Train Station 10: Amritsar স্টেশন থেকেই শুরু হয় ইতিহাসের হাতছানি

Amritsar

Amritsar এমন কী জায়গা, যেখানে ঘুরতে যাওয়া যায়? না আছে পাহাড় না সমুদ্র, নিদেনপক্ষে ছোট-খাটো জঙ্গলের রেখাও নেই। তাহলে কেন পুজোর ছুটিটা দুটো দিন ওখানে থেকে সময় নষ্ট করব? প্রথম যখন হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে অমৃতসর তালিকাভুক্ত হয়েছিল তখন আমার রিঅ্যাকশন ঠিক এটাই ছিল। খুব বেশি ইতিহাস বইপ্রেমী ছিলাম না কোনও দিনই। সেই বইয়ের ইতিহাসকে সামনে থেকে দেখার যে অনুভূতি তা অতীতেও অনুভব করেছি। বিশেষ করে রাজস্থান, দিল্লি, আগ্রার মতো জায়গায়। দেখতে দেখতে বার বার হারিয়ে গিয়েছি ইতিহাসের পাতায়। শুনতে শুনতে যেন খালি চোখে দেখতে পেয়েছি সেই সময়কে। ইতিহাসের প্রভাব এটাই। তবে সেগুলো সবই ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস। অমৃতসর অবশ্য অন্য দিগন্ত খুলে দিয়েছিল চোখের সামনে। এই শহর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল ব্রিটিশ অত্যাচারের ইতিহাস। ভাবলে এখনও শিউড়ে উঠতে হয়।

অমৃতসর আসলে কী? একটা শুধুই শহর? নাকি ব্রিটিশ রাজের অত্যাচারের নজির? অমৃতসর মানে  স্বর্ণ মন্দির। অমৃতসর মানে ওয়াঘা বর্ডার। আর অমৃতসর মানে জালিয়ানওয়ালাবাগ। যে ইতিহাস পড়তে পড়তে ব্রিটিশ রাজের প্রতি ঘেন্না জন্মেছে, রাগ তৈরি হয়েছে। সেই জালিয়ানওয়ালাবাগ আজও একইভাবে দাঁড়িয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলে। গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলে মুহূর্তে বদলে যাবে পরিবেশ। চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে মনে তাকিয়ে রয়েছে ব্রিটিশ রাজের গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়া মানুষগুলো। হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই কুঁয়োর সামনে, প্রান বাঁচাতে যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যু বরণ করেছিল একাধিক সাধারণ মানুষ। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না সেই কুঁয়োর দিকে, যেন মনে হয় হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইছে নিরিহ মানুষগুলো। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল থমকে গিয়েছে এই চার দেওয়ালে। এর থেকে বেশি ইতিহাসের কচকচানি করে মন ভাড়াক্রান্ত করছি না কারণ সেই ইতিহাস সবার জানা। যা আজও জীবীত অমৃতসর শহরে। যে শহর আমাদের মতো ট্যুরিস্টদের জন্য শুরু হয় রেল স্টেশন থেকে।


সে এক কালীপুজোর সময়। আমাদের পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গিয়েছিল। রাত গভীর না হলেও অন্ধকার নেমেছিল অমৃতসর শহরে। আর অচেনা জায়গায় রাতের অন্ধকারে পৌঁছনো সব সময়ই বেশি সচেতন করে তোলে। তড়িঘড়ি স্টেশনের বাইরে থেকে ্টো নিয়ে চলে গিয়েছিলাম হোটেলে। সে রাতে আর কোথাও বেরনোর কোনও কথাও ছিল না। তাই রাতের খাবার সেরে সোজা ঘুম। পরদিন সকাল থেকে শুরু হবে ঘোরা। খুব হাতে গোনা জায়গা, জালিয়া‌নওয়ালাবাগ, স্বর্ণ মন্দির আর ওয়াঘা বর্ডার। সঙ্গে কিছু ছোটখাট মন্দির যেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ভারতের সব শহরেই তেমনই। পঞ্জাবের সব থেকে ব্যস্ত রেল স্টেশন এই অমৃতসর। পুরো দেশকে রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে রেখেছে এই স্টেশন। যে স্টেশন থেকে ট্রেন এক সময় পৌঁছে যেত পাকিস্তানের লাহৌরে। প্রাথমিকভাবে এই রেলরুটের দায়িত্ব ছিল সিন্দ রেওয়ের হাতে। ১৮৫৫ সালে তৈরি হওয়া প্রাইভেট এই রেলওয়ে সংস্থার মান ক্রমশ খারাপ হওয়ায় ১৮৮৬ সালে চুক্তি শেষ হতেই এই রেলপথের দায়িত্ব নিজেদের হাতে ন ইয়ে নেয় সরকার। তবে তার আগে সিন্দ রেলওয়ে, পঞ্জাব রেলওয়ে, ইন্দাস স্টিম ফ্লোটিলা ও দিল্লি রেলওয়ে সংযুক্ত হয়ে এই পথের রেল পরিষেবাকে এগিয়ে ‌নিয়ে গিয়েছিল তা সরকারের হাতে পৌঁছনোর আগে।

