বেগুনকোদর, বিশ্বের অন্যতম ভুতুড়ে রেল স্টেশনে পৌঁছতে হয়েছিল লুকিয়ে

বেগুনকোদর

বেগুনকোদর বিশ্বের এক নম্বর ভুতুড়ে রেলস্টেশন নামে বিখ্যাত। সেখানে এক রাত কাটানোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা জাস্টদুনিয়ার পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন জিকো রায়, আজ প্রথম পর্ব


২০১৯ এর ফেব্রুয়ারি থেকেই প্ল্যানটা করছিলাম দুই বন্ধু মিলে। সেই মতোই টিকিটটা কেটে রেখেছিলাম। খুব সম্ভবত মার্চের ১৩ তারিখ আমাদের যাত্রার দিন ছিল। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সাঁতরাগাছি জংশন থেকে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসে চেপে রওনা দিলাম। সঙ্গে নিয়ে চললাম একরাশ উৎকণ্ঠা। সময় মতো নেমে পড়লাম পুরুলিয়া জংশনে। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের বাস ধরতে হবে বেগুনকোদর যাওয়ার জন্য। বাসের কন্ডাক্টরকে বেগুনকোদরে রাত কাটানোর ব্যাপারটা জানালাম। সে তো শুনে অবাক। অবাক দুটো কারণে, এক, সেখানে রাতে থাকাটা ভয়ানক ঝুঁকির। দুই, আমরা ভুল বাসে উঠে বেগুনকোদর থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছি।

কন্ডাক্টর ভদ্রলোক খুবই ভালো, এক জায়গায় বাস থামিয়ে খানিকটা আমাদের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে দেখিয়ে দিলেন কোথা থেকে গাড়ি ধরবো এবং বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে যাবো। সঙ্গে এটাও বলে দিলেন আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিত। আমরা একটা জায়গা থেকে ম্যাজিকগাড়ির মতো একটা গাড়িতে উঠলাম। যেতে যেতে দেখলাম চারিদিকে শুধু তেপান্তর মাঠ আর মাঠের শেষে মালভূমি আর পাহাড়। এতো সুন্দর দৃশ্যের মাঝে সারাদিনের ক্লান্তি আর রাতে থাকার উত্তেজনাটা থিতিয়ে পরেছিল। জায়গা মতো গাড়ি থেকে নেমে আবার আমরা বাসে উঠলাম। আগের বাসের কন্ডাক্টর দাদার কথা অনুযায়ী এই বাসের কন্ডাক্টর কাকুকে বললাম ঝালদা যাবো। কারণ ঝালদাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। বাসে যেতে যেতে দেখলাম আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে, সূর্য্যিমামা সরে গিয়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামলো। সেই বৃষ্টি একটু পড়ে মুষলধারায় পরিণত হলো। আবার কিছুক্ষন পড়ে রোদ্দুর। এইভাবে রোদ-বৃষ্টির খেলা চলল।

বেগুনকোদর স্টেশনের টিকিট কাউন্টার

ঝালদা পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। বাসে পরিচয় হওয়া সকলকে বিদায় জানিয়ে নেমে পড়লাম। রোদ-বৃষ্টির খেলা তখনও চলছে। ঝালদায় হোটেল পেলাম না। একজনের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হল। ঝালদা থেকে আবার বাসে করে রওনা দিলাম। এবারে যাব বামনিয়া। হ্যাঁ এই বামনিয়াতে নামলেই বেগুনকোদর স্টেশন পাবো। পুরুলিয়া জংশন থেকে বাস ধরার সময় আমাদের উচিৎ ছিল এইটা বলা যে বামনিয়া যাবো। তা হলে অনেক আগেই আমরা পৌঁছে যেতাম। বাস তুলনামূলকভাবে ফাঁকা। বামনিয়া যখন নামলাম তখন প্রায় সন্ধ্যে। বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে চললাম। চারিদিকে ফাঁকা মাঠ আর মাঠের মধ্যে একটা মাত্র ঘর। সেটাই বেগুনকোদর স্টেশন। আমরা জেনেছিলাম যে সেই সময় বেগুনকোদরে লাস্ট ট্রেন দাঁড়ায় সাড়ে পাঁচটা-ছ’টা নাগাদ। সেটাও দেখলাম।

বেগুনকোদরে স্টেশন চত্তরে পৌঁছে দেখলাম তিন-চারজন লোক তখনও স্টেশনে রয়েছেন। স্টেশনমাস্টার জিনিসপত্র গোছাচ্ছেন।, বন্ধুকে বললাম আপাতত বস। সবাই চলে গেলে তারপর ভিডিও করবি। কিছুক্ষন পর দেখলাম একটা ট্রেন এলো সেখান থেকে সাত-আটজন লোক নামল আর স্টেশনে থাকা লোকগুলো ট্রেনে উঠে পড়লো। জানলাম ট্রেনটা পুরুলিয়া যাচ্ছে। স্টেশনমাস্টার আমাদের দেখে প্রশ্ন করলেন, ” কি হলো যাবেন না !! এটা তো লাস্ট ট্রেন! এরপর আর ট্রেন নেই ।”  আমরা বললাম, ‘‘না যাব না। আজকের রাতটা এখানেই কাটাবো।’’

