Sandakphu Trekking 1: স্মৃতির পাতা থেকে, মানেভঞ্জন টু টুমলিং

Sandakphu Trekking 1

কতটা পথ পেড়লে তবে পথিক বলা যায়? এই প্রশ্নটা সারাক্ষণই ঘোরে মনে, মাথায়। আদৌ কি আমি পথিক? নাকি শুধুই সুখি ভ্রমণার্থী (Sandakphu Trekking 1)। তবে যাই হই না কেন সব চিন্তাকে পিছনে ফেলে প্রকৃতির টানে বেরিয়ে পড়তে কার না ভাল লাগে। যেন সেই স্বপ্নই বুনতে থাকে মানুষ দিনের পর দিন। তার পর একদিন হঠাৎ করে সুযোগটা চলে আসে। আসলে মন থেকে চাইলে একদিন স্বপ্নটা সত্যি হয়। গত দু’বছর গৃহবন্দি থাকা মানুষ আবার নতুন করে ডানা মেলতে শুরু করেছে। ঘর ছেড়ে কেউ পরিবার, কেউ বন্ধু আবার কেউ একাই বেরিয়ে পড়েছে চেনা গণ্ডির বাইরে। তার আগে একটু স্মৃতির পাতা উল্টে দেখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম ট্রেকিং। বাঙালির প্রথম ট্রেকিং মানেই সান্দাকফু-ফালুট। তবে সে বার আমাদের ফালুট যাওয়া হয়নি। এখনও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কেটে গিয়েছে ২০ বছর। সালটা ২০০২। কলেজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। তখন কেউ কম্পিউটার শিখছে তো কেউ চাকরির পরীক্ষায় ব্যস্ত। তার মধ্যেই হুজুগ উঠলো। একটা ট্রেকিং করলে কেমন হয়? কম বয়স, উদ্দম তুঙ্গে। সবাই হইহই করে রাজি হয়ে গেল। ১০ জনের দলে মেয়ে বলতে আমি আর আমার বোন। বাকি ৭ জন আমার বন্ধু আর এক জন বোনের বন্ধু। দার্জিলিং মেলে চেপে নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়াটা নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু তার পরই শুরু হল আমাদের নতুন অ্যাডভেঞ্চার। সেদিনই পৌঁছেছিলাম মানেভঞ্জন। এই সেই জায়গা যেখান থেকে শুরু হয় সান্দাকফু ট্রেকিং। পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। পরদিন ভোর ৪টেয় বেড়তে হবে। তেমনই বার্তা দিয়েছিলেন আমাদের গাইড। সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। আমরা সব অ্যামেচার ট্রেকার, তাদের জন্য যতটুকু দেওয়া যায়।

মানেভঞ্জনের দুপুরটা কোথা দিয়ে কেটে গেল টেরই পাওয়া গেল না। বিকেলে একটু  গ্রামের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি সেরে ঢুকে পড়লাম আস্তানায়। সেখানেই তিনটে ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। ঠান্ডাও মন্দ নয় অক্টোবরের শেষে। পরদিন ঠিক ভোর সাড়ে তিনটেয় অ্যালার্ম ঘড়ির মতো বেডে উঠলেন আমাদের গাইড। সবার ঘরে নক সঙ্গে গরম গরম চা। ‘‘উঠে পড়ুন, আর আধঘণ্টার মধ্যে বেরতে হবে।’’ সকালের ঘুম বড় প্রিয় কিন্তু তখন ট্রেকিংয়ের হাতছানি। যা ঘুমপ্রেমকে ছাঁপিয়ে গেল নিশ্চিন্তে। ঘড়ি দেখে শুরু হল প্রথম ট্রেকিং। মানেভঞ্জনের শুরুর রাস্তা স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে যাওয়া যায়। মাঝে মাঝে যে হাফ ধরে না তা নয়। তখন দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম। বসার অনুমতি নেই। বসলেই মাসল ক্র্যাম্পের সম্ভাবনা থাকে। হাঁটার সময় কান খোলা রাখতে হবে।

Sandakphu Trekking 1

হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া যখন কানে এসে সপাটে লাগে তখন হাত দিয়ে কানটা কিছুক্ষণ বন্ধ রাখা ছাড়া উপায় নেই। তবে হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ পড়েই ঘাম হতে শুরু করবে সে ঠান্ডা যতই হোক না কেন। মানেভঞ্জন থেকে পারমিট করে হাঁটা শুরু যখন করেছিলাম তখন অন্ধকার ছিল। টর্চ জ্বালিয়েই পথ চলা শুরু। ট্রেকিংয়ে হাই পাওয়ারের টর্চ মাস্ট। দিনের আলো ফুটতেই প্রকৃতিও ক্রমশ চোখের সামনে খুলে গেল। পাহাড়ের গা দিয়ে পাথুরে রাস্তা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখি। মাঝে মাঝে কান ঝালাপালা করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে ল্যান্ডরোভার। ওই পথে তখন জিনিসপত্র আনা নেওয়ার জন্য এই গাড়িই ব্যবহার হত। এখন শুনেছি রাস্তা হয়েছে। অন্য গাড়িও চলে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজও বেড়েছে। যেই মেঘের আড়াল সরিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে তখনই গরম লাগছে। আবার মেঘ ঘিরে ধরলে প্রবল ঠান্ডা। সেকেন্ডে সেকেন্ডে বদলে যাচ্ছে ঠান্ডা গরমের অনুভূতি। ততক্ষণে অবশ্য চড়াই ক্রমশ কঠিন হয়েছে। মেঘমা পৌঁছনোর কয়েক কিলোমিটার আগে থেকে রাস্তা ভয়ঙ্কর চড়াই।

