বেগুনকোদর বিশ্বের এক নম্বর ভুতুড়ে রেলস্টেশন নামে বিখ্যাত। সেখানে এক রাত কাটানোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা জাস্টদুনিয়ার পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন জিকো রায়, আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
ঘটনাটা হলো বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের। এখানে একজন বিত্তশালী বাসিন্দা ছিলেন। স্থানীয় সাঁওতাল উপজাতির নেত্রী লাছান কুমারী। তিনি তার জমির একটি বড় অংশ সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য সরকারের হাতে তুলে দেন। ১৯৬০ সালে ভারতীয় রেল সেখানে গড়ে তোলে বেগুনকোদর রেল স্টেশন। রেলওয়ে ট্র্যাক এবং রেল ইঞ্জিনের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে গোটা এলাকা। শুরু হয় লোকজনের সমাগম। রেলকর্মীদের থাকার জন্য কোয়ার্টার তৈরী হয়। স্টেশন লাগোয়া অঞ্চলে বাজারও বসে। জমজমাট হয়ে উঠে বেগুনকোদর। কিন্তু হঠাৎই সমস্যার সূত্রপাত হয় ১৯৬৭ থেকে। শোনা যায়, তৎকালীন স্টেশনমাস্টার রাতের অন্ধকারে স্টেশন চত্বরে সাদা শাড়ি পরিহিত এক অশরীরীকে দেখতে পান। অথচ কাছে গেলে কেউ নেই। এ কথা তিনি স্থানীয়দের জানান। কিন্তু তার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। কদিন পরেই সেই স্টেশনমাস্টার ও তাঁর স্ত্রীর মৃতদেহ একটি পাতকুয়োর মধ্যে পাওয়া যায়।
শুরু হয় আতঙ্ক। তারপর থেকে বহু মানুষ সাদা শাড়ি পড়া মহিলাকে স্টেশনে দেখতে পেয়েছেন কিন্তু কাছে গেলেই ভ্যানিশ। ব্যাস, রাতারাতি চাউর হয়ে যায় যে স্টেশনে ভুত আছে। রেলকর্মীরা সব পালিয়ে যান। স্থানীয় এলাকায় বেশ কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে শুরু করে। কারও বাড়িতে আগুন লেগে যায়, কারও বাড়ি থেকে বাচ্চা চুরি হয়ে যায় এবং সবাই ধরে নেন যে এটি সেই সাদা শাড়ি পরিহিত মহিলার কাজ। সবাই ধিরে ধিরে ভুতের অস্তিত্ব টের পেতে শুরু করে। বন্ধ হয়ে যায় বেগুনকোদর স্টেশন।
১৯৬৭ থেকে ২০০৯ দীর্ঘ ৪২ বছর এই স্টেশনে ট্রেনের যাতায়াত বন্ধ ছিল। এক সাদা শাড়ি পরিহিত মহিলার আগমনে যে স্টেশন একদিন বন্ধ হয়ে গেছিল ২০০৯-এ নতুন করে চালু হয়। তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বেগুনকোদরে রেল চলাচলের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু রেল চললেও প্যাসেঞ্জার নেই। গুটিকয়েক লোক সারাদিনে যাতাযাত করে। সারাদিনে চার-পাঁচটি ট্রেন থামে। সব গুলোই প্যাসেঞ্জার হল্ট। লাস্ট ট্রেন থামে বিকেল ৫.৫০-এ। ”
এই ছিল বেগুনকোদর হন্টেড হওয়ার ইতিহাস।
ততক্ষণে অন্ধকার নেমেছে স্টেশন চত্তরে। আবার একটা ট্রেন চলে গেলো। হঠাৎ অন্ধকারে ঘাড়ে কার যেন শীতল হাতের স্পর্শ পেলাম। লাফিয়ে উঠলাম। বন্ধু বলল, ‘‘কী হলো!’’ আমি বললাম, ‘‘কে যেন ঘাড়ে ঠান্ডা হাত রাখলো।’’ বন্ধু বলল, ‘‘আরে ওটা আমার হাত।’’ আমি বললাম, ‘‘সেটা বলবি তো যে হাত রাখছি।’’ বন্ধু বলল, ‘‘ঘাড়ে হাত রাখবো তার জন্য আবার বলে নিতে হবে।’’ আমি বললাম, ‘‘হ্যা হবে। যতক্ষণ এখানে আছি ততক্ষন হবে।’’
ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চললো। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে। খিদে পেয়েছে। সময় দেখলাম প্রায় ১০টা। ব্যাগ থেকে বিস্কুট বার করে খেলাম। বিস্কুটের প্লাস্টিকটা পাশে রাখলাম। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এলাম। সাহস করে একটু আধটু আলো ফেলে ভিডিও করতে লাগলাম। বন্ধু বলল, ‘‘চল আশপাশটা একটু দেখি।’’ ভয় হচ্ছিলো। ভুতের নয়। সরীসৃপের, যা অন্ধকার আর খোলা মাঠ! কোথায় কী থাকবে কে জানে !
