্রদেশ পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, আদেশকে ধরা না গেলে আরও কত ট্রাকচালক-খালাসির যে প্রাণ যেত! আরও আগে এই সাইকো কিলার ধরা পড়লে যে বেশ কয়েক জনের প্রাণ বাঁচানো যেত তা-ও মানছেন ওই কর্তা।
২০১০-এ প্রথম মধ্যপ্রদেশের অমরাবতীতে এ রকম ভাবে এক ট্রাকচালককে খুন করা হয়। হাইওয়ের ধারে একটি কালভার্টের নীচে ওই চালকের নগ্ন এবং খণ্ডিত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিল, ট্রাকবোঝাই জিনিসপত্র ডাকাতি করতেই ওই খুন। মোটিভ পাওয়া গেলেও খুনির সন্ধান মেলেনি। কয়েক দিনের মধ্যে ফের একই কায়দায় খুন। এ বার মহারাষ্ট্রের নাসিক। এ বারেও মোটিভ মিলল। কিন্তু, খুনিকে ধরা গেল না। এর পর গত আট বছর ধরে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের বেশ কয়েকটি জায়গায় একই ধরনের খুনের ঘটনা ঘটে। পুলিশের হিসাবে সব মিলিয়ে ৩০ জন ট্রাকচালক-খালাসি খুন হয়েছেন।
এটা কী বললেন টুটু বসু? অপমান করে বসলেন নারী সমাজকেই
সম্প্রতি অনেক চেষ্টার পর মধ্যপ্রদেশ পুলিশের একটি বিশেষ দল ওই খুনি আদেশ খামরার সন্ধান পায়। উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুরের এক জঙ্গলে তিন দিন ধরে ধাওয়া করে শেষে আদেশকে পাকড়াও করেন ভোপাল শহরের পুলিশ সুপার বিট্টু শর্মা। পুলিশের জেরায় সে স্বীকার করেছে, ৩০ নয়, তার হাতে খুন হয়েছেন ৩৩ জন ট্রাকচালক-খালাসি। শুধু তাই নয়, জেরার সময় ওই ৩৩ জনের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছে আদেশ। যে দিন সে খুন করেছিল, সে দিন ওই চালক-খালাসিদের কে কী রঙের পোশাক পরেছিলেন, ওরা কোথায় একসঙ্গে খেয়েছিল, কী দিয়ে খেয়েছিল, কে কতটা মদ্যপান করেছিল, কোথায় খুন করা হয়েছিল, কোথায় দেহ কাটা হয়েছিল, কোথায় সেই খণ্ডিত দেহ ফেলা হয়েছিল— সবেরই পুঙ্খনাপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছে সে পুলিশকে। যা শুনে মধ্যপ্রদেশ পুলিশের বড়কর্তাদের মুখ ‘হাঁ’ হয়ে গিয়েছে।
আদেশ খামরাকে খুঁজে বার করার পিছনে রয়েছেন এক মহিলা আইপিএস অফিসারের ভূমিকা। তাঁর নাম বিট্টু সিংহ। ভোপাল শহরের পুলিশ সুপার বিট্টু নিজে এশিয়ান গেমসে বোঞ্জজয়ী এক জন অ্যাথলিট। সম্প্রতি দুই ট্রাকচালক খুনের ঘটনায় একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়। সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার অফিসার লোধা রাহুল কুমার। বিট্টু ওই টিমেরই সদস্য। সূত্র মারফৎ তিনি জানতে পেরেছিলেন, এই ট্রাকচালক খুনের ঘটনায় আদেশ খামরা নামে এক দর্জির যোগ থাকতে পারে। সেই খবর পেয়ে আদেশের ঘনিষ্ঠ জয়করণকে আটক করেন বিট্টু। জিজ্ঞাসাবাদের সময় জয়করণ তার ‘গুরু’ আদেশের কথা স্বীকার করে।
অন্য দিকে, জয়করণকে আটক করা হয়েছে শুনেই এলাকা ছেড়ে পালায় আদেশ। পুলিশও তার পিছু নেয়। শেষে সুলতানপুরের জঙ্গলে আশ্রয় নেয় সে। বিট্টুও ছাড়বার পাত্রী নন। তিন দিন ধরে ওই জঙ্গলেই ধাওয়া করে বেড়ান তিনি আদেশকে। অবশেষে তৃতীয় দিনে তিনি গানপয়েন্টে আদেশকে টার্গেট করে ফেলেন। সেই সময়েই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় আদেশ। জেরায় সে ৩৩ জনকে খুনের কথা স্বীকার করেছে। জয়করণকে যা বলেছিল, একই কথা সে পুলিশ আধিকারিকদের কাছেও বলেছে, ‘‘ট্রাকচালক-খালাসিদের বড় কষ্ট। আমি ওদের কষ্ট থেকে মুক্তি দিতাম।’’
ভোপালের ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (ডিআইজি) ধর্মেন্দ্র চৌধরি জানিয়েছেন, আদেশ খামরা এক জন সিরিয়াল সাইকো কিলার। জেরায় সে ৩৩ জনকে খুনের কথা স্বীকার করেছে। জেরা করার সময় পুলিশ জানতে পেরেছে, প্রথমে ট্রাকচালকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত আদেশ। তার পর তাদের সঙ্গে কোনও এক জায়গায় খাওয়াদাওয়া করত। খাওয়ার সময়েই পানীয়ের সঙ্গে মাদক মিশিয়ে ওই চালক-খালাসিদের অজ্ঞান করে গলায় দড়ির ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হত। এর পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁদের দেহ টুকরো করে কোনও কালভার্টের নীচে ফেলে দিত আদেশ এবং তার সঙ্গীরা। পাশাপাশি, ওই ট্রাকের জিনিসপত্রও লুঠ করা হত বলে পুলিশের দাবি।
এর আগে ভারতে সিরিয়াল কিলার হিসাবে যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের মধ্যে ৪২টি খুন করে এক নম্বরে ছিল মুম্বইয়ের রামণ রাঘবের নাম। তার পরেই সিরিয়াল কিলার হিসাবে দ্বিতীয় স্থানে নিজের নামটা ঢুকিয়ে ফেলল আদেশ খামরা। পুলিশ জানিয়েছে, খামরা সম্প্রদায়ের মধ্যে অশোক নামে এক ব্যক্তি ছিল। সে-ও নাকি এ ভাবে ট্রাকচালকদের খুন করত। ২০১০ সালে সেই অশোক ধরা পড়ে। তাকে গ্রেফতার করে ট্রেনে চাপিয়ে ভোপাল নিয়ে আসার সময়ে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সে পালিয়ে যায়। আর তার খোঁজ মেলেনি।
তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, ওই অশোক খামরাকে কাকা বলে ডাকত আদেশ। পুলিশের ধারণা, অশোকের ‘কাজ’ দেখেই অনুপ্রাণীত হয়েছিল আদেশ। তবে সে যে এক জন সাইকো কিলার তা নিয়ে পুলিশের কোনও সন্দেহ নেই।