প্রথম ট্রেকিং, প্রথম মনে হওয়া আর পারব না। হয়তো এখান থেকেই ফিরে যেতে হবে। প্রথম গন্তব্য ছিল টুমলিং। টংলু আর টুমলিং পাশাপাশি। তবে টংলু পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পড়ে আর টুমলিং নেপালে। এই পুরো রাস্তাটাতেই নেপাল-ভারত গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছে। কখনও ঢুকে পড়তে হবে নেপালে আবার কখনও বাংলায়। সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে দিয়ে রাস্তাটার অনেকটাই হাঁটতে হয় নেপালের মধ্যে দিয়ে। যে কারণে সেখানে আর এক প্রস্থ পারমিট করাতে হয়। সে কথায় পড়ে আসছি। যখন মনে হচ্ছে চিত্রে পর্যন্ত আর পৌঁছতে পারব না তখন আমাদের গাইড আশ্বস্ত করে বললেন, ‘‘একটু বিশ্রাম নিন আবার হাঁটতে পারবেন। না পারলে মেঘমাতেই থেকে যাবেন।’’ কিন্তু আমাদের বুকিং রয়েছে টুমলিংয়ে। পরদিন সেখান থেকেই হাঁটার শুরু কালিপোখড়ির উদ্দেশে। তাই দম নিয়ে, সঙ্গে চকোলেটের এনার্জি নিয়ে আবার হাঁটার শুরু।

Sandakphu Trekking 1

মানেভঞ্জন থেকেই শুরু হয় ট্রেকিং

তবে সব ক্লান্তি মুহূর্তে ভ্যানিশ হয়ে গেল চিত্রের ভয়ঙ্কর চড়াই পেরিয়ে মেঘমা পৌঁছতেই। বুঝতে পারলাম জায়গাটার নাম কেন মেঘমা। মেঘ আমার বড্ড প্রিয়। মেঘমা পৌঁছে মনে হল সব মেঘ যেন এখানে জন্ম নেয়। এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। চারদিক মেঘ সাদা চাদরে ঢেকে রয়েছে। কখনও কখনও ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদেরকেও। দু’হাত দূরে থাকা মানুষকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। এই মেঘ রাজ্য ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কী করা যাবে আর যেতেই হল। মেঘমা থেকে টুমলিং পৌঁছতে খুব বেশি দেড়ি হল না। যা দেড়ি হওয়ার হয়ে গিয়েছে মেঘমা পৌঁছতেই। নীলাদি আমাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন। লাঞ্চও রেডি। পেটেও সবার ছুঁচো ডন দিচ্ছে। অপূর্ব স্বাদের খাবার খেয়ে বাড়ির লনটায় বেড়িয়ে এলাম। মেঘমা থেকে আমাদের পিছু পিছু মেঘের দল এসে পৌঁছেছে সেখানেও। ঠান্ডাটা জাঁকিয়ে বসেছে। আমরা সকলেই যেখানে যেখানেই রোদ দেখছি সেখানে গিয়েই দাঁড়াচ্ছি। তবুও অন্ধকর নামাপর্যন্ত টুমলিংয়ের রাস্তায় হেঁটেই বেড়ালাম। আমাদের কয়েকজন টংলু ঘুরে এলো হেঁটে।

অন্ধকার নামতে গোটা এলাকা নিঝুম হয়ে গেল। বাইরে কিছুই দেখার নেই। ত্রিসীমানার আর কিছু নেই। লোক-জন-বাড়ি, না কিচ্ছু নেই। তাই ঢুকে পড়তেই হল ঘরে। ও এখানে বলে রাখা ভাল এই পথে তখন কোনও ফোন ছিল না। মোবাইল ফোন তো তখন ছিলই না। সান্দাকফুতে একটা ফোন পাওয়া গিয়েছিল। জনে জনে সেখান থেকেই বাড়িতে ফোন করে কুশল সংবাদ দিয়েছিলাম। তার পর ফোন পেয়েছিলাম রিম্বিকে ফেরার পথে। ট্রেকিংয়ের প্রথম দিনের ক্লান্তি ঘরে ঢুকেই টের পেলাম। তাই দ্রুত ডিনার করে ঘুম। সকাল সকাল বেরতে হবে। মাঝ পথে পারমিট করাতে হবে আবার। এখানে বলে রাখা দরকার, নীলাদির হাতের রান্না অসাধারণ। ৯৬০০ ফিট উচ্চতায় বসে কনকনে ঠান্ডায় শিখর লজের সাধারণ ঘরও অসাধারণ লাগবে। পরদিন সকাল হল নীলাদির ডাকে।

(দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল)

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)