জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: নতুন বছরে তাঁর ব্যক্তিগত লক্ষ্য কী, তা গোপন রাখতে চান। কিন্তু দলের লক্ষ্য জানাতে দ্বিধা নেই ইস্টবেঙ্গল এফসি-র ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড ক্লেটন সিলভার। কী সেই লক্ষ্য? হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগের চলতি মরশুমে প্রথম ছয়ে থাকা। বাস্তববাদী ক্লেটন জানেন, দলের যা পরিস্থিতি, সেই অনুযায়ী কাজটা বেশ কঠিন। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস, তাঁরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করলে, এই কঠিন কাজটাও করা সম্ভব।
এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “ব্যক্তিগত লক্ষ্য তো রয়েছেই। কিন্তু সেটা নিজের মধ্যেই রাখতে চাই আমি। প্রতি মরশুন শুরুর সময়ই একটা লক্ষ্যস্থীর করি আমি। একটা লক্ষ্য থাকা ভাল। দলের লক্ষ্য সেরা ছয়ে থাকা। যদিও সেটা খুব কঠিন। তবে আমাদের দল যে রকম, তা সম্ভব। আমাদের আরও ধারাবাহিক হতে হবে। সামনের দুটো ম্যাচে আমাদের পয়েন্ট পেতেই হবে। পরের দুটো ম্যাচেই বোঝা যাবে, সত্যিই আমরা সেরা ছয়ে থাকতে পারি কি না”। মঙ্গলবার কলকাতায় সাংবাদিকদের সঙ্গে এক আড্ডায় কথাগুলি বলেন ব্রাজিলীয় তারকা।
তাঁর দল তেমন সফল না হলেও সাত গোল করে চলতি লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় তিনিই এখন সবার ওপরে। এগারো রাউন্ডের খেলা হয়ে যাওয়ার পরেও ইস্টবেঙ্গল এফসি লিগ তালিকায় নীচের দিকেই রয়েছে। প্রথম ছয়ে থাকতে পারেনি তারা।
‘এখনও সেরা এগারো নেই’
কেন এমন অবস্থা, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ক্লেটন বলেন, “দলটা নতুন, অনেক নতুন খেলোয়াড় আছে। বেশিরভাগই তরুণ, অনেকেই আইএসএল খেলেনি। তাই দলের ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন। একই স্তরের খেলোয়াড় থাকলে দল তৈরি করতে সুবিধা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য রকম। এখনও আমরা সেরা এগারোজনের দল তৈরি করে উঠতে পারিনি, যাতে আরও ধারাবাহিক হয়ে উঠতে পারি”।
এটাও ঠিক যে সুহের, লিমা, কিরিয়াকুর ধারাবাহিকতার অভাব সমস্যায় ফেলছে দলকে। এ ছাড়াও অনেক ছোটখাটো ব্যাপার আমাদের ঠিকঠাক করতে হবে। সেটপিসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হল, আমাদের ছেলেদের গড় উচ্চতা কম, যে সমস্যাটা বেঙ্গালুরু বা মুম্বইয়ের দলে নেই। সেই জন্যই সেটপিসে আমরা অতটা সফল হতে পারছি না”।
নিজেদের দলে যে বোঝাপড়ার অভাব রয়েছে, তা স্বীকার করে ক্লেটন বলেন, “কিছু কিছু ম্যাচে আমরা খুবই ভাল খেলেছি। এটিকে মোহনবাগান, ওডিশা, জামশেদপুরের বিরুদ্ধে আমরা ভাল খেলেছিলাম। সতীর্থদের কাছ থেকে ঠিকঠাক সাহায্যও পেয়েছিলাম। অ্যালেক্স, জর্ডনরা আমাকে পিছন থেকে ভালই সাহায্য করে। কিন্তু ধারাবাহিকতার অভাব থেকে যাচ্ছে। খেলোয়াড়দের মধ্যে বোঝাপড়া আরও উন্নত করে তুলতে হবে। তবে এখন আমরা ঠিকঠাকই এগোচ্ছি”।
