জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: বছর ছয়েক আগে তাঁর একটি ফ্রি কিকে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ফুটবল বিশ্ব। অস্ট্রেলিয়ায় অনেকে তখন বলেছিলেন তাঁদের দেশের লিগের ইতিহাসে এমন ফ্রিকিক থেকে গোল আগে কখনও দেখা যায়নি। তখন ব্রিসবেন রোর-এর হয়ে খেলতেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (Dimitrios Petratos)। মেলবোর্ন সিটির বিরুদ্ধে ম্যাচে বিপক্ষের গোলের ৩৫ গজ দূর থেকে একটি ফ্রি কিক নেন দিমি (অস্ট্রেলিয়ায় এই নামেই তাঁকে চেনেন সবাই)। পায়ের বাইরের দিক দিয়ে নেওয়া শট হাওয়ায় কাট করে ডানদিকে বেঁকে (গোলকিপারের বাঁ দিক দিয়ে) সোজা গোলে ঢুকে যায়। সেই শটের যে গতি এবং সুইং ছিল, তা যে কোনও ফুটবলপ্রেমীকে হতবাক করে দিতে পারে।
ইউটিউবে সার্চ করলে পাওয়া যাবে সেই গোল, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যা ভাইরাল হয়ে যায়। এবং সেই একটি গোলই কয়েক দিনের জন্য বিখ্যাত করে তোলে পেট্রাটসকে। অস্ট্রেলিয়ায় অবশ্য তিনি বিখ্যাতই। সেখানকার ফুটবলপ্রেমীরা একডাকে চেনেন তাঁকে। এ বার ভারতেও সে রকম খ্যাতি অর্জন করার উদ্দেশ্য নিয়েই আসছেন এই আগ্রাসী ফুটবলার?
মজিদ বিসকার থেকে রয় কৃষ্ণা— ভারতে এসে ফুটবলার হিসেবে জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠার এমন দৃষ্টান্ত এক ঝাঁক রয়েছে। এ বার সেই তালিকায় পেট্রাটস নাম লেখাতে পারেন কি না, তা তো সময়ই বলবে। কিন্তু ভারতের ফুটবলে সুখ্যাতি পাওয়ার সব রকম উপাদানই রয়েছে তাঁর মধ্যে। এমনটাই দাবি তাঁর নতুন ক্লাব এটিকে মোহনবাগানের।
যাঁর রক্তে ফুটবল, যাঁর বাবা, ভাই, বোন সবাই ফুটবলার এবং ফুটবলকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তিনি যে সব সময় ফুটবলের মধ্যেই থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাঁর দাদার সঙ্গেই নিউক্যাসল জেটসের হয়ে ‘এ’ লিগে অভিষেক হয় ভাই কোস্টার। তখন তাঁদেরই বোন পানাগিওতা সেই ক্লাবেরই মেয়েদের দলের নিয়মিত সদস্যা ছিলেন। এমন ঘটনা সচরাচর ফুটবল ইতিহাসে বড় একটা দেখা যায় না।
শৈশব থেকে যৌবন, ফুটবলের সঙ্গেই
এই ভাই-বোনেদের বাবা অ্যাঞ্জেলো অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় লিগে নিয়মিত ফুটবলার ছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ স্তরের ক্লাব ফুটবলে একই পরিবারের এতজন সদস্যকে আগে কখনও খেলতে দেখা যায়নি অস্ট্রেলিয়ায়। সারা বিশ্বের ক্ষেত্রেও এটা বেনজির হলেও হতে পারে। এখানেই শেষ নয়। দিমি-রা নিউক্যাসল জেটসের হয়ে খেলার সময় তাঁদের আর এক ভাই ম্যাকি অনূর্ধ্ব ১৭-য় খেলা শুরু করেন।
