জিম কর্বেট ন্যাশনাল পার্ক, জঙ্গলের অন্দরে

জিম কর্বেট

মেঘ বালিকা : আমাদের গন্তব্য জিম কর্বেট ন্যাশনাল পার্ক। নিঝুম জঙ্গলে কখনও দুর থেকে ভেসে আসে অচেনা পাখির ককর্শ গলা। সেই ডাক দুর থেকে কাছে এসে আবার হারিয়ে যায় অনেক দুরে। সারা রাত ধরে শোনা যায় রেসর্টের সামনে বয়ে যাওয়া নদীর ছলাৎছল শব্দ। ঘন পাহাড়ি জঙ্গলের নিস্তব্দতা ভেঙে যায় বার বার। রেসর্টের লনের আধা আলোয় হঠাৎ নদী পেড়িয়ে ছুটে যায় কিছু। গা-টা তখনই ছমছম করে ওঠে। মনের কোণায় জমা হয় জঙ্গলের অন্দরে ঢুকে পড়ার অদম্য ইচ্ছেটা। ডিনার শেষে হালকা ঠান্ডা ছুঁয়ে যায় মন, শরীরকে। একে একে নিভে যায় রেসর্টের আলো। তখনও কেমন একটা গা ছমছমে ভাব জাঁকিয়ে বসে। ঘুমের দেশে যাওয়ার সময় হয়েছে যে।

জিম কর্বেট ন্যাশনাল পার্ক

নৈনিতাল থেকে সেই কোন সকালে গাড়ি ছুটেছিল করবেট ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশে। রাস্তায় বার কয়েক প্রকৃতির শোভা দেখতে দাঁড়িয়ে যখন করবেটে পৌঁছলাম তখন দুপুর গড়িয়েছে প্রায়। তড়িঘড়ি লাঞ্চ সেরে রেসর্টের শোভায় মজেছিলাম আমরা। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি কখন উধাও হয়ে গিয়েছিল টেরই পাইনি। কিন্তু রাত বাড়তেই ঘুমের ডাকে সারা না দিয়ে পারলাম না। রাতেন নীল আকাশ ধরা দিল কাচের জানলা দিয়ে। সেদিন লক্ষ্মী পূর্ণিমা যে। কলকাতায় সবার বাড়িতে লক্ষ্মী পুজোর ঢল। আমরা সে সব থেকে অনেক দুরে পাহাড়ি জঙ্গলে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাই ঘুরে দেশে।

জিম কর্বেট ন্যাশনাল পার্ক

পরদিন সকাল হল গরম গরম চা সহযোগে। সবুজের মাঝে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার মজাই আলাদা। এই লনেই কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সামনে কখনও দেখা হয়ে যেতে পারে নদী পেড়িয়ে জল পান করতে আসা হরিনের দলকে। পাহাড়ের গা ছুঁয়ে কখনও নেমে আসে অচেনা বিরাট ডানা ওয়ালা পাখি। পাখি না চেনার সমস্যা। তবে নাম না জেনে না চিনে দেখার মজাই আলাদা। তাদের বিভিন্ন সুরে জমে ওঠে সকাল। এর পর ব্রেক ফাস্ট আর জমিয়ে লাঞ্চ। বিকেল হতেই রেসর্টের বাইরে হাজির জোড়া হুড খোলা জিপ।

জিম কর্বেট ন্যাশনাল পার্ক

আসল অ্যাডভেঞ্চারের শুরু তো এখান থেকেই। রেসর্ট থেকে সেই জিপ ছুটে চলে মূল জঙ্গলের পথে। একটা সময় শহরের রাস্তা পাড় করে গেট পেড়িয়ে আমাদের জিপ পার্মিট নিয়ে ঢুকে পরে জঙ্গলের মধ্যে। সব হই হট্টোগোল থেকে দুরে শান্ত পরিবেশ। গাড়ি চলার শব্দ ছাড়া কোনও শব্দ করা চলবে না। গাড়ি ক্রমশ ঢুকে পড়ে গভীর জঙ্গলে। পাহাড়ের গা দিয়ে পাকদন্ডী পথ উঠে চলে উপরের দিকে। করবেট ন্যাশনাল পার্কের বিশেষত্ব পাহাড় ঘেরা খোলা বিস্তৃত প্রান্তর। গাছপালার তেমন বহর নেই। তার মাঝেই হঠাৎ পড়ন্ত সূর্যের আলোয় দেখা যায় পেখম মেলে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে ময়ুরের দল। গাড়ির শব্দে ছুটে পালায় তারা।

জিম কর্বেট ন্যাশনাল পার্ক

পরের বাঁকেই খাদের জলে ঝাঁকে ঝাঁকে হরিনের দলের হুরোহুরি দেখে ক্যামেরা ক্লিক বন্ধই হতে চায় না। কিন্তু আলো পড়ে আসছে তাই আবার চলার শুরু। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে শুধুই চমক। গা ছমছমে আবহ। বাঘের দেখা যদিও মেলেনি। কিন্তু বইয়ের পাতায় পড়া সেই জিম করবেটের গল্প আবার ফিরে এসেছে। এই জঙ্গলেই দেখা দিয়েছিল সেই মানুষ খেকো বাঘ। যার হাত থেকে স্থানীয় মানুষদের মুক্তি দিয়েছিলেন জিম কর্বেট।

জিম কর্বেট ন্যাশনাল পার্ক

গাইডের কাছে গল্প শুনলাম এরকম এক মানুষ খেকো নাকি আবার নতুন ভাবে দেখা দিয়েছে এই জঙ্গলে। তাই আপাতত ট্যুরিস্টদের গভীর জঙ্গলে যাওয়া নিষিদ্ধ। বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীর উপর সে আক্রমণও চালিয়েছে। পাহাড়ের কোন খাঁজে সে লুকিয়ে রয়েছে কেউ জানে না। তাই সাবধানেই এখন ঘুরতে হচ্ছে। আতঙ্কটা ছড়িয়ে পড়ে সবার মধ্যে। ফেরার পথে, হঠাৎই পর পর দাঁড়িয়ে পরে সব গাড়ি। ওই পাশের জঙ্গলেই নাকি এখুনি দেখা গিয়েছে বাঘ। সে আবার বেরিয়ে আসতে পারে। তাই রাস্তার দু’পারে ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়ে সব গাড়ির ট্যুরিস্টরা। ভয় হয় এই গাড়ি তো পুরো খোলা, যদি গাড়িতে আক্রমণ করে। অন্ধকার নামে জঙ্গলের ভিতরেই। কিন্তু বাঘের দেখা মেলে না। এ বার ফিরতে হবে সেই রেসর্টে। যেখানের টানও অমোঘ। শান্তি, ভাললাগা, ভালবাসারা গা জড়াজড়ি করে আমার অপেক্ষায়।

ঘরের পাশের পলাশ বাগ বরন্তী