লুংথুং নামটা শুনে দলের সকলেই এক বার নাক সিটকে ছিল। এ আবার কোন জায়গা? ট্যুর প্ল্যানে তো এটা ছিল না। হয় জুলুক নয় নাথান ভ্যালি। ট্যুরিস্টদের কাছে সেই সময় সবে বিখ্যাত হচ্ছে এই জায়গাগুলো। আমরাও বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বাধ সাধল জুলুকে থাকার জায়গা। একটাই জায়গা। তাতে পর পর দু’দিন জায়গা হচ্ছে না। তা হলে? তখন সেই হোম স্টে-র মালিকই আমাদের লুংথুং-এর কথা বললেন। জুলুক আর নাথান-এর মাঝখানে একটা ছোট জায়গা। থাকার জায়গাও একটাই। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল গোটা দল। নতুনের স্বাদ পেতে চলো লুংথুং, তার পর কী হল লিখছেন সুচরিতা সেন চৌধুরী।
ডিসেম্বরের শেষের দিকে ১০ হাজার ফিট উপরে তাপমাত্রার পারদ সারা ক্ষণ হিমাঙ্কের নীচেই রয়েছে। দুপুরের দিকে যদি একটু সূর্যের দেখা মেলে তা হলে পারদ কিছুটা উঠছে। তবে তাতে স্বস্তির কোনও জায়গা নেই। সঙ্গে সারা ক্ষণ ভয়ঙ্কর হুল ফোটানো ঠান্ডা হাওয়া থাকছেই। রোদের পিছন পিছন দৌড়ই সার হচ্ছে। যাক সে সব কথা। আসল কথা হল লুংথুং যাওয়া। তার আগের রাতটা কেটেছে জুলুকে। অপূর্ব সুন্দর জায়গা। হেঁটে হেঁটে স্বাদ পাওয়া যায় ইতিহাসের। ওল্ড সিল্করুট ধরে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাওয়া যায় পূর্ব সিকিমের এই জনপদে। তখনও জুলুক ফাঁকা। মিলিটারি বেস ক্যাম্পের বেশ কড়াকড়িই ছিল।
জায়গাটা মনে ধরে গিয়েছে, ছেড়ে যেতে মন চাইছে না কারও। তার উপর লুংথুং কেমন হবে কারও কোনও ধারণা নেই। যদিও আমার হোম স্টের মালিক জানিয়েছেন জুলুক পছন্দ হলে লুংথুং-ও পছন্দ হবে। তাঁর বিশ্বাসই আমাদের ভরসা আর কী। ও এখানে বলে রাখা ভাল, সে সময় সেই সব এলাকায় কোথাও গরম জলের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। গিজার তো দূরঅস্ত্। যার ফল সর্বত্র জল জমে বরফ। ইমার্জেন্সিতে ওদের বললে ওরা কোনও রকমে একপাত্র জল এনে দিচ্ছে। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত ভাবে জ্বালানো হয়েছে আগুন। ফায়ারপ্লেসের গ্রাম্য সংস্করণ।
এই সবই জুলুকে ছিল। না লুংথুংয়ে সে সবের কোনও বালাই নেই। বোঝাই যাচ্ছে প্রায় জল ছাড়া তিন দিন কাটানো। লুংথুং যাওয়ার দিন জুলুকে সোলারের বদান্যতায় কিছুটা জল গরম হয়েছিল তাতেই হালকা স্নান সেরেছিল সবাই। জুলুক থেকে খুব বেশি দূর নয় লুংথুং। উচ্চতা আরও খানিকটা বেশি, ১১ হাজার ফিটের আশপাশে। হাইওয়ের উপর একটা ছোট্ট জনপদ। গোটা কয়েক ঘর। তার মধ্যেই দুটো ঘরকে হোম স্টে করা হয়েছে। সেই দুটোই আমাদের জুটল। ঘরের পজিশনটা বলে বোঝানো মুশকিল। রাস্তা যেখানে বাঁক খেয়ে উপরে উঠছে তারই একটা কোণায় একদম খাদের গা ঘেঁষে কাঠের পাটাতনের দেওয়াল, কাঠের মেঝে আর টিনের ছাদ। ঘরে ঢুকে বুঝলাম ভেন্টিলেশনের অবাধ ব্যবস্থা। আর ওই উচ্চতায় হাওয়াটা সারা ক্ষণের জন্য বাড়তি পাওনা।
রাতে চিকেন-ভাত কী ভাবে শেষ করেছিলাম মনে পড়ছে না। কারণ পুরো আমিটাই মনে হচ্ছিল এখনই জমে যাব। আলাদা আলাদা বেড থাকলেও একটা ডাবল বেডের মধ্যেই তিন জন এক সঙ্গে শোয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সঙ্গে গায়ে চাপানো হয় কম করে ৪-৫টি কম্বল, লেপ। আর সকলের গায়ে তো গরম জামা থেকে মোজা, চাদর কী নেই। কিন্তু কোনও ভাবেই ঠান্ডাকে বাগে আনতে পারছিলাম না কেউই। এখানে বলে রাখা ভাল সারারাত ঠান্ডায় কেউ ঘুমোতে পারিনি। তার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ায় সারা ক্ষণই সেই কাঠের ঘর কাঁপছে। মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছিল হাওয়ার একটা দাপট আসবে আর পুরো ঘরটা উড়ে গিয়ে পড়বে খাদে। কারণ যেখানে ঘরের দেওয়াল শেষ হচ্ছে সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে খাদ। সেটা যদিও পর দিন সকালে আবিষ্কার করেছিলাম। ভাগ্যিস আগের রাতে করিনি।
সারারাত জেগে সে দিন ভোর হতে দেখেছিলাম। তত ক্ষণে সকলেরই শরীর খারাপ লাগতে শুরু করেছে। এক তো ঠান্ডা, তার সঙ্গে উচ্চতাজনিত কারণে শ্বাসকষ্ট। অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছিল বুঝতে পেরে ওই হোম স্টের মালিকই গরম গরম চা এনে দিলেন। সঙ্গে সরিয়ে দিলেন জানলার পর্দা। আমাদের তখনও লেপের তলা থেকে বাইরে পা রাখার অবস্থা নেই। কিন্তু তিনি যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘‘আজ রোদ উঠেছে, বাইরে আসুন ভাল লাগবে।’’ জানলার পর্দা সরতেই শরীর অর্ধেক ঠিক হয়ে গেল। এক ফালি জানলার বাইরে উঁকি দিচ্ছে বিশাল তুষার শৃঙ্গ। ছুটে বাইরে চলে যাওয়ার কথা ভেবেই বিছানা থেকে নীচে পা রাখলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম তখনও অক্সিজেনের অভাবে শরীরে ভারসাম্যটা ঠিক নেই। কোনও রকমে বাইরে বেরিয়েই একটা পাথরের উপর বসে পড়লাম। রোদ রয়েছে, চোখের সামনে পাহাড়ের গা দিয়ে চলে গিয়েছে জিকজ্যাক রোড আর তা পেরিয়েই মাথা তুলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একের পর এক তুষার শৃঙ্গ।
ওই পাথরে বসেই ব্রেক ফাস্ট করলাম। গ্রুপের এক জন উঁচু এক পাথরে উঠে জানাল ওখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক রয়েছে। এখানে বলে রাখা ভাল, সেই সময় ওই পথে মোবাইলের নেটওয়ার্ক প্রায় কোথাও পাওয়া যেত না। এ রকমই কোনও পাথরে বা রাস্তার কোনও বাঁকে হঠাৎ করে জ্বলে উঠত নেটওয়ার্ক। সেই পাথরে উঠে সকলেই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করল। কষ্ট হল ঠিকই কিন্তু ভার্জিন এই জনপদের ভয়ঙ্কর রাতের শেষে অসাধারণ এই সকাল থেকে গেল সবার মনে। এ দিন গন্তব্য নাথান ভ্যালি। গাড়ি একটা মোড় ঘুরতেই বাড়তে থাকল বরফ। রাস্তায়, পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বরফ দেখতে দেখতে পৌঁছলাম বরফঢাকা নাথান ভ্যালিতে।
ছবি: লেখক
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)