সিডনি অলিম্পিক ইউথ সিস্টেমের ফসল এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার কাম ফরোয়ার্ডের জন্ম ১৯৯২-এ। ২০১১-য় সিডনি এফসি-র হয়ে ক্লাব ফুটবলের অভিযান শুরু করেন। কিন্তু এক দিন অনুশীলন চলাকালীন দলের গোলকিপার জেলস্কো কালাচের সঙ্গে তুমুল ঝামেলার জেরে ক্লাব থেকে রিলিজ নিয়ে নেন এবং মালয়েশিয়ান সুপার লিগ চ্যাম্পিয়ন কেলান্তান-এ যোগ দেন। দেশে ফিরে আসেন ২০১৩-য় ব্রিসবেন রোর-এর সঙ্গে এক বছরের চুক্তি করে। সে বার তাঁর প্রাক্তন ক্লাব সিডনির বিরুদ্ধেই জীবনের প্রথম হ্যাটট্রিকটি করে তাদের জবাব দিয়ে দেন পেট্রাটস। সেই মরশুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লিভারপুলের বিরুদ্ধে এক ফ্রেন্ডলি ম্যাচে একটি গোলও করেন।
তাঁর ফুটবল কেরিয়ারের সেরা মরশুম ছিল ২০১৫-১৬। সে বারের লিগেই মেলবোর্ন সিটির বিরুদ্ধে ফ্রি কিকে সেই অসাধারণ গোলটি করেন, যা নিয়ে এই লেখার শুরু। ব্রিসবেনের হয়ে সব ক’টি, অর্থাৎ ২৯টি ম্যাচ খেলে সেই মরশুমে সাতটি গোল ও পাঁচটি অ্যাসিস্ট করেন পেট্রাটস।
এক বছর দক্ষিণ কোরিয়ার ক্লাব উলসান হিউন্ডে-র হয়ে খেলে নিউক্যাসল জেটসের জার্সি গায়ে মাঠে নামতে আবার তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ফেরেন। তাদের হয়ে ৭৯টি ম্যাচে ২২টি গোল করেন। ওখান থেকেই আল ওয়েহদা এফসি-র সঙ্গে চুক্তি করে চলে যান সৌদি আরবে এবং ২০২১-২২ মরশুমে তারাই তাঁকে ওয়েস্টার্ন সিডনির হয়ে খেলার জন্য ধার দেন। রাশিয়ায় গত বিশ্বকাপের মূলপর্বে তিনি অস্ট্রেলিয়ার স্কোয়াডে থাকলেও মাঠে নামার সুযোগ পাননি। দেশের হয়ে এ পর্যন্ত তিনটির বেশি ম্যাচ খেলতেও পারেননি তিনি। তিনটিই ফ্রেন্ডলি ম্যাচ।
সবুজ মেরুন শিবিরের নতুন অস্ত্র
এটিকে মোহনবাগান এফসি-র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কোচ হুয়ান ফেরান্দো এমন একজন স্ট্রাইকার খুঁজছিলেন, যিনি প্রয়োজনে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলতে পারেন। পেট্রাটস সে রকমই একজন ফুটবলার, যিনি দেশ ও ক্লাবের হয়ে এই দুই ভূমিকা ছাড়াও উইঙ্গার হিসেবেও খেলেছেন।
এক সময়ে এটিকে মোহনবাগান সমর্থকদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন যিনি, সেই ফিজিয়ান স্ট্রাইকার রয় কৃষ্ণার বেঙ্গালুরু এফসি-তে যোগ দেওয়ার ঘোষণার দিনই সবুজ-মেরুন শিবির এই অজি ফুটবলারের নাম জানিয়ে দেয় সরকারি ভাবে। ফলে অনেকেই হয়তো ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন রয় কৃষ্ণার বিকল্প হিসেবে তাঁকে আনা হয়েছে দলে। সত্যিই কি তাই?