দেখুন ভিডিও

এট শুনে স্টেশনমাস্টার ( নাম খুব সম্ভবত দুলু মাহাতো ) প্রচন্ড রেগে গেলেন। বললেন, ‘‘না, এখানে রাতে থাকা যাবে না। এখানে রাতে অনেক কিছু হয়।’’ আমরা বললাম, ‘‘ঠিক আছে, আর কিছুক্ষণ থাকি তারপর চলে যাবো।’’ তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। ট্রেন থেকে নামা প্যাসেঞ্জেররা কি হয়েছে জানতে চাইলেন। স্টেশনমাস্টার বললেন, “এরা বলছে এখানে রাতে থাকবে। তারপর সবাইকে বলে বেড়াবে এখানে ভুত আছে।” আমরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না। উল্টে বলা হল এক্ষুনি এখান থেকে না গেলে, মেরে তাড়ানো হবে। একজন তো একটা কিল বসিয়ে দিলো আমার পিঠে। পিঠে ব্যাগ ছিল বলে লাগেনি।

তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে চলে এলাম বড়ো রাস্তায়। নিজেদের ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দিনের আলোয় গিয়ে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ওনাকে ভাল করে বুঝিয়ে রাতে থাকার ব্যবস্থাটা করে নেওয়া। যাই হোক, অন্য একটি রাস্তা দিয়ে স্টেশনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সেখানে কয়েকজন স্থানীয় একটি টিউবওয়েল থেকে জল নিচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন কী ব্যাপার,  কোথায় যাব। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বললাম, ‘‘বেগুনকোদর যাবো। ট্রেন ধরবো। পুরুলিয়া যাবো। তারা বললেন বেগুনকোদরের লাস্ট ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। সকালের আগে কোনও ট্রেন নেই। বড়ো রাস্তায় গিয়ে বাস ধরে নাও।’’

রাতের অন্ধকারে বেগুনকোদর স্টেশন

ফিরে এলাম, বড়ো রাস্তায় হাটাহাটি করতে লাগলাম। এতো দূর থেকে এতো কষ্ট করে এসে উদ্দেশ্য সফল না করে ফিরে যেতে মনে চাইছিল না। আর হ্যাঁ, বড় রাস্তায় আলো নেই। অন্ধকা। ছুটে চলা গাড়ির আলোয় বেগুনকোদর স্টেশনটা দেখছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম যে মাঠের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা একেবেঁকে চলে গিয়েছে স্টেশনের দিকে। ঠিক করলাম আর একটু পরে এই রাস্তা ধরেই যাব। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। এরই মাঝে নামলো বৃষ্টি। জোরে না, টিপটিপ বৃষ্টি। আমরা দুজন, ছাতা একটা ( ঝালদার একটি দোকান থেকে কেনা )। ভেবেচিন্তে বন্ধু মাথায় নিল ছাতা আর আমি মাথায় বাধলাম পলিথিনের ব্যাগ। এগিয়ে চললাম সন্তর্পণে। অন্ধকারেই এগোলাম। কারণ আলো ফেললে যদিও কারও চোখে পড়ে যায়। বিনা বাধায় গন্তব্যে পৌঁছেও গেলাম একটা সময়।

চট করে একবার টর্চের আলোয় দেখে নিলাম অপ্রত্যাশিত কিছু আছে কিনা এবং কোথায় আমরা বসব। তারপর আলো নিভিয়ে বসে পড়লাম একটা জায়গায়। বুঝলাম আমাদের ১০০ টাকার টর্চটা এই পাহাড় প্রমান অন্ধকারের কাছে নস্যি। এই গাঢ় অন্ধকারকে ভেদ করতে পারে একমাত্র মেটালের আলো বা হ্যাজাক কিংবা শক্তিশালী কোনও টর্চ। যাই হোক, এ বার শুরু হল অপেক্ষা। মোবাইলে সময় দেখলাম, প্রায় সাড়ে আটটা। বাইরে একটানা বৃষ্টি চলছে। বৃষ্টির বেগটা আগের থেকে বাড়ল। ইতিমধ্যেই কানে এল ট্রেনের হুইসেল। কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা ট্রেন হুশ করে বেরিয়ে গেল। ট্রেন চলে যেতেই শুধু বৃষ্টির শব্দ। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতি। এতটা ঠান্ডা পড়বে বুঝতে পারিনি। দুই বন্ধুতে একটু গা ঘেষাঘেষি করে বসলাম. একটু পরে ঠান্ডার ভাবটা কেটে মনে ভয়ের সঞ্চার হল। কারণ সেই মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছিলো বেগুনকোদর ভুতুড়ে স্টেশন হওয়ার ঘটনাটা। কেন ভুতুরে হয়ে উঠল এই স্টেশন? গল্পটা এখানে আসার আগেই শুনে এসেছিলাম।

(একটু অন্য ধরনের অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)