সুচরিতা সেন চৌধুরী: পুরো রাস্তার ভাললাগার কথা বলতে বলতেই পৌঁছে গেলাম শিমলায় (Alone In Shimla)। ঠিক যতটা ভাললাগা কালকা স্টেশনকে দেখে তৈরি হয়েছিল ততটাই হল শিমলা স্টেশনকে দেখে। সব পাহাড়ি স্টেশনেরই একটা মায়া থাকে। শিমলাও ছিল তেমনই মায়ায় ঘেরা। গোটা রাস্তায় তেমন মেঘ না পেলেও শিমলা স্টেশন ছিল মেঘে ঢাকা। লাইনের ধারের রেলিং টপকে স্টেশন চত্তরে ঢুকে পড়ার প্রতিযোগিতা চলছে। সকাল সকালই পৌঁছে গেলাম শিমলা। বাইরে গাড়ির হাঁকডাক ভিতর থেকেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যাব কোথায়? কোনও হোটেল বুকিং নেই। তবে ভাল বিষয় ছিল বর্ষাকাল হওয়ায় পাহাড়ে অফসিজন তখন। সেই সময় হত। এখন পাহাড়ে সব সময়ই সিজন।
শিমলা ম্যাল রোডে গাড়ি চলে না। তাই ম্যাল রোডে ওঠার রাস্তার মুখে আমাদের গাড়ি নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। চোখের সামনে তখন এক বিস্তৃত চড়াই। সারা রাতের ট্রেন জার্নির পর সারা সকালের আরও এক পর্ব ট্রেন চড়ে তখন বেশ ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু ভাঙতে হবে সে চড়াই। আর কোনও উপায় নেই। মনে পড়ছে না সে সময় লিফট ছিল কিনা। পরেরবার গিয়ে লিফটে করেই ম্যাল রোডে পৌঁছে গিয়েছিলাম। এ এক দারুণ ব্যবস্থা। আর কোনও পাহাড়ে আছে কিনা জানি না। যাক, আমাদের চলা শুরু হল। সবার হাতেই ভাড়ি ব্যাগ। মাঝে মাঝেই বিশ্রাম নিতে হল, কারণ হাফ ধরে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ওই রাস্তার উপরই একটা হোটেল দেখে ভাল লাগল। এই মুহূর্তে অনেক চেষ্টা করেও নামটা মনে করতে পারছি না।
পুরো সাদা ৪ তলা বাড়িটির সব ঘরের বড় বড় জানলাগুলো রাস্তার দিকে। রাস্ত থেকেই দেখা যাচ্ছে। প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে গেল। বড় ঘর, পরিষ্কার, সেই সময় সেটা থ্রি স্টার হোটেল ছিল। তবে অফ সিজন হওয়ার আমাদের সাধ্যের মধ্যে চলে পেয়ে গেছিলাম। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে, লাঞ্চ করে একটু বিশ্রাম নিয়েই পুরো তরতাজা আমরা। পাহাড়ে গিয়ে কী আর ঘরে বসে থাকা যায়। তবে ততক্ষণে সন্ধে নেমেছে। বর্ষাকাল, কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে একপশলা। আসার সময় ঠান্ডা না লাগলেও সন্ধে নামতেই ঠান্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। আমরাও হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটা লাগালাম ম্যালের দিকে। আমাদের হোটেলের ঠিক পাস দিয়েই উঠে গিয়েছে শিমলার বিখ্যাত কালিবাড়ি যাওয়ার সিঁড়ি। রাস্তাও আছে ঘুরে। কিন্তু আমরা তখন শিমলা ম্যাল দেখার অপেক্ষায়।
শিমলা ম্যাল প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ করেছিল। বিশাল ম্যাল চত্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গুটিকয় মানুষ। হুহু করে হাওয়া বইছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী। হলুদ চার্চের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে ততক্ষণে। বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় ভেজা পুরো ম্যালে আকাশের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ছে। কখনও কখনও ছিটে ফোটা জলের ফোটা এসে লাগছে গায়ে। এখানে বলে রাখি, পরিকল্পনা ছাড়া আসায় সঙ্গে তেমন কোনও গরম জিনিস ছিল না। শিমলায় কাজ চলে গেলেও পরবর্তীতে যে চলবে না সেটা বোঝাই গিয়েছিল। তাই এক প্রস্থ শপিংও করতে হয়েছিল শিমলার অত্যধিক দামী মার্কেট থেকে।
