জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা: ন’বছর পর সেই কামরায় একটা রাত

জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা

জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা এলাকায় সন্ধ্যে ছ’টার কিছু পরে নৈশ অভিযান শুরু হল। শেষের কামরা থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল ওঁরা। প্রথম কামরাতে  কিছুক্ষণ ভিডিও করার পর  হঠাৎ কৌশিক খেয়াল করলেন রাস্তার ওদিক থেকে জোড়ালো আলো এসে পড়ল ওদের মুখে, তার পর কী হল জানুন ন’বছর পর সেই মর্মান্তিক জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের কামরায় রাতে পৌঁছলেন জিকো রায় ও তাঁর বন্ধুরা। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব…


ওই আলো দেখে আমাদের টর্চের আলো এবং মোবাইলের ফ্ল্যাশ বন্ধ করে দিলাম। কয়েক মুহূর্ত পর বুঝলাম রেল পুলিশ বা সিকিউরিটি গার্ড চেক করতে এসেছে। হয়তো আমাদের টর্চের আলো দেখতে পেয়েছে। ধরা পড়লে বাড়ি ফিরে যেতে হবে নিশ্চিত, থানা পুলিশ হলেও অবাক হব না। তাই লুকানোটাই শ্রেয়। দু’জন লুকোলাম টয়লেটে আর দু’জন লুকলো সিটের নিচে। ওনারা এলেন প্রত্যেকটা কামরার বাইরে থেকে ভেতর দিয়ে টর্চ মেরে দেখলেন কিন্তু কেউই কোনও কামরার ভেতরে ঢুকলেন না। কিছুক্ষণ চলে গেলেন।

এ দিকে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। একদিকে পুলিশ আর অন্য দিকে অন্ধকার। ওনারা চলে যাওয়ার আরও কিছুক্ষণ পর বেরোলাম। সেফটি ফার্স্ট, নিজেদের মধ্যে একটা চিন্তন বৈঠক করে নিলাম কামরার মধ্যেই। কারণ ওনারা আবার ফিরে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে কী কী করণীয়! ঠিক হলো দু’জন করে কামরার ভেতরে ঢুকবে আর দু’জন বাইরে দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপাশে নজর রাখবে।

সাড়ে সাতটা নাগাদ বিশ্বজিৎ এসে পড়ল। খড়্গপুর নেমে গাড়ি ভাড়া করে এসেছে কারণ খেমাশুলি আসার লাস্ট ট্রেন অনেকক্ষণ আগেই চলে গিয়েছে। এদিকে আরেকটা কাণ্ড হয়ে গিয়েছে। দীনেশ ভ্যানিশ। রাস্তার ওদিকে একটা ঢিবি মতো অংশে লুকিয়ে নজর রাখছিলো দীনেশ। এখন নেই। কল করছি, নট রিচেবল। চিন্তা হচ্ছিল।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দীনেশের কল এল। পারিবারিক কারণে ওকে একটু যেতে হয়েছে। লজ্জায় বলে যেতে পারেনি এই সুযোগেই ওকে বললাম, ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ দুটো বাইক নিয়ে রেল গেটের কাছে চলে আসতে আর আমাদের সরডিহা বা খেমাশুলিতে ছেড়ে দিতে।

চিন্তামুক্ত হয়ে আবার শুরু হল কাজ। কিছু জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে দেখে নিলাম রেলগেটের দিকে। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা হওয়ার পর তেকে সেই এলাকাটা রীতিমতো মতো পরিতক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে।

ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ন’টা ছুঁইছুঁই। রেল গেট থেকে কিছুটা এগোতেই দেখতে পেলাম দূর থেকে দুটো ক্ষীণ আলো এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। একে ওপরের মুখ চাওয়াচাই করলাম। বিশ্বজিৎ বলল, ‘‘রিস্ক নেওয়া যাবে না, সামনের বাঁদিকের ঝোপের পেছনে লুকিয়ে পর এক্ষুনি।’’ আবার লুকোচুরি খেলা শুরু হল। আলো দুটো ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে। কাছে আসতে বুঝলাম দুজন মানুষ টর্চ নিয়ে এগিয়ে চলেছে। আরও কাছে আসতে বুঝলাম এঁরা সেই সিকিউরিটি গার্ড। নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। ফিরে গেলাম আমাদের গন্তব্যস্থলে।

দেখুন রাতের ভিডিও

এবার সব কামরায় ঢোকার পালা। রাত তখন ১০টা বেজে গিয়েছে। এস-ফাইভে যখন ছিলাম তখন একটা ঘটনার কথা বলি— ক্যামেরা তখন বন্ধ। বন্ধু সত্য বলল, “আমরা ছাড়া এখানে কি আরও কেউ আছে নাকি রে !! কাদের যেন ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ পেলাম হালকা।” চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। এ ছেলে কী বলছে এসব!! বললাম, ‘‘ঠিক শুনেছিস?’’ বলল, “হ্যাঁ, শুনেছি তবে হালকা, ভাসা ভাসা। পুরো ক্লিয়ার নয়।” বললাম, ‘‘ও কিছু না, মনের ভুল। এরকম পরিবেশে ওরকম মনে হয়।’’

বেশিক্ষন ভেতরে বসতে পারলাম না। বীভৎস গরম কামরার ভেতরে। প্রত্যেকটা কামরাতেই বাইরে ঠান্ডা কিন্তু কামরার ভেতরে গরম। কেমন যেন একটা গুমোট ভাব কামরাগুলোর মধ্যে. একটা ধুলোমাখানো গন্ধের বাতাবরণ ছেয়ে আছে। বড্ডো ঘাম হচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরে বেশ ঠান্ডা।

ভিডিওর ক্ষেত্রে ক্যামেরার সামনে আমি আর ক্যামেরার পেছনে সত্য। কৌশিক আর বিশ্বজিৎ-এর দায়িত্ব ছিল রাস্তার দিকটা নজর রাখা। কিছুটা সময় বাইরে এসে বসলাম। চারজন এমনভাবে বাইরে বসলাম যাতে রাস্তার দিকেও নজর রাখা যায়, কামরাগুলোর দিকেও চোখ থাকে এবং সর্বোপরি জঙ্গলটাও দেখতে পারি। মাথার মধ্যে ঘুরছে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা নিয়ে দেখা সেই সব ভয়ঙ্কর ছবি।

সবাই চুপ করে রইলাম অনেকক্ষণ। সেই মুহূর্তের পরিবেশটা অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম সবাই। চারিদিকে কোনও আওয়াজ নেই, কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। চাঁদমামা লুকিয়েছে মেঘের আড়ালে। দূরে জঙ্গল থেকে হঠাৎ করেই অচেনা অজানা শব্দ ভেসে আসছে। এ এক বিচিত্র পরিবেশ, একবারে বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

(একটু অন্য ধরনের অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)

একটু বিশ্রাম নিয়ে সবাই মিলে ঢুকলাম সেই কামরায় যে কামরায় বাটি রেখে এসেছিলাম। কিন্তু এ কি হলো !! সর্বনাশ করেছে ! বাটি কোথায় !! বাটি নেই, ভ্যানিশ, সিম্পলি ভ্যানিশ। এবার আমরা সত্যি ভয় পেলাম, তাহলে কি সত্যি !! সত্যিই কি বাটির স্থান পরিবর্তন হয় নিজে থেকেই !! আমরা এখানে সেই দুপুর থেকে রয়েছি। আমি বললাম, ‘‘চল বেরিয়ে যাই এখান থেকে। আমার কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে।’’ নেমেই যাচ্ছিলাম, সেই সময় সত্য বলল, ‘‘এই দাঁড়া দাঁড়া, এক মিনিট। বাটিটা তো এখানে থাকবে না। এটাই স্বাভাবিক। কারণ বাটিটা তো কামরার উল্টোদিকে রেখেছিলিস তুই। ভুলে গেলি!!’’

আমি বললাম, ‘‘হ্যাঁ তাই তো। বাটি তো ঐ দিকেই রেখেছিলাম। গুলিয়ে ফেললাম কী করে!! গুলিয়ে ফেলার তো কথা নয়.. নিঝুম রাতের এই গভীরতা আর অন্ধকারের বীভৎসতা কী আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ক্ষণিকের জন্য লোপ পাইয়ে দিয়েছিল! অনেক ভেবেও এর কোনও যথাযথ যুক্তি আজও খুঁজে পাইনি। যাই হোক উল্টোদিকে গিয়ে দেখলাম বাটি যেখানে রেখেছিলাম সেখানেই আছে। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাটি রহস্যের জট কাটিয়ে ভিডিও করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বুঝলাম যে বা যারা বলে বাটির স্থান পরিবর্তন হয়, তারা মিথ্যে বলে।

আগেই পরিকল্পনা করা ছিল ঠিক রাত ১.২০-তে আমরা এস-সেভেন কামরায় যাব। ঘড়িতে দেখলাম সময় হয়ে গিয়েছে। আসলে আমরা ঠিক করেছিলাম যে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় নিহত সকল মানুষের আত্মার শান্তি কামনা করে ওই সময় জ্ঞানেশ্বরীর কোনও এক কামরায় মোমবাতি জ্বালাবো। এই সময়টা বেছে নিয়েছিলাম কারণ ২৮ মে ২০১০-এ ঠিক এই সময়েই জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

এক সঙ্গে এতো মানুষের যেই মৃত্যু হলো অমনি জায়গাটা ভুতুড়ে হয়ে গেল। বেশ মজার ব্যাপার। একটা জায়গা যেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে একাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেই স্থানকে খুব সহজেই ভুতুড়ে তকমা দেওয়া যায় তাই না?  তবে মানবিকতার দিক থেকে দেখলে চোখে জল আসাটাই অস্বাভাবিক। একবার মানুষগুলোর কথা ভেবে দেখুন, কোথায় ছিল, কোথায় যাচ্ছিল আর কোথায় চলে গেল! জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা ঘিরে স্বজন হারানোর বেদনাটা কেবল তাঁরাই বুঝবেন যাঁরা হারিয়েছেন। মনের কষ্ট, চোখের জল সবটাই তাঁদের।