সমস্যাগুলির সমাধান সম্ভব কি না, জিজ্ঞাসা করলে হিরো আইএসএলে ২৩ গোলের মালিক বলেন, “আমাদের অনুশীলনে এই সমস্যাগুলোকে মিটিয়ে নিতে হবে। আমাদের কোচ (স্টিফেন কনস্টান্টাইন) ভারতীয় ফুটবল ও ফুটবলারদের খুব ভাল বোঝেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কোচ তরুণ ভারতীয় ফুটবলারদের যথেষ্ট খেলার সুযোগ দেন। যেমন নাওরেম মহেশ, লালচুঙনুঙ্গা দু’জনেই যথেষ্ট খেলার সুযোগ পেয়েছে। ওদের যথাসম্ভব বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করা দরকার। শৌভিক, পাসিদেরও এই অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। হীমাংশু জাংরাও যথেষ্ট প্রতিভাবান। ওকে আরও ফোকাস করতে হবে। তবে প্রত্যেককেই আরও বেশি ম্যাচ খেলতে হবে”।
‘এখানে অনেক স্বাধীন আমি’
হিরো আইএসএলে এইরকম দল নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে সাফল্য পাওয়া যে সম্ভব না, তা জানিয়ে বেঙ্গালুরু এফসি-র প্রাক্তন তারা ফরোয়ার্ড বলেন, “এ বারের আইএসএলে খুব ভাল ভাল দল রয়েছে। প্রত্যেকেই ভাল খেলছে। আইএসএলে এক একটা ম্যাচ জেতা বেশ কঠিন কাজ। প্রচুর ওঠানামা হচ্ছে। ওডিশা এখানে আসার আগে তিনটে ম্যাচে জিততে পারেনি। অথচ দেখুন, এখানে কত ভাল খেলল। এখানে দু-তিনটে ম্যাচ জেতার পরেও দু-তিনটে ম্যাচে হারতে পারে যে কোনও দল। মুম্বই, হায়দরাবাদ দুটো সেরা দল। কিন্তু বাকি দলগুলোর মধ্যে অনেক ওঠানামা হবে বলেই মনে হচ্ছে”।
গত বছর ইস্টবেঙ্গল এফসি-তে যোগ দেওয়ার আগে ক্লেটন গত দুই মরশুমে খেলেন বেঙ্গালুরু এফসি-র হয়ে। প্রথম মরশুমে (২০২০-২১) তিনি ১৮ ম্যাচে সাতটি গোল করেন ও চারটি গোল করান। গত মরশুমে ১৯টি ম্যাচে ন’গোল ও তিনটি অ্যাসিস্ট ছিল তাঁর। এ বার ১১ ম্যাচেই সাত গোল করে ফেলেছেন।
আগের ক্লাবের ভূমিকার সঙ্গে এই ক্লাবের ভূমিকার তফাৎ নিয়ে ৩৫ বছর বয়সি ফরোয়ার্ড বলেন, “বেঙ্গালুরু এফসি-তে আমি একজন নিখুঁত নাম্বার নাইনের ভূমিকা পালন করতাম, বিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারের মাঝখানে। কিন্তু এখানে আমি অনেকটা জায়গা জুড়ে খেলার স্বাধীনতা পাই। এ ভাবেই খেলা বেশি পছন্দ আমার। বেঙ্গালুরু দলে অনেক ভাল ভাল খেলোয়াড় আমার সঙ্গে খেলত। সেরা চারে পৌঁছনোর মতো দল ছিল আমাদের। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তা পারিনি”।
লাল-হলুদ বাহিনী এখন অনেকটাই তাঁর মুখাপেক্ষী। ক্লেটন সিলভা ভাল খেললে ইস্টবেঙ্গল ভাল খেলে। যে দিন তাঁর ফর্ম ভাল থাকে না, সে দিন দলও সফল হয় না। এই নির্ভরতায় তাঁর কোনও বিরক্তি নেই। বরং উপভোগই করেন বলে জানালেন। বলেন, “দলের জন্য চাপ নিতে আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি এখানে সই করার সময় থেকেই জানি যে আমাকে এখানে সেরাটা উজাড় করে দিতে হবে। এটা আমার কাজ। কিন্তু কঠিন কাজ নয়। বরং দলের সাফল্যে অবদান রাখতেই ভাল লাগে”।