এই সিন্দ, পঞ্জাব অ্যান্ড দিল্লি রেলওয়ে তাদের মুলতান-লাহৌর-অমৃতসর রেলরুটের কাজ সম্পন্ন করে ১৮৬৫ সালে। তার আগে ১৮৬২ সালে অমৃতসর-আটারি-লাহৌর রুটের কাজ শেষ হয়। এই রুটের সঙ্গে প্রথম খুলে যায় অমৃতসর জংশন স্টেশন। তবে তাদের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট ছিল না ব্রিটিশ সরকার। এর পর ১৮৮৪-তে পঠানকোটের সঙ্গে জুড়ে যায় অমৃতসর রেল পরিষেবা। যা বাটালা ও গুরদাসপুরের মধ্যে দিয়ে দুই রেল স্টেশনকে যুক্ত করে। এই অমৃতসর স্টেশনের একটা অন্য গুরুত্ব রয়েছে। গুরুত্বের থেকেও বিশেষত্ব রয়েছে যা অন্যান্য রেল স্টেশন থেকে এই অমৃতসর রেল স্টেশনকে আলাদা তো করে বটেই। তবে ঐতিহাসিক স্থাপত্য এখন আর নেই, তা আগেই ভেঙে ফেলে স্থানীয় ইতিহাস ও শিখ আর্কিটেকচারকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে গড়ে উঠেছে অমৃতসর জংশন। বাইরে বিরাট চাতাল। আর এর ভিতর রয়েছে ১০টি প্ল্যাটফর্ম। ১এ, ১বি এবং ১-৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম রয়েছে এখানে। আর এখানেই ১বি প্ল্যাটফর্মকে বিশেষভাবে রাখা হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রেনের জন্য।

অমৃতসর শহর যেখানে শেষ হচ্ছে সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে পাকিস্তানের লাহৌর। এক কথায় ভারত-পাক বর্ডার। তাই সেখানে রয়েছে আর্মি বেসও। প্রতিদিন লেগে থাকে যাতায়াত। তাই এই বিশেষ ব্যবস্থা। প্রাথমিকভাবে এখানে পাঁচটি প্ল্যাটফর্ম থাকলেও ট্রেনের সংখ্যা এবং মানুষের কাছে এই স্টেশনের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হয় ৬ থেকে ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম। ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মকে বিশেষভাবে মালগাড়ির জন্যই ব্যবহার করা হয়। ১৬০ বছরেরও বেশি পুরনো এই ভারতীয় স্টেশন তাই অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। স্টেশনে ঢোকার সময়ই দেখা যাবে মূল গেটের সামনে রাখা রয়েছে স্বর্ণ মন্দিরের রেপ্লিকা। আসলে এই স্বর্ণ মন্দিরই অমৃতসরে প্রতিনিধিত্ব করে। যদিও আমার মন বার বার চলে যায় জালিয়ানওয়ালাবাগে। ব্রিটিশ শাসনকালে এই স্টেশন থেকে যে দুটো ট্রেন চলত তার নাম ছিল ফ্রন্টিয়ার মেল, যাকে গোল্ডেন টেম্পল মেলও বলা হত ও পঞ্জাব মেল। ব্রিটিশ অফিসিয়ালরা এই ট্রেন ব্যবহার করত। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এই দুই ট্রেন চলাচলে কিছু রদবদল আনা হয়। গোল্ডেন টেম্পল মেল অমৃতসর থেকে যাতায়াত শুরু করে এবং পঞ্জাব মেলকে নিয়ে যাওয়া হয় ফিরোজপুরে। অন্তর্গত এই স্টেশন থেকে কিছুদিন আগে পর্যন্তও চলে যাওয়া যেত প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে। আটারি পর্যন্ত আজও চলে ট্রেন। অমৃতসর-লাহৌর লাইনে ভারতের শেষ স্টেশন এই আটারি। একটিই ট্রেন প্রতিদি‌ন অমৃতসর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের এই আটারি স্টেশনে যায় স্মৃতি হাতড়ে ফিরে আসে আবার, সীমান্ত পেরিয়ে চেনা পথের হাতছানি উপেক্ষা করে।

