এখানে ইতিহাস কথা বলে। এই শহরের আনাচ-কানাচে কান পাতলে এখনও শোনা যায় মুঘল সাম্রাজ্যের কাহিনি। চোখ মেললে দেখা যায় মুঘল স্থাপত্যের হাতছানি। আর তারই কেন্দ্রে ১৫০ বছরের ইতিহাসকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে Agra ক্যান্ট স্টেশন বা আগ্রা ছাউনি। আগ্রার ঐতিহাসিক ঘিঞ্জি সদর বাজারের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে এই স্টেশনে। ছোট্ট ছিমছাম স্টেশনের দখল কিন্তু হনুমান বাহিনীর হাতেই থাকে, তা সেখানে পা দিয়েই বোঝা গেল। এই স্টেশনে বসে কিছু খেতে গেলে একটু সাবধান থাকতেই হবে। কখন যে তারা এসে হামলা চালাবে আপনি টেরও পাবেন না। তবে এর বাইরে খুব একটা বিরক্ত করেন না তারা। বরং নিজেদের মতই প্ল্যাটফর্ম চত্তরে ঘুরে বেড়ান। কখনও ছাদে, কখনও লাইনে আবার কখনও দেখা গেল প্ল্যাটফর্মের পুরো ডাস্টবিনটাই উল্টে দিয়ে খাবার খুঁজতে। যে ভাবে কোল্ডড্রিঙ্কের বোতল থেকে ফ্লোরে ঢেলে ঢেলে তা তারা পান করলেন সে দৃশ্য দেখার মতো। মুঘলরা বিদায় নিয়েছে, এদের রেখে গিয়েছে।
আগ্রা মানেই মানুষের মনে সবার আগে যেটা আসে সেটা হল তাজমহল। শহরের কেন্দ্রে জমুনার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুধসাদা পাথরের তৈরি মুমতাজের স্মৃতি বিজরীত তাজমহল। যা স্ত্রী মুমতাজের স্মৃতিতে বানিয়েছিলেন শাহজাহান। আর এই শহরের আরও এক আকর্ষন আগ্রাফোর্ট। যেখান থেকে রাজত্ব চালাত মুঘলরা। সেই রাজপ্রাসাদেই একদিন ছেলের হাতে বন্দি হয়ে শেষ জীবন কাটাতে হয়েছিল শাহজাহানকে। আগ্রার দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় এমনই কত কত কাহিনি। ছোটবেলার বইয়ের পাতার ইতিহাস যখন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে তখন অদ্ভুত অনুভূতি স্পর্শ করে যায়। সেই ইতিহাসের টানেই বার বার ছুটে যাওয়া এই শহরে। তবে এর আগে কখনও আগ্রা স্টেশন চত্তরে যাওয়া হয়নি। এবার সেই সুযোগ চলে এসেছিল।
আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে আমাদের গন্তব্য ছিল রাজস্থানের সোয়াই মাধোপুর। সেখানেই বিখ্যাত জাতীয় উদ্যান রনথম্বোর। সেই স্টেশনের কথাও বলব। তার আগে একটু ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে ভীষনভাবে জরিয়ে রয়েছে দেশের রেল পরিসেবা। ভারতীয় রেল যেভাবে পুরো দেশকে এক সুতোয় বেঁধেছে তা নিয়মিত রেলযাত্রা না করলে বোঝা মুশকিল। তারই একটা অংশ এই আগ্রা ক্যান্ট, যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জরিয়ে রয়েছে ভারতের ইতিহাস, ভারতীয় রেলের ইতিহাস।
আগ্রা প্রথম ভারতীয় রেলের মানচিত্রে যুক্ত হয় ১৮৭৪ সালে। সাড়ে তিন ফিটের দিল্লি-বাঁদকুই এবং বাঁদকুই-আগ্রার মধ্যে চালু হয় রাজপুতানা স্টেট রেলওয়ে। সেই লাইন এখনও রয়েছে আগ্রা স্টেশনে। কিছুটা অবহেলায় যেন অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। আমার অটো আমাকে সেই পরিত্যক্ত স্টেশনের সামনে নামিয়ে দিয়েই চলে গেল। এই স্টেশন সম্পর্কে না জানায় সেখানেই নেমে পড়ি। তখনও ঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভাঙছে আগ্রা চত্তর। সদর বাজারের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে দেখছিলাম, বন্ধ দোকানপাট। স্থানীয় বিখ্যাত পেঠার কিছু দোকার খুলে বসেছেন দোকানীরা। সেখান থেকেই পেঠা কিনে আবার স্টেশনের দিকে রওনা দিই। আগ্রা ফোর্টের বিশাল বাউন্ডারি দেওয়ালের গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে রয়েছে স্টেশন। পিছনের যে অংশে আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল অটো সেখানেই গা এলিয়ে বসে ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন। তাঁরাই জানালেন, আমাদের যেতে হবে উল্টো পাশে। পুরো ঘুরে না গিয়ে এই পরিত্যক্ত স্টেশনের মধ্যে দিয়েই মূল স্টেশনে পথ ধরলাম।
১৮৭৪-এর পর নিশ্চই এই প্ল্যাটফর্মের গায়ে রঙের প্রলেপ পড়েছিল কিন্তু এখন তা রঙহীন, প্রানহীন। প্রানের ছোয়া বলতে ইতিউতি গা এলিয়ে থাকা কিছু স্থানীয় মানুষ আর ছাগল, কুকুরের দখলে। তাদের নিশ্চিন্ত বিশ্রামের জায়গা। তবে সেই প্ল্যাটফর্ম চত্তরের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ভাবার চেষ্টা করছিলাম প্রথম এই লাইনেই ট্রেন চলেছিল, রাজপুতানা রেলের সৌজন্য। এখন অবশ্য উত্তর-মধ্য রেলের অধিনে এই লাইন। ঐতিহাসিক সেই লাইন পায়ে হেঁটেই পার করলাম। তার পর পুরনো সেই সিঁড়ি বেয়ে উল্টোদিকের স্টেশনে যেতে হল। সেই সিঁড়িও জনমানব শূন্য। শুধু আমরা ক’জন। তবে এই মিটারগেজ লাইন কয়েকবছর আগে পর্যন্তও ছিল। ২০০৫-এ আগ্রা-জয়পুর লাইনকে ব্রডগেজে পরিণত করা হয়। তার আগেই ১৯০৪-এ আগ্রা-দিল্লি ব্রডগেজ কর্ড লাইন চালু হয়ে গিয়েছিল।
এই স্টেশন থেকেই ইতিহাসের স্পর্শ পাওয়া যায়। স্টেশন চত্তর থেকেই দেখা যায় আগ্রাফোর্টের বিশাল লাল দেওয়াল। স্টেশন চত্তর থেকে বেরিয়েই টের পাওয়া যাবে মুঘল সাম্রাজ্যের আধিপত্তের বিস্তার। ১৬-১৭ শতকে এখানেই ছিল মুঘলদের রাজধানী। এই স্টেশন থেকে তাজমহলের দুরত্ব ৫.৭ কিলোমিটার আর আগ্রা ফোর্টের মূল গেটের দুরত্ব ৫.২ কিলোমিটার। এখান থেকে চলে যাওয়া যায় ৯.৭ কিলোমিটার দুরত্বের সেকেন্দ্রা, ৩৮ কিলোমিটার দুরত্বের ফতেপুর-সিক্রিতেও, যা একসময় মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। এই শহরের প্রতিটি কোণায় রয়েছে মুঘলদের স্মৃতি।
এই শহরের মধ্যেই রয়েছে আরও একটি স্টেশন, আগ্রা ফোর্ট স্টেশন। তবে দূরপাল্লার বেশিরভাগ ট্রেনই যায় ক্যান্ট স্টেশন থেকে। রাজপুতানা স্টেট রেলওয়ের অধিনেই তৈরি হয়েছিল এই স্টেশন, ১৮৭৪-এই। ভারতীয় রেলের সব থেকে পুরনো স্টেশনগুলোর মধ্যে অন্যতম আগ্রা। পরবর্তী সময়ে রাজপুতানা স্টেট রেলওয়ে নাম বদলে হয় রাজপুতানা-মালওয়া রেলওয়ে আর এখন তা বম্বে, বরোদা এবং মধ্য রেলের অন্তর্গত, সেটা ১৯০০ সাল। এই স্টেশনটি অবস্থিত একদম শহরের মধ্যে, জামা মসজিদ ও আগ্রা ফোর্টের দিল্লি গেটের মাঝখানে। মুঘল আমলে এখানে ছিল বিখ্যাত বাজার ত্রিপলি চক। কিন্তু আগ্রা ফোর্ট স্টেশন তৈরির সময় ব্রিটিশরা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় এই ত্রিপলি চক। সেখানেই গড়ে ওঠে আগ্রা ফোর্ট স্টেশন। এখনও কি আগ্রা ফোর্ট স্টেশনের দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যাবে মুঘল মহিলাদের কলকাকলি? লালকেল্লার মিনা বাজার দেখলে এই ত্রিপলি চককে কল্পনা করা যাবে অনেকটাই। তবে এই প্রজন্মের কাছে তা শুধুই কল্পনা।
প্রথমেই বলেছি উত্তর প্রদেশের এই শহরে ইতিহাস কথা বলে। পুরো শহরটা জুড়েই রয়েছে নানান স্মৃতি। সাধারণ ট্যুরিস্টের চোখ দিয়ে দেখলে শুধুই তাজমহল আর আগ্রা ফোর্ট। কিন্তু ইতিহাসকে দেখার নজর থাকলে দেখা যাবে, আসলে আগ্রার স্টেশন হোক বা বাজার, আগ্রার আকাশে, বাতাসে শুধুই মুঘল সাম্রাজ্যের কাহিনি। তাজমহলের ভিতরে ঢুকে সেই সাদা পাথরের প্রেমের সৌধকে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি মুহূর্তে বদলে যায় যখন আগ্রা ফোর্টের জাফরি দিয়ে দূরে তাজমহলকে দেখা যায়। প্রেম আর যন্ত্রণার অনুভূতি যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। ফতেপুর-সিক্রি থেকে আগ্রা হয়ে দিল্লি, মুঘলরা তৈরি করেছে একাধিক ইতিহাস। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল লালকেল্লা থেকেই। সেই ব্রিটিশদের হাতেই তৈরি ভারতীয় রেলের মূল মানচিত্র। যা জুড়ে রেখেছে গোটা দেশকে।
আগ্রার ইতিহাসকে বিদায় জানিয়ে ট্রেন এগিয়ে গেল গন্তব্যের দিকে। ট্রেনের মন্থর গতির সঙ্গে একটু একটু করে সরে সরে যেতে থাকল ইতিহাস। হঠাৎ কোথাও দেখা গেল একফালি ভেঙে পড়া কোনও দেওয়াল। জানা হল না, সেটা কী। আসলে সবটা না জানাই ভাল। কিছু জিনিস অধরা থাকাই তো জীবনের মজা। আগ্রহটা বজায় থাকে। আগ্রা ফোর্টের একঝলক দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে গেল গাছের আড়ালে। আগ্রার ইতিহাস শুরু হয়েছিল সিকান্দর লোধি এবং পরবর্তীকে তাঁর ছেলে ইব্রাহিম লোধির সময়ে কিন্তু স্বর্ণযুগ অবশ্যই মুঘলদের সময়। বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের রাজত্বের কাহিনিই আগ্রার ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ১৮ শতকে মারাঠারা আগ্রার দখল নেয় এবং পরবর্তীতে ইস্ট-ইন্ডিয়া কম্পানী। স্বাধীনতার পর আগ্রা ক্রমশ ভ্রমনার্থীদের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। দিল্লি ও জয়পুরের সঙ্গে গোল্ডেন ট্রাইয়েঙ্গল ট্যুরিস্ট সার্কিটের অংশ আগ্রা। আগ্রা নামের অর্থ নিয়ে অনেক আলোচনা, জল্পনা রয়েছে। সেটা জল্পনাই থাক। তবে শাহজাহান তাঁর দাদু আকবরের স্মৃতিতে এই শহরের নাম দিয়েছিলেন আগবরাবাদ। আগ্রা হোক বা আগবরাবাদ, ভারতীয় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও একইভাবে দাঁড়িয়ে এই শহর, এই শহরের আনাচ-কানাচ, এই শহরের রেল লাইন। যা আগ্রাকে জুড়ে দিয়েছে পুরো দেশের সঙ্গে।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google