রয় কৃষ্ণাকে যেমন বিপক্ষের গোল এরিয়াতেই বেশির ভাগ সময় দেখা যেত, অসাধারণ সব গোলও উপহার দিয়েছেন তিনি। পাঁচ ফুট ন’ইঞ্চির পেট্রাটস কিন্তু মূলত অ্যাটাকিং ফুটবলার। গোলের সুযোগ তৈরি করেন তিনি। তাঁর পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়, তিনি যত না গোল করেছেন, গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন অনেক বেশি। ‘নাম্বার নাইন’ হিসেবে না ভেবে তাঁকে ‘নাম্বার টেন’ হিসেবে ধরাই ভাল। অন্তত তাঁর অতীতের রেকর্ড সে রকমই বলছে। তবে ফেরান্দো তাঁকে কোন ভূমিকায় চাইবেন ও ব্যবহার করবেন, তা তিনিই জানেন।
দলের নতুন বিদেশিকে নিয়ে ফেরান্দো বলেছেন, “দিমিত্রি এমন একজন টিমপ্লেয়ার, যে আক্রমণাত্মক মানসিকতা নিয়ে খেলে। ও সতীর্থদের জায়গা তৈরি করে দিতে সাহায্য করবে, দুর্দান্ত পাস দেবে এবং গোলের সামনে যথেষ্ট কার্যকরী হয়ে উঠবে”। কোচের কথায় একটা ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, বিভিন্ন ভূমিকায় তিনি দেখতে চান তাঁর দলের এই নতুন সদস্যকে।
এর আগে রাইট উইঙ্গার হিসেবেও তিনি খেলেছেন। এমনকী জাতীয় দলেও তাঁকে এই পজিশনে খেলতে দেখা গিয়েছে। এটিকে মোহনবাগানে এ বার যেহেতু প্রবীর দাস নেই, তাই রাইট উইঙ্গার হিসেবে তাঁকে ব্যবহার করার কথা ভাবতে পারেন ফেরান্দো। তা ছাড়া বিপক্ষের ফুটবলারদের পা থেকে বল ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতাও তাঁর মধ্যে প্রবল, যা তাঁকে যে কোনও অভাবনীয় পরিস্থিতি তৈরি করতে সাহায্য করে।
‘গোলমেশিন’-এর বিকল্প?
সুতরাং, যাঁরা ভাবছেন রয় কৃষ্ণার বিকল্প হিসেবেই পেট্রাটসকে খেলাবেন ফেরান্দো, তাঁরা ঠিক নাও হতে পারেন। মনে রাখবেন, পেট্রাটসের মতো আরও দু’জন তুখোড় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার দলে রয়েছেন, হুগো বুমৌস এবং জনি কাউকো। যেহেতু চারজনের বেশি বিদেশি প্রথম এগারোয় রাখার নিয়ম নেই, তাই এঁদের তিনজনকে একসঙ্গে মাঠে নামানো কঠিন।
বুমৌস, কাউকো ও পেট্রাটসকে একসঙ্গে নামাতে গেলে রক্ষণে মাত্র একজন বিদেশিকে রাখতে পারবেন কোচ। কার্ল ম্যাকহিউ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে যে যথেষ্ট কার্যকরী, তা তিনি গত দুই মরশুমেই প্রমাণ করেছেন। তাঁকে বাইরে রেখে প্রথম এগারো ভাবাও কঠিন। তাই এই তিনজনকে ঘুরিয়ে ফিরিয়েই মাঠে নামাতে হবে।
সবুজ-মেরুন শিবিরের আক্রমণে যেমন লিস্টন কোলাসো রয়েছেন, তেমনই মনবীর সিংও রয়েছেন। এঁদের কাছে যাতে আরও ঘনঘন গোলের বল সরবরাহ হয়, সে জন্যই একাধিক বিদেশি অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার নিয়েছেন ফেরান্দো। অর্থাৎ, তিনি চান, গোলের সুযোগ তৈরি হওয়া শুরু হোক মাঝমাঠ থেকেই। এবং এই কাজে পেট্রাটস যথেষ্ট কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেন।
তা ছাড়া এ বার যেহেতু মরসুম আরও দীর্ঘ। তাই শক্তিশালী রিজার্ভ বেঞ্চ তৈরি রাখা খুবই জরুরি। কেউ কোনও কারণে খেলতে না পারলে যাতে তার উপযুক্ত বিকল্প নামানো যায়। এর চেয়ে ভাল পরিকল্পনা আর কী হতে পারে?
রয় কৃষ্ণা যেমন হিরো আইএসএলে এসে একঝাঁক গোল উপহার দিয়েছেন (৬০ ম্যাচে ৩৬ গোল, ১৮টি অ্যাসিস্ট) পেট্রাটসের কাছে অতটা আশা করাটা বোধহয় ঠিক হবে না। প্রথমত, তাঁর অতীতের পরিসংখ্যান সে কথা বলছে। ১৩ বছরের পেশাদার ক্লাব ফুটবল জীবনে তিনি ৫৬টি গোল করেছেন। তিনি গোল করতে যতটা না পারদর্শী, তার চেয়ে গোলের সুযোগ তৈরিতে বেশি দক্ষ।
‘গোল করতেই হবে, ভেবে মাঠে নামি না’
সম্প্রতি এটিকে মোহনবাগানের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পেট্রাটসকে যখন বলা হয়, সমর্থকেরা তাঁর কাছ থেকে প্রচুর গোল দেখার আশা নিয়ে বসে রয়েছেন. তখন তিনি বলেন, “আমি বিভিন্ন পজিশনে খেলতে পারি। এখানে আমাকে কোন জায়গায় খেলতে হবে, তা ঠিক করবেন কোচ। তিনি জানেন আমি সবচেয়ে ভাল কোন কোন জায়গায় খেলি। যে কোনও ফুটবলারের কাছে গোল করাটা বড় ব্যাপার। আমাকে সেই দায়িত্ব দিলে নিশ্চয়ই সেই চেষ্টা করব। আমাকে কোন ভূমিকা পালন করতে হবে, তা জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। তবে গোল করতেই হবে, ভেবে আমি মাঠে নামি না। আগে খেলাটা উপভোগ করতে চাই, তার পরে অন্য কিছু। এটুকু বলতে পারি, যে দায়িত্বই দেওয়া হোক, নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব”।
তাঁকে যদি তাঁর স্বাভাবিক ফুটবল খেলতে দেন কোচ, তা হলে পেট্রাটসের পা থেকে বোধহয় প্রচুর গোল আশা না করাই ভাল। বরং আরও ঘনঘন গোলের পাস বা ক্রসের জন্য কোলাসো, মনবীরদের তৈরি থাকতে হবে। কারণ, এ মরশুমে হয়তো আরও বেশি সাপ্লাই আসবে তাঁদের কাছে, যা থেকে গোল করাটাই হবে তাঁদের প্রধান কাজ।
ক্লাবের সোশ্যাল পেজের এই লাইভ আড্ডায় পেট্রাটস বলেছেন, “দলের সতীর্থদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক তৈরি করাই আমার প্রথম কাজ। মাঠে ও মাঠের বাইরে ওদের সঙ্গে ভাল বোঝাপড়া গড়ে তুলতে হবে আমাকে। দলে আর একজন অজি রয়েছে (ব্রেন্ডান হ্যামিল)। ফলে আমার সুবিধাই হবে”। এই বোঝাপড়াটা নিখুঁত হয়ে উঠলে গতবারের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে এটিকে মোহনবাগান।
ষাট হাজারের গর্জনের রোমাঞ্চ
তা ছাড়া এ বার খেলা হবে ঘরের মাঠে, নিজেদের সমর্থকদের সামনে। কলকাতার সমর্থকেরা গলা ফাটিয়ে ফুটবলারদের কতটা উজ্জীবিত করতে পারেন, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। একসঙ্গে ৬০-৬৫ হাজার মানুষের গর্জন যে কোনও ফুটবলারের কাছেই প্রবল উদ্দীপক হয়ে উঠতে পারে। এই প্রসঙ্গে পেট্রাটস বলেছেন, “কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে যে সংখ্যক দর্শকাসন রয়েছে (প্রায় ৬৭ হাজার) এত দর্শকের সামনে আমি খুব কম ম্যাচই খেলেছি। তাই কলকাতার মাঠে খেলার জন্য মুখিয়ে রয়েছি। আশা করি, প্রতি ম্যাচেই ৬০-৬৫ হাজার সমর্থক আসবেন। শুনেছি, কলকাতার সমর্থকেরা ফুটবল-পাগল। সত্যিই সে রকম হলে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চলেছি”।
সত্যিই কলকাতার ফুটবল-পাগল জনতাকে খুশি করতে পারবেন কি না এই অস্ট্রেলীয় তারকা, তা তো সময়ই বলবে। কিন্তু তাঁর সাফল্যের আশা নিয়ে যে বসে রয়েছেন লক্ষ লক্ষ সবুজ-মেরুন সমর্থক। যে ভাবে তাঁর প্রতি শুভেচ্ছা-বার্তা উপছে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
(লেখা আইএসএল ওয়েবসাইট)
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google