‘ডার্বি জেতার মানসিকতা চাই’
কলকাতার সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডায় ডার্বির প্রসঙ্গ আসবে না, তা আবার হয়? অবধারিত ভাবে তা এলও। সাতবারের হারের পর এ বার লাল-হলুদ সমর্থকদের প্রবল চাহিদা, ডার্বি জিততেই হবে। সম্ভব কি না, জানতে চাওয়া হলে আত্মবিশ্বাসী ক্লেটন বলেন, “ডার্বি জিততে গেলে সবার আগে আমাদের নিজেদের ওপর আস্থা রাখতে হবে যে, আমরাও পারি। ওরা সাতটা ম্যাচ জিতেছে বলে এ বারও জিতবে, তার কোনও মানে নেই। আমাদের জেতার মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এরপর বুঝতে হবে ওরা কী ভাবে খেলে”।
এটিকে মোহনবাগান দলের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “ওদের ভাল ভাল খেলোয়াড় আছে। আইএসএল বা ডার্বি খেলার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ওদের আছে। আমাদের সমর্থকেরাও খুবই উদগ্রীব। তাদের সঙ্গে দেখা হলেই সবার আগে প্রশ্ন করে, ডার্বি কবে জিতব? কিন্তু এটিকে মোহনবাগানের মতো ক্লাবকে হারানো বেশ কঠিন। তবে ২৫ ফেব্রুয়ারি যখন ফের মুখোমুখি হব আমরা, তখন অবশ্যই জেতার চেষ্টা করব”।
লাল-হলুদ শিবিরে এখন সবচেয়ে হিট জুটি নাওরেম মহেশ ও ক্লেটন সিলভা, যাদের জুগলবন্দিতে একাধিক গোল পেয়েছে ইস্টবেঙ্গল এফসি। তাঁদের এই রসায়নের রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্লেটন বলেন, “মাঠে মহেশ ও আমি সব সময়ই কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করি। ও যখনই বল নিয়ে ওঠে, ড্রিবল করে, তখনই আমি ওকে অনুসরণ করি, যাতে ও আমাকে বল দেয়। ওকে যথাসম্ভব কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। সব সময় ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। এই ভাবেই আমরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি এবং এটাই গোলের ক্ষেত্রে কাজে আসে”।
বছরের শেষ ম্যাচে এক অসাধারণ ফ্রি কিকে চলতি লিগে এখন পর্যন্ত সেরা গোলটি করেন ক্লেটন। গত শুক্রবার বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচের শেষ মুহূর্তে বক্সের সামনে, গোল লাইনের প্রায় ২৬ মিটার (২৮ গজ বা ৮৫ ফুট) দূর থেকে থেকে সোজা গোলে ফ্রি কিক নেন ক্লেটন, যা গোলের ডানদিকের ওপরের কোণ ঘেঁষে জালে জড়িয়ে যায়। বেঙ্গালুরুর গোলরক্ষক গুরপ্রীত সিং সান্ধু বলে হাত লাগিয়েও আটকাতে পারেননি।
সেই গোল প্রসঙ্গে গোলের নায়ক বলেন, “ওই গোলটাতে আমি ফোকাসড ছিলাম। এই ধরনের ফ্রি কিকগুলো বেশ কঠিন হয়। নিজের ওপর আমার আস্থা ছিল। অনুশীলনে আমি ওই ধরনের গোল আগেও করেছি। নিয়মিত অনুশীলন করি”।
‘ভারতীয় ফুটবলাররা পরিশ্রমী, শিখতে চায়’
হিরো আইএসএলে এই নিয়ে তাঁর তৃতীয় মরশুম। এই কয়েক বছরে এই লিগের খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেক উন্নতি দেখেছেন বলে জানান তাইল্যান্ড, চিন, মেক্সিকোর ক্লাব ফুটবলে খেলে আসা এই তারকা। বলেন, “আইএসএলের খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেক উন্নতি লক্ষ্য করেছি। ভারতীয় খেলোয়াড়রা শিখতে ও পরিশ্রম করতে ভালবাসে। অন্য জায়গায় দেখেছি, তরুণদের প্রতিভা থাকলেও তাদের পরিশ্রমের ইচ্ছে থাকে না। কিন্তু ভারতীয় তরুণরা যথেষ্ট পরিশ্রমী। খেলার সুযোগ না পেলেও তারা জিমে গিয়ে ঘম ঝরায়, পরিশ্রম করে। ওরা উন্নতি করতে চায়। কিন্তু ওদের আরও ম্যাচ খেলার সুযোগ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আইএসএলে ১১টি নয়, অন্তত ১৫টি ক্লাব প্রয়োজন। পরিকাঠামো, মাঠ এ সবের দিক থেকেও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আমি যখন চিনে খেলতাম, তখনও এ রকম পরিকাঠামো দেখেছি”।
তাইল্যান্ডের বেক টেরো সাসানা ক্লাবে পেশাদার ফুটবল কেরিয়ার শুরু যাঁর, তিনি এখন ভারতীয় ফুটবলে নায়ক। ২০২০-র জুনে ভারতে আসার সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্লেটন বলেন, “ভারতে এসেছিলাম মূলত অর্থের জন্যই। কিন্তু এখানে আসার আগেও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তারা খুব ভাল ধারণা দিয়েছিল আমাকে। ২০১৮-য় বেঙ্গালুরু থেকে প্রথম প্রস্তাব আসে আমার কাছে, তখন আমি তাইল্যান্ডে খেলছিলাম। ওখানে মরশুম শেষ করার পরে আমার মনে হয়, ওখানে আমার আর কিছু দেওয়ার নেই, এ বার অন্য জায়গায় যাওয়া উচিত। নতুন একটা দেশে যেতে চাইছিলাম। এখানকার ভিডিও দেখে দেশটাকে খুব ভালও লেগে গিয়েছিল আমার। তাই ভারতে আসার সিদ্ধান্ত নিই”।
দেশের ফুটবলে খেলতে না পারলেও আফসোস নেই তাঁর। ফুটবলজীবনে আর দেশে ফিরতেও চান না অভিমানী ক্লেটন। তবে এখানকার লাল-হলুদ সমর্থকদের মধ্যে দেশের ফুটবলপ্রেমীদের ছায়া দেখতে পান তিনি। বলেন, “ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকেরা অনেকটা ব্রাজিলের সমর্থকদের মতো। ওরা সব সময় চায় দল জিতুক। রাস্তায় ধরে সেই আব্দারই করে। দল হারার পরে এক সমর্থক আমাকে বলেছিল, তুমি ব্রাজিলে ফিরে যাও। ওরা এ রকমই আবেগপ্রবণ। চিনের ফুটবলপ্রেমীরা এতটা ছটফটে নয়, শান্তশিষ্ট। তবে এখানকার সমর্থকদের আমার খুব ভাল লাগে। বেঙ্গালুরুর সমর্থকদের চেয়েও ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা বেশি হইচই করতে ভালবাসে”।
ফুটবলের এই আবেগ, ভালবাসা, আন্তরিকতার মধ্যেই যে থাকতে চান তিনি, তাও এই আড্ডায় স্পষ্ট জানিয়ে দেন ব্রাজিলের নতুন চিতা।
(লেখা আইএসএল ওয়েবসাইট থেকে)
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google