যে অমৃতসরকে চেনা শুরু হয় তাঁর স্টেশনের ইতিহাস দিয়ে তা শেষ হয় ওয়াঘা বর্ডারে। মাঝে মাঝেই শিরোনামে উঠে আসে এই ওয়াঘা সীমান্ত। দুই দেশের কূটনৈতিক বোঝাপড়ায় বার বার জুড়ে যায়। ওয়াঘা সীমান্তে গিয়ে দেখেছিলাম, দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে খুলে যায় গেট। উল্টোদিকে তখন উন্মুক্ত লাহৌর। আজও দুই পঞ্জাবের আত্মীয়তা যে অটুট বোঝা যায়, যখন ওই মুহূর্তের সুযোগে দুই দেশে থাকা আত্মীয়, বন্ধুরা একে অপরের সঙ্গে দেখা করে, কুশল বিনিময় করে, সজল নয়নে গেটের অপর পাড়ে হারিয়ে যেতে দেখে প্রিয় মানুষদের। বন্ধ হয়ে যায় দরজা পরের দিনের অপেক্ষায়। ভারাক্রান্ত মনটা শান্তি খোঁজে স্বর্ণ মন্দিরের চাতালকে ঘিরে থাকা জলে পা ডুবিয়ে। হাতে হাতে পৌঁছে যায় লঙ্গরের গরম গরম খাবার। শেষ বিকেলের আলোয় স্বর্ণ মন্দির মুখ দেখে তার গা ছুঁয়ে থাকা জলাশয়ে। একবার শেষবারের মতো দেখি জালিয়ানওয়ালাবাগকে। অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে যেন ডুকড়ে কেঁদে উঠছে দেওয়ালগুলো। গুলির গর্তে জমে রয়েছে কান্না।

দেশভাগের স্মৃতি বুকে আকড়ে রয়েছে পার্টিসন মিউজিয়াম। আর রয়েছে একাধিক গুরুদ্বার। আরও ইতিহাসকে কাছ থেকে পেতে ঘুরে আসা যায় ১৭৬০-এ তৈরি গোবিন্দগড় ফোর্ট, যার ভিতরে থাকা মিউজিয়ামে রাখা আছে কোহিনূরের রেপ্লিকা। পুরাণে আছে এই অমৃতসরেরই রাম তীরথ নামে জায়গায় জন্ম হয়েছিল লব, কুশের। আর এখানেই রামায়ন লিখেছিল ঋষি বাল্মিকী। ১৫৭৪-এ চতুর্থ শিখ গুরু গুরু রামদাস জি-র অধিনে পত্তন হয়েছিল অমৃতসর শহরের। লেক-সহ একটি জঙ্গলকে শহরের রূপ দিয়েছিলেন তিনি। অমৃতসর শুধু একটা ডেস্টিনেশন নয়, অমৃতসর আসলে একটা জার্নি, যা পঞ্জাব, এমনকী ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের অন্তরআত্মাকে ছুঁয়ে চলে। অমৃতসর বদলের কাহিনী লিখে চলে প্রতিনিয়ত তার বর্তমানের ডাইরিতে, যেখানে সোচ্চারে বেঁচে থাকে ইতিহাস।

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle