সুচরিতা সেন চৌধুরী: রাতে এই প্রার্থণা করেই সবাই শুতে গেল, আর যেন এখন বৃষ্টি না নামে। হোটেলের ছেলেটি আশ্বাস দিয়ে গেল, কাল রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে লেপের তলা থেকেই জানলায় চোখ গেল। বেশ ঝাঁ চকচকে লাগছে। ঝটপট উঠে পড়লাম। রেডি হতে হতেই চলে এল চা। সুখবর পাওয়া গেল তখনই। গাড়িও চলে এসেছে সময় মতো। তাই আর দেড়ি নয়। যাঁরা নিয়মিত পাহাড় যান তাঁরা জানেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের আবহাওয়া এমনিতেই খারাপ হয় আর এখন তো ঘোরতর বর্ষাকাল। কিছুক্ষণ পরেই যে আবহাওয়া খারাপ হবে তা স্বাভাবিক। হালকা রোদ উঠেছে। তবে এদিক ওদিকে মেঘের দলও ঘোরাঘুরি করছে। যে কোনও সময় সূর্যের তেজ ঢেকে দিতে তারা সিদ্ধহস্ত। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে পড়লাম। প্রবল ঠান্ডা। গাড়ির ভিতর ঢুকে স্বস্তি হল কিছুটা। মানালি শহরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম নতুনের খোঁজে (Rohtang Pass)।
মানালি মানেই যে ১৩ হাজার ফিট উচ্চতায় অবস্থিত রোটাংপাস আর সেখানকার বরফে হুটোপাটি সে ছবি সবার চেনা। আমাদেরও তেমনই ইচ্ছে। মানালি থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরের রোটাংপাস নিয়ে নানা রোমাঞ্চ ইতিমধ্যেই মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। হিস্টোরি চ্যানেলে পরবর্তী সময়ে ডেডলিয়েস্ট রোড অনুষ্ঠানে এই রাস্তা দেখিয়েছিল। কেন এই রাস্তা ডেডলিয়েস্ট তা সেদিনই টের পেয়েছিলাম। তুলনায় শিমলা থেকে মানালির রাতকে মনে করিয়েছিল এই পথ। তবে এ ছিল আরও ভয়ঙ্কর। সে কথায় ক্রমশ আসব। তার আগে অসাধারণ সুন্দর এই পথের কথা না বললেই নয়। মানালি থেকে বেশ খানিকটা পথ বেশ ভাল। বিভিন্ন জায়গায় ল্যান্ডস্লাইডের মতো ঘটনা ঘটলেও খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। তবে গাড়ির চালক জানালেন, সামনের রাস্তা খুব খারাপ। মনে মনে ভাবলাম, যে রাস্তার পেরিয়ে এসেছি তার পর আর ভয়ের কিছু নেই।
আচ্ছা এখানে বলে রাখি রোটাংপাস যেতে হলে পারমিট লাগে যা আমাদের গাড়ির চালক করে নিয়েছিলেন। যত এগোচ্ছি একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। কিন্তু ভাললাগা ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। গাড়িতে মৃদু শব্দে বাজছে গুলজার। চোখ আটকে দূরের পাহাড়ে। মাঝে মাঝেই হুড়মুড়িয়ে নেমে আসছে ঝর্ণা। বৃষ্টির জন্য তৈরি হয়েছে এমন নতুন নতুন ঝর্ণা। কখনও পেরিয়ে যেতে হচ্ছে সেই ঝোড়া। রাস্তার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে তার স্রোত। ও বলতে ভুলে গিয়েছে, খারাপ রাস্তা শুরু হয়ে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। না ভুল বললাম, রাস্তা বলে এখানে কিছু নেই। শুধু পাথর, মাটি, কাঁদা। সরু রাস্তার একদিকে আকাশচুম্বি পাহাড় আর অন্য প্রান্তে অতলান্ত খাদ। গাড়ির মন্থর গতিতেও কখনও ডান তো কখনও বাঁদিকে ধাক্কা খেতে খেতে আমরা চলেছি। সর্বত্র চোখে পড়ছে ল্যান্ডস্লাইডের ক্ষতচিহ্ন। এক ইঞ্চির ভুল আর সোজা খাদে।
এই ভাবতে ভাবতেই ঝুপুৎ করে রাস্তার গর্তে পড়ে গেল গাড়ির একটি চাকা। কোনওভাবে চালক তা তুলতে পারলেন না। মাঝ রাস্তায় গাড়ির মধ্যে আটকে রয়েছি। দু’দিকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফেরার পথ ধরা একটি গাড়ি জানাল তারা রোটাংপাস পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত যাব ঠিক করলাম। তা শুনে চালকের মুখ পুরো ছোট হয়ে গিয়েছে। তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম, চিন্তা নেই, আমরা ঝুঁকি নেব না। কিন্তু গাড়ি তো আটকে। শেষ পর্যন্ত আমাদের গাড়ির ছেলেরা আর অন্য গাড়ির ছেলেরা নামল আমাদের গাড়ি ঠেলতে। তাঁদের ধাক্কায় গাড়ির চাকা ঘুরল আবার। ততক্ষণে বৃষ্টি নেমেছে। আবার চলার শুরু। ও এখানে বলে রাখি, পথে মারিতে গরম পোষাক ভাড়া করার জন্য দাঁড়িয়েও আমরা নিইনি। যত উপরে উঠছি তত বুঝতে পারছি কেন ওই পোষাক ভাড়া করতে হত। শুধু গার্ডিগান, চাদর আর স্নিকারে যে এ ঠান্ডা রোখার নয় বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দূর উঠে এসেছি। এখানের পাহাড় কিছুটা রুক্ষ। লাদাখের প্রভাব রয়েছে অনেকটাই।