বেগুনকোদর ভুতুড়ে হওয়ার ঘটনাটি জনমুখে প্রচারিত এবং ইন্টারনেটে থেকে সংগৃহীত। আমরা নিজেরা তৈরি করিনি।
ভুত দেখিনি, ভয় পেয়েছি। সাদা শাড়ি পড়া কাউকে দেখিনি, স্টেশনের দেওয়ালে নীল-সাদা রং দেখেছি। ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখেছি, পর্যাপ্ত আলোর অভাবে।
রাতে না থাকার নিয়মবিধি লঙ্ঘন করার জন্য সকলের কাছে বিশেষ করে পুরুলিয়া ও বেগুনকোদরবাসীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
শুনেছি এখন প্রায় রাত ১০টা পর্যন্ত স্টেশনে ট্রেন থামে যা অত্যন্ত খুশির খবর।
পরে জেনেছিলাম জায়গাটার ভুতুড়ে তকমা ব্যবহার করে সেখানে সমাজ বিরোধীরা নানান কার্যকলাপ চালায়। আমাদের ভাগ্য ভাল সেদিন বৃষ্টি হওয়ায় তাদের দেখা মেলেনি। দেখা মিললে কি হত জানি না। যদিও আমার ব্যাগে একটা ছুরি ছিল আত্মরক্ষার জন্য।
স্থানীয় মানুষরা যত বেশি সাহসিকতার পরিচয় দেবে বেগুনকোদর ততো তাড়াতাড়ি ভুতুড়ে তকমা থেকে মুক্তি পাবে সঙ্গে প্রয়োজন সরকারি সাহায্যের।
স্টেশনমাস্টার দুলু মাহাতো দিনের আলোয় আমাদের চিনতে পারেননি। না হলে ওখানেই দু’ঘা লাগিয়ে দিতেন।
সমগ্র অভিযানে রাত কাটানো অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বাড়তি পাওনা স্থানীয় মানুষদের ব্যবহার ( পিঠে কিলটা বাদে )।
যাই হোক, রেললাইনের উপর কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। চারিদিকে শুধুই অন্ধকার। দূরে কোথাও মনে হল আলো দেখলাম একটু। হয়তো কারও বাড়িতে বাতি জ্বলছে। এবার গেলাম স্টেশনের পেছনের দিকটায়। চৌবাচ্চা বা পাতকুয়ো মতো মনে হল একটা জায়গা দেখে। টর্চ ধরে থাকা হাত টা একবার কেঁপে উঠলো। কারণ পাতকুয়োর মধ্যেই তো পাওয়া গেছিল দেহ দুটো। সাহস করে এগোলাম। দেখলাম একটা ঘর মতো। বুঝলাম সামনের দিকে একটা ঘরের দরজা তালা দেওয়া আছে। এটা সেই ঘরেরই অংশ। বাইরে দিয়েও তালা মারা। গ্রিল দিয়ে উঁকি মারলাম ভেতরটা। কিছুই নেই ফাঁকা।
এই সময় একটি টিকটিকি আওয়াজ করে উঠলো। আবার চমকালাম, মনে মনে ভাবলাম আওয়াজ করার আর সময় পায় না। কানে এল মেঘের গর্জন। বুঝলাম বরুণদেব আবার কাজ করবেন। ফিরে এলাম স্টেশনে। কথা বলতে বলতেই বৃষ্টি নামলো। এ বারে বেশ জোরে। ঝিমুনি আসতে লাগলো। ঠিক হল একজন জাগবে আর একজন ঘুমাবে। এইভাবে পালা করে চলবে যতক্ষণ না বৃষ্টি থামছে। বন্ধু ঘুমালো। আমি বসে রইলাম। ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। মাথায় হাবিজাবি কথা ঘুরতে লাগলো।
আবার একটা ট্রেন গেলো। আমার বাড়িতে জানে বন্ধুর মাসির বাড়ি গিয়েছি। আর আমি কোথায় এসে রাত কাটাচ্ছি। ১২টা সাড়ে ১২টার দিকে বৃষ্টি থামলো। বন্ধুকে ডাকলাম। বললাম, ‘‘আর একবার বেরোবি নাকি?’’ ও বলল আর আধ ঘন্টা ঘুমিয়ে তারপর। মিনিট ২০ পর আবার বৃষ্টি নামলো টিপটিপ করে, সঙ্গে হালকা হাওয়া। ঠান্ডাটা আবার ফিরে এলো। বন্ধুকে ডেকে বন্ধু ছাতা আর আমায় মাথায় প্লাস্টিক বেঁধে বাইরে এলাম। ফোন ভিজে যাওয়ার ভয় বের করলাম না। রেললাইন বরাবর কিছুটা হেটে গেলাম। কিছুই চোখে পড়লো না।