এস-সেভেনের দুলুনী রাতেও একই রকম রয়েছে। তার মধ্যেই আমি আর সত্য মোমবাতি জ্বালাবো বলে আর একটু ভেতরে ঢুকলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই দুলুনি বেড়ে গেল। আমি আর সত্য কামরার অন্য দরজা দিয়ে বেরোব বলে অনেকটাই এগিয়ে গিয়ে দেখি সেই দরজা এমন অবস্থায় রয়েছে যে ওখান দিয়ে বেরনো অসম্ভব। কৌশিক আর বিশ্বজিৎ ওদিকের দরজা দিয়ে নেমে গিয়েছে। আমরা আবার ঘুরে আসছি এদিকের দরজা দিয়ে নামবো বলে, আবার একটা দুলুনি. আমি আর টাল সামলাতে না পেরে বসে পড়লাম সিটে। সত্য রড ধরে কোনোরকমে টাল সামলালো।

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)

যত রাত বাড়ছে রহস্য যেন বেশি করে ঘনীভূত হচ্ছে জ্ঞানেশ্বরীর প্রতিটা অংশে। তৎক্ষণাৎ কৌশিক আর বিশ্ব উঠে এসে আমাদের ধরে নামালো। কামরায় তখনও ভাইব্রেশন হচ্ছে। বুঝলাম এই কামরায় আমরাই দাঁড়াতে পারছি না তো স্বয়ং মোমবাতি কী করে দাঁড়াবে!! তাই সেখান থেকে নেমে অন্য একটা কামরায় মোমবাতি জ্বালানোর কাজটা সারলাম। মোমবাতি জ্বালিয়ে যেই মুখ ফিরিয়েছি তখনি দেখি কামরার শেষ প্রান্ত থেকে কিসের আওয়াজ হচ্ছে। টর্চ ফেলে দেখি একটা ছুঁচো।

উত্তেজনা ছাপিয়ে এবার ক্লান্তি গ্রাস করছে ধীরে ধীরে। সেই সকালে সবাই বেরিয়েছি। ঠিকমতো বিশ্রাম নিইনি টানা জার্নি। সত্যিই আর শরীর দিচ্ছিল না। সত্য বলল আর একবার শেষবারের মতো যাবে এস-সেভেনে। দেখি ভাইব্রেশন ছাড়া আর কিছু হয় কিনা বা কিছু দেখতে পাই কিনা। তবে এখন না, আর একটু রাত বাড়ুক।

শেষবার যখন ঘড়ি দেখেছিলাম তখন প্রায় দুটো। কিছুক্ষণ পর সত্য বলল, এবার যাওয়া যাক। ঢুকলাম এস-সেভেনে। দুলছে কামরা। চারজন একসঙ্গেই ঢুকেছি। তাই ভালোই দুলছে। পাশের লাইন দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে, ফলে কামরার ভাইব্রেশন বেড়ে যাচ্ছে। পরমুহূর্তেই মনে হল আর এগোতে পারছি না। পড়ে যাবো, খুবই দুলছে। বাঁ দিকে হেলে পড়ছি আস্তে আস্তে। সত্য একপ্রকার ধমক দিয়েই আমাকে কামরার আরও ভেতরে নিয়ে গেল। যত এগোচ্ছি ততই কামরা দুলছে। কামরার শেষ প্রান্তের জানলা দিয়ে গাছের ডালপালা ভেতরে প্রবেশ করেছে। আর এগোনো যাবে না। আন্দাজ করলাম অনেকদিন পড়ে থাকার কারণে কামরার পার্টসগুলো ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছে, অধিকাংশ জায়গা খুলে গিয়েছে, চাকা নেই. একদিকে হেলে রয়েছে। একদিকে হেলে থাকার কারণে ডিসব্যালান্স অবস্থায় আছে। তাই একটু ভার পড়লেই মধ্যাকর্ষণ বলের দরুন পড়ে যাবো বলে মনে হচ্ছে এবং কোনও ট্রেন বা ভারী গাড়ি গেলে ভাইব্রেশন হয় এই একই কারণে।

ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। দীনেশ নিজেই কল করল। বলল আসছি মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যেই। রেল গেটের ওখানে আমাদের আসতে বলল। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা মনের যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু দেয়নি।

না, ভুতের দেখা পাইনি। কোনও আত্মা আমাদের বিপদে ফেলেনি। শুধু মনের কোণায় থেকে গিয়েছে একরাশ যন্ত্রণা। ওই মানুষগুলোর কষ্টের কথা যাঁরা ঘুমের মধ্যেই এই বিভৎসতার শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি।