কার্শিয়াঙে ভূত আছে শুনেছি, কিন্তু কখনও থাকিনি বলে বুঝে উঠতে পারিনি। সময়টা ২৮ বছর আগের। যে রাতগুলো কেটেছিল কার্শিয়াঙের রেলের গেস্ট হাউসে। অনুভব করেছিলাম অদ্ভুত এক অস্তিত্বের। লিখলেন সুচরিতা।
ছুটি মানেই শিলিগুড়ি আমাদের বাধাই ছিল। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে সোজা চলে যাওয়া অরবিন্দ পল্লিতে জেঠুর বাড়ি। তখন জেঠুর রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় বাবাদের ভাই-বোনদের জমিয়ে আড্ডা বসত। আমরা গেলে তো কথাই নেই। আর স্কুল ছুটি মানেই সবাই এক জায়গায়। সেটা ১৯৯২। আমার মাধ্যমিকের পর, ছুটি কাটাতে পৌঁছে গিয়েছিলাম শিলিগুড়িতে জেঠুর বাড়িতে। প্রায় ১০-১২ দিনের প্রোগ্রাম। প্রথম সন্ধের আড্ডাতেই ঠিক হয়ে গেল পাহাড় যাওয়ার কথা।
জেঠু নর্থ ফ্রন্টিয়ার রেলের বড় অফিসার। তাই পুরো দার্জিলিং জেঠুর হাতের মুঠোয় তখন। ভিড়ে ঠাসা দার্জিলিঙে না গিয়ে জেঠু বলল, কাশিয়াঙে থাকার কথা। ছিমছাম সুন্দর পাহাড়ি জনপদ, আমারও খুব পছন্দের। আর পাহাড় হলেই হল। কোথায় থাকা হবে প্রশ্ন উঠতেই জেঠু ফোন ঘুরিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই কার্শিয়াঙের রেলের গেস্ট হাউসটা পুরো বুক করে ফেলল।
এক সকালে আমরা ছয় পরিবার বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে। ক’টা গাড়ি ছিল মনে নেই। আমার দুই জেঠু-জেঠিমা, দুই কাকু-কাকিমা, এক পিসি-পিসেমশাই আর আমরা একদল ভাই-বোন।
পাহাড়ি পাকদণ্ডিতে ঘুরতে ঘুরতে সকাল সকালই পৌঁছে গেলাম কার্শিয়াঙের সেই বাংলোর সামনে। শহর থেকে অনেকটা উপরে। ত্রিসীমানায় কিছু নেই। দোতলা বাড়িটার প্রতিটি কোণায় ব্রিটিশ স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট। দোতলায় থাকার জায়গা আর এক তলায় রান্না ঘর আর বিরাট ডাইনিং হল। দারুণ করে সাজানো সব।
সকালের লুচি-তরকারি নিয়ে তৈরিই ছিলেন সেখানকার কুক। জমিয়ে ব্রেকফাস্ট করে সবাই যে যার ঘরে গেলাম। তত ক্ষণে লাগেজ পৌঁছে গিয়েছে সব ঘরে ঘরে। খুব বেশি ঘর না থাকায় এক একটা ঘরে দুটো করে পরিবার। কেউ খাটে, কেউ নীচে বিছানা পেতে।
ওখানে পৌঁছনোর পর থেকেই মনটা বাংলোর পিছন দিকে বার বার টানছিল। ঘন বড় বড় গাছের জঙ্গল, তবে পরিষ্কার। কী গাছ ছিল এখন আর মনে নেই। তবে যত দিন ছিলাম সারা ক্ষণ সেখানে কুয়াশা আর মেঘ দেখেছি। কখনও পরিষ্কার দেখিনি। যখন চার দিকে রোদ, তখনই সেই জঙ্গল মেঘে ঢাকা। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। পুরো গেস্ট হাউসে মনে হয় সেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডায়াল করা একটা ফোন ছিল। সেটা সচরাচর বাজত না। তাই ঘরে ঢুকে পড়লে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে বেরিয়ে তার ঘরে গিয়ে নক করতে হবে।
তখন একা একা ঘরের বাইরে যাওয়ারও অনুমতি ছিল না। দারুণ লাঞ্চের পর বাংলোর পিছনে যাওয়ার ইচ্ছের কথাটা লাঞ্চ টেবিলেই জানিয়ে ফেললাম। জেঠু-জেঠিমা সঙ্গে কুক ও তার হেল্পার রীতিমতো রে রে করে উঠল। আমি তো অবাক, ভাবলাম এমন কী বলে ফেললাম! সব শান্ত হলে জেঠু যাতে ভয় না পাই সেই মতো করে বলল, ‘‘আসলে এখানে ওই পিছনে কেউ যায় না। মানুষ যায় না ওখানে। ভাল না, খুব অন্ধকার তো।’’
কাশিয়াঙ রেল স্টেশন
আমার বোধগম্য হতে বেশ সময় লাগল। কুক পরে সরাসরি বলেই ফেলল, ‘‘এখানে ভুত আছে। রাতে টের পাবেন।’’
ভূত! আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। তাই আর কিছু বললাম না। অনুমতি নেই বুঝে গেলাম। রাতের খাবার খেয়ে এক ঘরে বসে অনেক ক্ষণ আড্ডা চলল। রাতের খাওয়া পাহাড়ে ৮টার মধ্যে হয়ে যায়। তখন জেঠু জানাল, আমাদের ঘরের বাইরে দিয়ে যে টানা ব্যালকনি, রাতে সেখানে কেউ হেঁটে বেড়ায়। পায়ের শব্দ শোনা যায়। তবে কেউ বেরিয়ে দেখার সাহস করেনি। যাওয়ার সময় বলে গেল, যেন আমরাও সেই চেষ্টা না করি।
১০টা নাগাদ সবাই সবার ঘরে চলে গেল শুতে। শোওয়ার কিছু ক্ষণ পরেই শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম, আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকলেরই প্রায় ঘুম ভেঙে গিয়েছে। এবং বাইরে সেই হাঁটার শব্দ স্পষ্ট কানে আসছে। যেন কেউ পায়চারি করছে। কখনও শব্দটা আস্তে আস্তে দূরে যাচ্ছে, আবার কখনও মনে হচ্ছে আমাদের দরজার সামনে এসে থেমে যাচ্ছে। সেই প্রথম ভূতে ভয় পেয়েছিলাম। সারা রাত কেউ ঘুমোতে পারিনি। লেপ-কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়েছিলাম সবাই। বাবাকে টেনে ধরে রেখেছিলাম। না হলে এতটাই অত্যধিক সাহস যে ভূত ধরতে বেরিয়ে পড়ত।
কাশিয়াঙ শহর
সকালে সবার দেখা হল ব্রেকফাস্ট টেবিলে। ব্রেকফাস্ট করে আমাদের দার্জিলিঙে যাওয়ার কথা। আজ পুরো দিনটা ওখানেই কাটাব। লাঞ্চও দার্জিলিঙেই। ব্রেকফাস্ট টেবিলে কেউ খুব একট কথা বলছে না। সবার মুখ কেমন একটা থমথমে। বোঝাই যাচ্ছে, কাল রাতের ঘটনা সবাই টের পেয়েছে। কুক আমাদের মুখ দেখে বুঝতে পেরে বলল, ‘‘ভয় পাবেন না। বাইরে বেরোবেন না, তা হলেই হবে। ওদের ডিস্টার্ব না করলে, ওরাও কাউকে বিপদে ফেলে না। আর দরজায় কেউ টোকা দিলে বা কোনও বাড়ির লোকের গলা পেলেও দরজা খুলবেন না।’’ তবে দরজায় টোকা পড়েনি, কেউ ডাকেওনি।
খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল ওরাটা কারা? কিন্তু করতে পারলাম না। দার্জিলিং ঘুরে সবার মুড একদম চাঙ্গা হয়ে গেল। সেখানেই ঠিক করলাম আজ গেস্ট হাউসে ফিরে গেলেও পরদিন দার্জিলিঙে থেকে পর দিন ফিরব। সেই রাতেও একই শব্দের সঙ্গে রাত কাটল। সঙ্গে যেন এক অদ্ভুত ভয়ের অনুভূতি। যেন রাতটা কাটলেই বাঁচি।
এভাবেই মেঘে ঢেকে থাকে সেই জঙ্গল
পরদিন সকালে দার্জিলিং। প্রসঙ্গত বলে রাখি, কার্শিয়াঙের ডাওহিল ভূতের জায়গা হিসাবে বিখ্যাত। সঙ্গে এখানকার ভিক্টোরিয়া স্কুল। ডাওহিলের সামনের রাস্তাটা ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধ, শ্বাস ফেললেও শোনা যায়। ওখানে অনেকেই অনেক কিছু অনুভব করেছে বা দেখেছে বলে শোনা যায়।
২০১৫তে তার পর আবার গিয়ে কার্শিয়াঙে থেকেছিলাম। তবে এ বার একটি চা বাগানে আমি আর মা। সিঙ্গল চা বাগানের মধ্যে একটা হোম স্টে-তে। ওই বাড়ির মালিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম রেলের গেস্ট হাউসের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এখন সরকারি অফিস হয়ে গিয়েছে ওটা। তবে অন্ধকার হওয়ার আগে বন্ধ করে সবাই নেমে আসে ওখান থেকে।’’
(সেই সময় ক্যামেরা, মোবাইল ক্যামেরা কিছুই ছিল না তাই কোনও ছবি সংগ্রহে নেই। নেট ঘেটেও সেই বাড়িটির ছবি পেলাম না তাই দিতে পারলাম না।)
(একটু অন্য ধরনের অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)
(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)