জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: বর্তমান ভারতের পতাকা, যা নিয়ে আমরা গর্বিত, তা এক দিনে তৈরি হয়নি। বদলেছে অনেক বার। বদলেছে রং, বদলেছে আকার। বদলেছে পুরোটাই। স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে ১৯৪৭ পর্যন্ত— বার বার বদল হয়েছে ভারতীয় পতাকার। ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে ভারতীয় পতাকারও এক লম্বা ইতিহাস। আজ ৭২তম স্বাধীনতা দিবসে ফিরে দেখা যাক ভারতের জাতীয় পতাকার সেই ফেলে আসা ইতিহাসকে। বর্তমান জাতীয় পতাকা বানিয়েছিলেন পিঙ্গালি বেঙ্কাইয়া। যেখানে তিন রংকেই সমান জায়গা দেওয়া হয়েছে।
১৯০৪-০৬: স্বাধীনতা পাওয়ার আগেই তৈরি হয়েছিল ভারতের পতাকা। সেটা ১৯০৪ থেকে ’০৬ এর মধ্যে। তৈরি হল প্রথম ভারতীয় পতাকা। যা বানিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের এক আইরিস শিষ্য। তিনি আর কেউ নন ভগিনী নিবেদিতা। একটা সময়ের পর এই পতাকাকে সিস্টার নিবেদিতার পতাকা বলেই জানত লোকে। এই পতাকায় ছিল লাল ও হলুদ রং। মাঝে বাংলায় লেখা ছিল বন্দে মাতরম্। পতাকার মধ্যে ছিল ইন্দ্রের হাতে থাকা বজ্র সঙ্গে সাদা পদ্ম মাঝখানে। এই পতাকার ছবি পাওয়া যায় না।
১৯০৬: এর পর ভগিনী নিবেদিতার পতাকার আদলেই তৈরি হয় নতুন পতাকা। লাল-হলুদের সঙ্গে যুক্ত হয় সবুজ রং। সেটা ১৯০৬ সাল।ঠিক এখনকার মতো তিন রঙের সমান লাইনে। সবুজ ছিল সবার উপরে। সেখানে ছিল আটটি সাদা পদ্ম। মাঝের হলুদে দেবনগরী ভাষায় লেখা ছিল বন্দে মাতরম্। আর লালের উপর ছিল দুটো ছবি। একটি সূর্য ও অন্যটি তারা।
সেই বছরেই বদল হয় জাতীয় পতাকার। সেখানেও তিন রং ছিল। কিন্তু সবুদ বদলে করে দেওয়া হয় কমলা। সেই সময় সেই পতাকাকে কলকাতার পতাকা (ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ অথবা লোটাস ফ্ল্যাগ) বলা হত। এই পতাকার উপরে ছিল কমলা রং। সেই কমলা রঙের উপর রয়েছে আটটি তারা। মাঝের হলুদে লেখা বন্দে মাতরম্। নীচের সবুজে ছিল তারা আর চাঁদ। ১৯০৬ এর ৭ অগস্ট কলকাতার পার্সি বাগান স্কোয়্যারে এই পতাকা তোলা হয়েছিল। এই পতাকা তুলেছিলেন স্যর সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। উপলক্ষ ছিল ভারত-পাকিস্তান ভাগের বিরোধিতা করা। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বয়কট ডে’।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শহড় জুড়ে কড়া নজরদারি, আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা ব্যবস্থা
১৯০৭: এক বছর পর আবার বদলে গেল ভারতের জাতীয় পতাকা। ১৯০৭-এ যে পতাকা এল তা পরিচিত ছিল ভিকাজি রুস্তম কামা’স ফ্ল্যাগ বলে। যে পতাকা ডিজাইন করেছিলেন ভিকাজি কামা, বীর সাভরকর ও কৃষ্ণা বর্মা। এই বছর ২২ অগস্ট জার্মানির স্টুটগার্টে এই পতাকা তোলেন ভিকাজি কামা। এটাই ছিল বিদেশের মাটিতে প্রথম ভারতের পতাকা উত্তোলন। এই পতাকা এর জন্য ‘বার্লিন কমিটি ফ্ল্যাগ’ নামেও পরিচিত। সেই পতাকায়ও ছিল তিন রং। উপরে ছিল সবুজ, তার পর সোনালি গেরুয়া আর একদম নীচে লাল রং।
১৯১৬: আগের পতাকা চলেছিল দীর্ঘ দিন। এর পর বদল হল ১৯১৬তে। পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া এক জন লেখক ও জিওফিজিস্ট সেই পতাকা তৈরি করেছিল পুরো ভারতকে এক ছাতার তলায় আনার জন্য। মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তৈরি করতে হয়েছিল সেই পতাকা। তখন মহাত্মা গান্ধী পতাকায় চক্র রাখার কথা বলেছিলেন। খাদির উপর হাতে সেই পতাকা তৈরি করেছিলেন পিঙ্গালি। সেখানে দুটো রং লাল এবং সবুজের মধ্যে ছিল চক্র। মহাত্মা গান্ধী সেই পতাকাকে সবুজ সঙ্কেত দিলেন না। কারণ, সবুজ মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করছে, লাল হিন্দুদের। কিন্তু এই ভারতে অন্য জাতির মানুষও রয়েছে। তার প্রতিফলন এই পতাকায় নেই।
১৯১৭: এক বছর পতাকা তৈরিতে এগিয়ে এলেন বাল গঙ্গাধর তিলক। তিনি একদম অন্য ধরনের পতাকা বানালেন। যেখানে রেখে দিলেন ব্রিটিশ পতাকার একটা অংশ। পতাকার শীর্ষে বাঁ দিকে থাকল ব্রিটিশ পতাকা, পুরো পতাকা জুড়ে থাকল পাঁচটি লাল দাগ ও চারটি সবুজ দাগ। মাঝখানে রাখা হল সপ্তর্ষীমণ্ডল। মাথার ডান দিকে রাখা হল চাঁদ। কিন্তু মানুষের কাছে এই পতাকা সেই জায়গা করে নিতে পারেনি।
১৯২১: এর পর আবার বদলে যায় ভারতীয় পতাকা। সরে যায় ব্রিটিশ পতাকার ছবি। সেই জায়গা দখল করে মহাত্মা গান্ধীর চরকা। গান্ধী চাইতেন দেশের সব জাতি যে এই পতাকার প্রতিনিধি হতে পারে। এখানেও তিনটি রং রাখা হয়েছিল। একদম উপরে ছিল সাদা। মাঝে সবুজ ও নীচে লাল। পুরো পতাকা জুড়েই ছিল চরকা। এই পতাকা অনেকটা আয়ারল্যান্ডের পতাকার মতন ছিল। সেই সময় ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পেতে লড়াই করছিল আয়ারল্যান্ডও। কিন্তু কংগ্রেস কমিটি এই পতাকাকে সরকারি স্বীকৃতি দিল না। এই পতাকা ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটা প্রতীকী হয়ে থাকল।
১৯৩১: এ বার আবার ফিরে এলেন পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া। তার হাতেই উঠল ভারতের নতুন পতাকা তৈরির দায়িত্ব। পতাকা থেকে সরে গেল লাল রং। সেখানে এল গেরুয়া। সব জাতিকে সন্তুষ্ট করতে তৈরি হল নতুন পতাকা। গেরুয়া থাকল একদম শীর্ষে। মাঝে সাদা। আর একদম নীচে সবুজ। চরকার মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হল একদম মাঝখানে সাদার উপর। সেই বছরই কংগ্রেস কমিটির মিটিংয়ে এই পতাকাকে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হল। তুলে ধরা হল সরকারি পতাকা হিসেবে।
১৯৪৭: স্বাধীনতা পেল ভারত। রাজেন্দ্র প্রসাদের নেতৃত্বাধীন কমিটি জাতীয় পতাকা নির্বাচন করল স্বাধীন ভারতের। কমিটি সিদ্ধান্ত নিল যে পতাকা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করবে। বেছে নেওয়া হল ১৯৩১-এর পতাকাকেই। কিন্তু একটা ছোট্ট বদল করা হল সেই পতাকায়। মাঝের চরকা বদলে করে দেওয়া হল চক্র। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটাই ভারতের পতাকা।
১৮৫৮-১৯৪৭: ভারতের পতাকা বার বার বদলেছে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন কালের পুরো সময়টাই ব্রিটিশ শাসিত ভারতে চলেছে আরও একটি পতাকা। যা ছিল ব্রিটিশদের বানানো। সেই পতাকা ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশের পতাকার আদলেই। কিছুটা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো। লালের উপর বাঁ দিকের মাথায় ব্রিটিশ পতাকা। ডান দিকে মাঝামাঝি তারা যেটা রাজাদের মুকুটে থাকত।