সে সময় সস্তা মার্কেটের খোঁজ পাইনি। পরের বার গিয়ে পেয়েছিলাম। ওই কনকনে ঠান্ডায় সেদিন প্রথম আইসক্রিম খেয়েছিলাম। ম্যালের মুগ্ধতা এক ঝটকায় কাটিয়ে দিল ঝড়। আকাশ, বাতাস তোলপাড় করে ঝড় উঠলো হঠাৎই। উপায় না দেখে হোটেলে দিকে দে দৌঁড়। পৌঁছতে পৌঁছতেই বৃষ্টি এল ঝেঁপে। গরম গরম কফি নিয়ে জানলায় চোখ রাখলাম। পাহাড়ের বৃষ্টির প্রেমে তো সেই কবে থেকেই পড়ে রয়েছি। নতুন করে ভালবাসতে ইচ্ছে করল এই পাহাড়ি বৃষ্টিকে।
পাহাড়ে রাত তাড়াতাড়ি হয়। তাই আমরাও দ্রুত ডিনার করে নিলাম। শিমলায় গিয়ে আমি প্রথম আলু-জিরা খেয়ে আপ্লুত হয়েছিলাম। গোটা ট্যুরে সব মেনুর সঙ্গেই থাকত আলু-জিরা। ডালফ্রাই, আলু-জিরা আর চিকেন দিয়ে জমিয়ে ভাত খেয়ে লেপের তলায় সেঁধিয়ে গেলাম সবাই। আমার মতো ভেতো বাঙালি সব জায়গায় গিয়েই ভাত খোঁজে। ঘুম আসতে দেড়ি হল না। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম দ্রুত। ঘুম কাতুরে আমার পাহাড়ে ভোর হয় তাড়াতাড়ি। আসলে মুহূর্তগুলো মিস করতে চাই না। আরও একটা দোষ আছে আমার। পাহাড়ি পথে একা একা হেঁটে বেড়ানোর। তার জন্য সকালটাই সেরা সময়। ব্রাশ করে, তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে রাস্তায়। তখনও আমার সঙ্গিরা ঘুমের দেশে।
পাহাড়ের ঘুম সকাল সকালই ভাঙে। কিন্তু ম্যাল চত্তর তখনও ঢেকে রয়েছে মেঘ-কুয়াশার চাদরে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে স্থানীয় লোকজন। হাঁটতে হাঁটতে চার্চের পাশের রাস্তা দিয়ে অজানার উদ্দেশে রওনা দিলাম। যত দূর চোখ যাচ্ছে, কোনও মানুষের দেখা নেই। গাছের পাতা থেকে মাঝে মাঝেই টুপটাপ এসে পড়ছে আটকে থাকা জল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই দেখলাম একটা রাস্তা নেমে গিয়েছে নিচের দিকে। ওই পথেই চলতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে কখন অনেকটা দূর পৌঁছে গিয়েছি খেয়ালই করিনি। হঠাৎই সামনে দেখি রেল লাইন।
কোথায় এলাম না বুঝতে পেরে স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করায় তিনি জানালেন লাইন ধরে হেঁটে গেলে সামনেই শিমলা রেল স্টেশন। গতকাল যে পথে হেঁটে উঠতে রীতিমতো হাল খারাপ হয়ে গিয়েছিল বুঝলাম আবার সে পথেই আমাকে ফিরতে হবে। কিন্তু এবার আর তেমন সমস্যা হল না। আরও একবার ছবির মতো স্টেশন ছুঁয়ে ম্যালে পৌঁছে দেখি বন্ধুরা রীতিমতো রেগে আগুন। বেরতে হবে সাইট সিনে আর আমি হাওয়া। তখন মোবাইল ফোনও ছিল না। বুঝলাম চিন্তাও হচ্ছিল। ওদের রাগ ভাঙিয়ে স্থানীয় দোকানে ম্যাগি, টোস্ট, অমলেট, চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম পুরো দিনের জন্য।
ছবি—লেখক
(দ্বিতীয় পর্ব)
Kalka-Shimla Toy Train: কালকা থেকে টয় ট্রেনে শিমলা, প্রথম পর্ব
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google