জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা হয়েছিল ২০১০-এর ২৮ মে। পশ্চিম মেদিনীপুরের সরডিহা ও খেমাশুলি রেলস্টেশনের মাঝে রাত একটা নাগাদ রেললাইনে ত্রুটি থাকায় লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল ট্রেনটি আর তখনই অন্য লাইনে উল্টোদিক থেকে দ্রুতগতিতে চলে আসে একটি মালগাড়ি। সেই সময় বলা হয়েছিল মাওবাদীদের কাজ। পরবর্তী সময়ে তদন্তে নেমে দেখা যায় লাইনের ফিশপ্লেট গায়েব ছিল। আজও সেখানে পড়ে রয়েছে ট্রেনের ধ্বংসাবশেষ। তা ঘিরেই তৈরি হয়েছে নানা ভৌতিক কাহিনী। ন’বছর পর সেই মর্মান্তিক জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের কামরায় পৌঁছলেন চার বন্ধু। আজ প্রথম পর্ব লিখলেন জিকো রায়…
২০১৯-এর দূর্গাপুজোটা প্রায় ভেস্তেই গিয়েছিল। হাত ভেঙে বাড়িতেই বসে থাকতে হয়েছিল। অস্ত্রোপচার, প্লেট বসানো, এই সব করতে করতে লক্ষ্মীপুজোও চলে গেল। আমার সময় কাটতো ইউটিউবে বেড়ানোর ভিডিও দেখে দেখে। সেখানেই দেখলাম এক ভদ্রলোক জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা ( দুর্ঘটনার কথা আশা করি সবাই জানেন তাই আমি আর নতুন করে কিছু বলছি না) হওয়ার পর ওখানে পড়ে থাকা দুর্ঘটনাগ্রস্ত কামরাগুলোতে নৈশ অভিযান চালাচ্ছেন এবং সেখানে আত্মার অস্তিত্ব প্রমান করছেন, এমনকি অশরীরীদের সঙ্গে কথাও বলছেন।
একটা নয়, বেশ কয়েকটি ভিডিও দেখলাম। ভিডিও দেখতে দেখতে আমার শরীরের ধূসর কোষগুলোর উত্তেজনাও বাড়ছিল। সময়টা নভেম্বরের ২০১৯-এর মাঝামাঝি। কাঁধে তখনও পাউচ সিলিং আর্ম ব্যাগে ঝুলছে হাত। এই অবস্থাতেই আমার বন্ধুদেরকে জ্ঞানেশরীর বিষয়টা জানালাম। তারপর আর কী! বাড়িকে কোনও রকমে বুঝিয়ে ১৪ নভেম্বর সকাল সকাল দুই বন্ধু (আমি আর সত্যব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়) বেরিয়ে পড়লাম। আর এক বন্ধু (কৌশিক রায় ) দেখা করলো হাওড়াতে। চতুর্থ জন ( বিশ্বজিৎ গোমেজ ) অফিস থেকে সরাসরি স্পটে পৌঁছে যাবে এমনটাই কথা হল।
সকাল ১০টায় হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে ঝাড়গ্রাম স্টেশনে নামলাম প্রায় দুপুর ১.১০ নাগাদ। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। প্রায় দুটো নাগাদ আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা এবং আমাদের এক বন্ধুর অফিসের কলিগ দীনেশ মুন্ডা।
তারপর ঝাড়গ্রাম থেকে ট্রেনে চাপলাম। যাওয়ার পথেই চোখে পড়লো দুমড়ে-মুছরে যাওয়া দুর্ঘটনাগ্রস্ত কামরাগুলো। যত এগোচ্ছি ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা ততই বেড়ে চলেছে। ১৫মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সরডিহা রেল স্টেশনে। স্টেশনের বাইরে থাকা টোটো নিয়ে আমাদের গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে চললাম। যেতে যেতে দেখলাম দু’দিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তৈরি এই রেল স্টেশন।
টোটোচালকও জানালেন তাঁরাও বিশ্বাস করেন এই কামরাগুলোতে আত্মার আনাগোনা রয়েছে। রাতে নানা রকমের শব্দ শোনা যায়। যেমন শিশুদের কান্না, পুরুষ-মহিলার বুকফাটা আর্তনাদ, ট্রেনের কামরা থেকে নির্গত বিভিন্ন বর্ণের আলো চোখে পড়েছে অনেক গ্রামবাসীর। ওখানের রাস্তা দিয়ে রাত্রি বেলায় গেলে কারা যেন পিছু ডাকে। এমনকি ট্রেনের চালকা দেখেছেন ট্র্যাকের উপর দিয়ে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। ট্রেন থামিয়ে নেমে দেখে কেউ নেই।
টোটোচালক এটাও বললেন যে ওই জঙ্গলগুলো থেকে যে কোনও সময় হাতি বেরিয়ে আসতে পারে। সারাদিনে একবার তারা বের হয়। এইসব শুনছি আর প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনার পারদ চড়ছে। রাস্তার বেহাল দশার জন্য পৌঁছতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। আর এক বন্ধু অর্থাৎ বিশ্বজিতের সরাসরি আসার কথা আগেই বলেছি। ওকে জানাল ঝাড়গ্রাম পৌঁছতে দেরি হবে, ট্রেন লেট।
দেখুন অভিযানের ভিডিও
এদিকে আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি রেল লাইনের দুপাশে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতির ছাপ আজও রয়ে গিয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে কামরাগুলো। একদিকে কিছু বেশি, একদিকে সংখ্যাটা কম। এবার আমরা যেদিকে কামরার সংখ্যা বেশি সেদিকে এগিয়ে চললাম। রেললাইন পেরিয়েই দেখলাম এদিক ওদিক বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে ট্রেনের নানান অংশ। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের ভাঙা অংশগুলো দেখে মনে হচ্ছে কারা জেন ফালাফালা করে দিয়েছিল ট্রেনটাকে। ট্রেনের প্রত্যেকটা অংশকে যেন তারা খুবলে তুলে এনে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। প্রতিটা কামরার ওই ভয়ানক অবস্থা দেখে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল কামরার ভেতরে থাকা মানুষগুলোর করুন পরিণতি। প্রতিটা কামরার গায়ে মরচে ধরেছে. তবে সেটা রক্তের দাগও হতে পারে। কারণ দুটো দাগ কে সেই সময় আলাদা করে বোঝার উপায় ছিল না। ভিডিও করছি, ছবি তুলছি, মাঝেমাঝে লোকালট্রেনসহ বেশ কিছু মালগাড়ি যাতায়াত করছে। রেললাইনের পাশের রাস্তা দিয়েই সাইকেল, বাইক চলাচল করছে যদিও সংখ্যায় খুব কম। কামরা গুলোর ভেতরে ঢুকতেই দৃশ্য দেখে মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো, কি খারাপ অবস্থা !!
আরও একবার শিহরিত হলাম এই ভেবে যে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা কতটা ভয়ঙ্কর ছিল যার ফলে ট্রেনের কামড়াগুলোর এই অবস্থা হতে পারে! ট্রেনের মেঝে হেলে পড়েছে, বসার জায়গা ভেঙে খুলে পরে রয়েছে , জানলার কাঁচ ভেঙে মেঝে এবং সিটের উপর পরে রয়েছে অ্যাভেঞ্জার্স-এর হাল্ক এসে সব কিছুকে যেন পিষে দিয়ে চলে গিয়েছে।
(একটু অন্য ধরনের অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)
ইউটিউবে যখন ওই জোতিষীর ভিডিও দেখছিলাম তখন উনি দেখিয়েছিলেন যে একটা বাটি তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন ট্রেনের একটা কামরায় এবং সেই বাটিটা তিনি একটা জায়গায় রেখে দেন, পড়ে গিয়ে দেখেন সেই বাটিটা সেখানে আর নেই।
যাই হোক, এরপর আমরা অন্যতম ভুতুড়ে কামরা বলে পরিচিত এস-ফাইভ-এ ঢুকলাম এবং সেখানে সেই বাটিটা খুঁজে পেলাম। একটা জায়গায় রেখেও দিলাম এবং ঠিক করলাম যে রাতের অন্ধকারে ফিরে এসে দেখবো বাটির অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে কিনা।
সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম এস-সেভেন কামরাতে। এই কামরা নিয়েই যত রহস্য। কারণ এই কামরাতে উঠলেই নাকি অনুভব করা যায় যে কামরা দুলছে। বিষয়টা যে কোনও ভৌতিক নয় সেরকম বিশ্বাস আমাদের ছিল। একজন একজন করে কামরায় সবাই উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড কামরায় দাঁড়ানোর পর অনুভব করলাম কামরা ভীষণ রকমভাবে একদিকে দুলছে এবং একদিকে হেলে পড়ছে। আর কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালেই উল্টে পরে যাবো মনে হচ্ছিল। দৌঁড়ে নিচে নেমে এলাম। যে বিশ্বাস নিয়ে কামরায় উঠেছিলাম সেই বিশ্বাস তো তলানিতে এসে ঠেকলো!! এ কি করে সম্ভব! ওই কামরা থেকে বেরিয়ে কামরার দিকে তাকিয়ে আছি আর নিজেরা আলোচনা করছি, এটা কি করে হলো!
পরমুহূর্তেই আমরা অনুভব করলাম যে আমাদের মাথার ভেতরের ঘিলুগুলো যেন এদিক ওদিক দৌঁড়াচ্ছে আর মাথ বনবন করে ঘুরছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। ঘাসের উপর এসে বসে পড়লাম। চোখে মুখে ও ঘাড়ে জল দিলাম। কিছুটা স্বস্তি পেলাম কিন্তু মাথায় তখনও ঘুরছে।
(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)
এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে, সূয্যিমামা ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে ডুবতে শুরু করেছে। রাতের অন্ধকারে কী হবে সেটা ভেবে আরও বেশি রোমাঞ্চ হল। কারণ ভুত দেখতে পাবো কিনা জানি না তবে সাপ, ছুঁচো, ইঁদুর জাতীয় সরীসৃপ যে রাতের আঁধারে এখানে আসবে সেটা নিশ্চিত। আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে শিয়াল কিংবা হাতির দেখাও পেয়ে যাবো।
একটু ধাতস্ত হয়ে ঠিক করলাম আবার যাবো এস-সেভেন কামরায়। দু’জন উঠবে আর দু’জন বাইরে থাকবে। সত্য ও দীনেশ উঠলো, আমি আর কৌশিক বাইরে। কামরার ভেতরে ভাইব্রেশন তখনও হচ্ছে কিন্তু আগের চেয়ে কম। হালকা দুলছে। ওই মুহূর্তেই একটা ট্রেন পাস করলো। দুলুনি কিছুটা বেড়ে গেল। মাথা ঘোরাচ্ছে বলে সত্য আর দীনেশ নেমে পড়ল। বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কারণটা।
সূয্যিমামা অস্ত গেল সে দিনের মতো, আমরা ফিরব আবার রাতে এই জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা হওয়া অভিশপ্ত কামরায়।