স্টেশনের উল্টোদিকে একটা গাছের নিচে অন্ধকারে বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম যদি কিছু দেখতে পাই। না কিছুই দেখতে পেলাম না। ফিরে এলাম স্টেশনে। এবারে আমার ঘুমানোর পালা। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ ঘুম ভাঙলো বন্ধুর ঝাকুনিতে। বন্ধু কানে কানে বলল চুপ করে থাক কিছুক্ষণ। আওয়াজটা হঠাৎই কানে এল। প্লাস্টিক বা কাগজ মাটিতে ঘষলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন। একবার নয়, থেমে থেমে আওয়াজটা আসছে এবং আওয়াজটা আসছে আমার বামদিকে প্রায় দু’হাত দূর থেকে। আতঙ্কে হিম হয়ে গেলাম। বন্ধু হাত চেপে ধরলো। মনে সাহস এনে টর্চের আলো ফেললাম আওয়াজের উৎসের দিকে। টর্চের আলোয় দেখলাম একটা ইঁদুর আমাদের বিস্কুট খাওয়া প্লাস্টিকটার মধ্যে থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গেল।
বসে রইলাম। বৃষ্টি কমেছে। এ বার স্টেশনের পেছন দিক থেকে আওয়াজ পেলাম। শুকনো পাতা বা ঘাসের মধ্যে দিয়ে চলার শব্দ। বন্ধু বলল এখন যাবো না। একটু দাড়া। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। আওয়াজটা কম বেশি হচ্ছে। এবারে যাওয়ার পালা। গিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম ওখানেই। না, আওয়াজ আর হচ্ছে না। ফিরে এলাম স্টেশনে।
হঠাৎ মাথায় কি চাপলো, গলাটা একটু চড়িয়ে নিয়ে বললাম, “ভুত-ফুত থাকলে একটু দেখা দে বাবা। সেই চারটে থেকে বসে আছি।” বন্ধু মুখ চেপে ধরলো। আমি বুঝলাম যে না আবেগের বসে ওই কথাটা বলা ঠিক হয়নি। নিজেরা সিদ্ধান্ত নিলাম ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ এখান থেকে বেরিয়ে যাব। কারণ স্থানীয়রা অনেক সকালে ওঠে। কেউ দেখতে পেলে সমস্যা হবে। কিছুক্ষণ পর সময়টা দেখলাম, প্রায় আড়াইটা-পৌনে তিনটে।
তিনটের সময়টা নাকি তাদের আসার জন্য আদর্শ সময়। ভয় ভয় লাগছিল বেশ একটা সময় কিন্তু না কেউ এলোও না আর কিছু হলও না। সময় মতো বড়ো রাস্তায় এলাম, বড়ো বড়ো ট্রাক চলাচল করছে। সাইকেল নিয়ে মানুষজন কাজকর্মে বেরিয়ে পড়েছেন। কোনও অটো, টোটো বা বাস নেই। কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটেই ফিরেছিলাম। হোটেলে গিয়ে সারাদিন আর কোথাও বেরোয়নি। পায়ে অসহ্য ব্যাথা নিয়ে সারাদিন দুই বন্ধু মিলে শুয়েই কাটিয়েছিলাম। তারপর দিন সকালে দিনের আলোয় বেগুনকোদর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে পুরুলিয়া নেমে সেখান থেকে এক্সপ্রেস ধরে বাড়ি ফিরেছিলাম।
(একটু অন্য ধরনের অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)
(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)