যত এগোচ্ছি তত বাড়ছে বৃষ্টির তেজ সঙ্গে ঠান্ডা। আর রাস্তার ব্যাখ্যা নাই বা দিলাম। সে এক ভয়ঙ্কর রাস্তা। কোথাও কোথাও গাড়ির একটি চাকা চলে যাচ্ছে রাস্তার বাইরে। কোনও কোনও বাঁকে হাওয়ার ঘুরছে চাকা। এখন ভাবলে আতঙ্ক হচ্ছে কিন্তু তখন নতুন জায়গা দেখার উত্তেজনায় ভয় লাগেনি। তবে একটা সময়ের পর গাড়ির চালক রীতিমতো বেঁকে বসলেন, আর যাবে না বলে। হাতে পায়ে ধরার অবস্থা। তা শুনে আমরাও থমকালাম খানিকটা। চালকের আর্জি পুরো কোড আনকোড আজও মনে আছে, ‘‘ম্যাডামজি মেরে ঘরমে বিবি বাচ্চে হ্যায়, মুঝে জিন্দা লটনা হ্যায় (আমার বাড়িতে বৌ-বাচ্চা রয়েছে, আমাকে বেঁচে ফিরতে হবে)।’’ সামনে ততক্ষণে দেখা যাচ্ছে সেনার গাড়ি, সেনাবাহিনীর লোকজন। বুঝতে পারলাম, এ যাত্রায় আর রোটাং পর্যন্ত পৌঁছনো হল না। চালককে বললাম, সেনার গাড়ি পর্যন্ত আমাদের নিয়ে যেতে, তাঁরা যদি বলেন ফিরে যেতে তাহলে তো ফিরতেই হবে।
একরাশ মন খারাপ নিয়ে এগোলাম। সামনে যেতেই আমাদের গাড়ি আটকে দিল সেনা। জানালেন, সামনের রাস্তা খুব ঝুঁকিপূর্ণ আর যাওয়া যাবে না। অনুরোধ করেও কাজ হল না। একে একে ফিরছে সব গাড়ি। জানতে চাইলাম এখান থেকে আর কতদূর রোটাং? বললেন খুব বেশি হলে ৫ কিলোমিটার। গাড়ি রেখে হেঁটে যেতে চাইলাম, সেই অনুমতিও মিলল না। হতাশ হয়ে ওখানেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। বৃষ্টির তেজ বেড়েছে। পাশেই চোখে পড়ল একটা ঝুপড়ি দোকান। দোকানের ছাদের উপর দিয়ে চোখ যেতেই থমকে গেলাম।
শব্দটা অনেকক্ষণ ধরেই কানে আসছিল কিন্তু বিভিন্ন তালেগোলে খেয়াল করিনি। প্রবল বেগে উপর থেকে নেমে আসছে জলরাশি। তার গা ঘেষেই তৈরি হয়েছে এই ঝুপড়ি চায়ের দোকান। ওখানেই ঢুকে পড়লাম। ব্রেকফাস্টও হয়নি। ম্যাগি, অমলট আর চায়ের অর্ডার দিয়ে ওখানেই বসতে হল। কারণ প্রবল বৃষ্টি চলছে। সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা। একটা সোয়েটারে মানছে না। বেশ কয়েক কাপ চা শেষ করেও কিছু হচ্ছে না। তবে, এটা ঠিক রোটাং না পৌঁছতে পারলেও ওই পথের যা সৌন্দর্য্য আর ভয়ঙ্কর রূপের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন দেখেছি তাতে সে যাত্রায় মানালি ভ্রমণ স্বার্থক। উত্তাল ঝর্ণার পাশে বসে ব্রেকফাস্ট আর চা-এর স্মৃতি আজও রোমাঞ্চ তৈরি করে।
সেনার জওয়ানরা আমাদের মন খারাপ দেখে বললেন, কয়েক পা হাঁটলে রোটাংয়ের বরফ দূর থেকে দেখা যাবে। বৃষ্টি মাথায় করেই এগোলাম। সঙ্গে একজন সেনার জওয়ান। একটা জায়গা পর্যন্ত গিয়ে তিনিই আমাদের থামালেন। বললেন, আর যাওয়া যাবে না। আঙুল দিয়ে দেখালেন, ওই বাকটা ঘুরলেই রোটাংপাস শুরু। বরফের দেওয়াল না থাকলেও বরফ জমে রয়েছে। রোদ ওঠায় তা কিছুটা গলেছে কিন্তু এখন আবার তা জমছে। সেনা জওয়ান বললেন, ‘‘এবার ফিরে যান। আবহাওয়া আরও খারাপ হবে তার আগে মানালি পৌঁছে যেতে পারলে ভাল।’’ যে ওয়াটার ফল রোটাংপাসে না যেতে পারার দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিল তাকে আবার একবার মন ভরে দেখে নিলাম। বৃষ্টির মধ্যেই মানালি ফেরার পথ ধরলাম। অদ্যই শেষ রজনী ছবির মতো সুন্দর এই পাহাড়ি পথে। কাল কুলু।
ছবি—লেখক ও সংগৃহিত
(ষষ্ঠ পর্ব)
Manali Morning: কাঁচের দেওয়াল আর দূরের তুষারশৃঙ্গ, পঞ্চম পর্ব
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google