না এ পথে আমি ট্রেনে (Train Station 12) উঠিনি। ট্রেনে করে এক দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অন্য দেশে পৌঁছে যাইনি। তবুও দুই বাংলার মাঝের এই রেল সম্পর্ককে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন ধরেই। কতটুকু আর সময় লাগে। কিন্তু যাব যাব করে আর যাওয়া হচ্ছিল না। বেশ কয়েকবছর আগে বাসে করে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। তখন এই পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত পেড়িয়ে যেতে হয়েছিল। তখনও ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি দুই দেশের মধ্যে। তবে সেই দেখা আর এই দেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। সেই সময় যেহেতু এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচ্ছিলাম সে কারণে নেমে ঘুরে, ফিরে দেখার অনুমতি ছিল না, স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তার কারণে। তবে এবার তো শুধুই সেই স্টেশনকে উপভোগ করতে যাওয়া, যেখানে শেষ হয়ে গিয়েছেন আমার দেশের একটা দিক। যেখান থেকে শুরু হয়েছে অন্য দেশ। এক সময় এই দুই দেশ এক ছিল। ছিল না কোনও কাঁটাতার, নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। এখন হয়েছে দুই বাংলা। এপার বাংলা, ওপার বাংলা। আমি এপার বাংলার স্টেশনে দাঁড়িয়ে ওপার বাংলার স্টেশন (বেনাপোল)-কে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। স্থানীয় মানুষরা বললেন, একইরকম দুই স্টেশন। তবে এপারের স্টেশনের তেমন কোনও কাজ নেই। জানা গেল যে ট্রেন বাংলাদেশ যায় বা আসে সে ট্রেন এই স্টেশনে দাঁড়ায় না। যা আইনি নিয়ম সব ওপাশেই সম্পন্ন হয় আর হয় কলকাতা স্টেশনে। তাই এই স্টেশন যেন সব সময়ই স্মৃতির দেওয়ালে গা এলিয়ে বসে থাকে।
সেটা একটা একাদশীর দুপুর। হঠাৎই মনে হল পেট্রাপোল যাব। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সকাল সকাল মধ্যমগ্রাম থেকে বনগাঁ লোকাল ধরে পৌঁছে গেলাম বনগাঁ স্টেশনে। এই বনগাঁ স্টেশনেও আমি এই প্রথমবার এলাম। তখনও পুজোর রেশ লেগে রয়েছে সর্বত্র। কোথাও বিসর্জনের প্রস্তুতি চলছে আবার কোথাও দাঁড়িয়ে রয়েছে খালি মন্ডপ। তবে বনগাঁ নয় লক্ষ্য যখন পেট্রাপোল তখন স্টেশন থেকে বেরিয়ে টোটো ভাড়া করে পৌঁছে গেলাম ভারতের শেষ স্টেশনের সামনে। পথটাও যেন একটু অন্যরকম। কোথাও সবুজের সমারোহ আবার কোথাও খানাখন্দে ভরা। এই সব পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। সাদামাটা এক স্টেশন বাড়ি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখে মনে হল তাদের বেশিরভাগ সময়ই কাটে এখানে। একদল মহিলা প্ল্যাটফর্ম চত্তরেই রান্নাবান্না সারছে। বাচ্চারা লাইনের উপর তাদের খেলার আসর জমিয়েছে। স্টেশন মাস্টারের ঘরে তালা ঝুলছে। আর যে অফিসঘরগুলো রয়েছে সেখানে কয়েকজনকে দেখা গেল। তাদের থেকেই জানতে পারলাম, এ স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ায় না। দাঁড়ালেও, এই স্টেশনে ওঠা-নামার নিয়ম নেই। শুনে বেশ হতাশই লাগল। দেশের শেষ স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ায় না কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো সেখানে কাউকে পাইনি। পরে জানতে পারি, যাত্রার সময় কমানোর জন্য ট্রেন ছাড়ার আগেই এদেশের যাবতীয় নিয়ম সেরে ফেলা হয় কলকাতা স্টেশনেই। আর ওদেশের কাজ হয় বেনাপোলে। তাই পেট্রাপোলের দায়িত্ব অনেক কম।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত এই স্টেশন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের স্টেশন। বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে সংস্থা দমদম থেকে বনগাঁ হয়ে খুলনা পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইন তৈরি করেছিল। যার উদ্বোধন হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। ১৭৪ কিলোমিটারের এই দীর্ঘ রেলপথ পূর্ব বাংলা রেলের সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯০৪-এ। ১৮৮৫-তে এই পথে চলত বরিশাল এক্সপ্রেস, যা শিয়ালদহ থেকে খুলনা পর্যন্ত যেত। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পরও এই রেল চলাচল বন্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এই লাইন বন্ধ হয়ে যায়। এর পর এই লাইন আবার চালু হয় ১৯৭২-এ, তবে সেই সময় শুধু মালবাহী ট্রেনই চলত। দু’বছর চলার পর তাও বন্ধ হয়ে যায় কারণ সেই পরিমাণ জিনিস আদান-প্রদান হচ্ছিল না, যাতে স্বাভাবিকভাবেই রেলের ক্ষতি হচ্ছিল। এর পর ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে আবার মালবাহী ট্রেন চলা শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে। এর বেশ কয়েক বছর পর শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেস। যা এই প্রজন্ম কাছ থেকে দেখেছে।
এই মৈত্রী এক্সপ্রেসের হাত ধরেই কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত যাত্রীবাহী এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল শুরু হল ৪৩ বছর পর। সেটা ২০০৮ সাল। আবার সচল হয়ে ওঠে সীমান্ত স্টেশন। এর পর ২০১৭ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় ট্রেন বন্ধন এক্সপ্রেস। সপ্তাহে একদিন চলত এই ট্রেন। পুরনো সেই বরিশাল এক্সপ্রেসের পথকে যেন জীবন্ত করে তুলেছিল এই ট্রেন। শিয়ালদহের বদলে এই ট্রেন ছাড়ত কলকাতা স্টেশন থেকে। যেত খুলনা পর্যন্ত। এর পর ২০২০ সালে কোভিডের কারণে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। কিন্তু ২০২২-এ আবার শুরু হয়ে এই দুই ট্রেনের যাত্রা।
এই রেল পথ বার বার ধাক্কা খেয়েছে বিভিন্ন কারণে। দুই বাংলা ভাগ হয়ে গেলেও এই রেল লাইন নির্দ্বিধায় মিলিয়ে রেখেছে দুই দেশকে। স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা ভাবতে ভাবতে এই স্টেশনের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করি। অবিভক্ত ভারতের এই অংশের রেল পথের ইতিহাসও ভীষনভাবে আকর্ষনীয়। বাবার কাছে ছোটবেলায় শোনা নামগুলো মাথার মধ্যে ছটফট করে ওঠে এই পেট্রাপোল সীমান্ত স্টেশনে দাঁড়িয়ে। যেন শুনতে পাই গোয়ালন্দ ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার শব্দ। বাবার কাছে শুনেছিলাম, সেই সময় ট্রেনে করে গোয়ালন্দ ঘাটে পৌঁছে সেখান থেকে লঞ্চে করে বাবারা দেশের বাড়ি যেতেন। ব্রিটিশ শাসন কালে কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ রুট বা গেদে-দর্শনা, চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটে নিয়মিত ট্রেন যোগাযোগ ছিল। সেই সময় ইস্টবেঙ্গল মেল যেত শিয়ালদহ থেকে গেদে, দর্শনা হয়ে পার্বতীপুর জংশন। এই পার্বতীপুর স্টেশনের কথা আলাদা করে লিখেছি। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। আরও একটি ট্রেন চলত নাম ইস্টবেঙ্গল এক্সপ্রেস, যা শিয়ালদহ থেকে গেদে, দর্শনা হয়ে যেত গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত। এই যাতায়াত চলে ১৯৬৫ পর্যন্ত। তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। এর পর ইস্ট পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি পায়। তার পর দীর্ঘ বিরতির পর আবার ট্রেন চলা শুরু হয়।
পেট্রাপোল সীমান্ত ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এই স্টেশন। সকালেই এই স্টেশন ছেড়ে যায় ট্রেন। তাই দুপুরের স্টেশনে নেই কোনও চাঞ্চল্য। কিন্তু পাশেই সরক পথের বর্ডারের ব্যস্ততা সব সময়ই তুঙ্গে। কত মানুষ হেঁটেই বর্ডার টপকে যাচ্ছে। দুই প্রান্তের বর্ডারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের পাসপোর্ট দেখে তাদের উল্টোদিকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে। গার্ডরেল দিয়ে কীভাবে ভাগ হয়ে গিয়েছে দুই দেশ, তা এখানে না এলে বোঝা মুশকিল। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ওয়াঘা বর্ডারে দেখেছিলাম বিশাল কালো গেট। দিনের মধ্যে একবারই খোলা হয়। যখন দুই দেশের স্বজনরা একে অপরের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়। ভারত বাংলাদেশ বর্ডার এর থেকে কিছুটা আলাদা। বেশ কিছুটা আন্তরিক। বর্ডারে আলাপ হল এক বিএসএফ জওয়ানের সঙ্গে। শিলিগুড়ির মানুষ হলেও পোস্টিং এখানে। প্রতিদিন কত মানুষকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে দেখেন তিনি তার হিসেব নেই। সবাইকে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা করে দিয়ে স্বস্তি পান। সঙ্গে দেশের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হয়।
আর যে ট্রেন একটার পর একটা স্টেশনকে সাক্ষী রেখে দেশের সীমান্তের গণ্ডি পেরিয়ে অন্য দেশে যায় মানুষকে পৌঁছে দিতে, সেই ট্রেনের বুকে জমে রয়েছে কত কত স্মৃতি। কত আবেগ, কত মিলন, কত বিচ্ছেদের সাক্ষী থাকে একটা ট্রেন। বিকেলের পড়ন্ত রোদে আরও একবার দেশের শেষ স্টেশন চত্তরে পা রাখি। সূর্য অস্ত যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে। শেষবেলার এক ফালি রোদ এসে পড়েছে অলস এই স্টেশনের গায়ে। পেট্রাপোল-বেনাপোলের গা ছুঁয়ে দূরে গাছগাছালির মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে রেল লাইন। আর একটু পড়েই ঝুপুৎ করে নামবে অন্ধকার। ঘুমের কোলে ঢলে পড়বে দুই সীমান্ত স্টেশন নতুন ভোরের অপেক্ষায়।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবর
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google