Train Station 4: ভাললাগা, ভালবাসায় মোড়া এক পাহাড়ি স্টেশন

Alone In Shimlaশিমলা স্টেশন

সুচরিতা সেন চৌধুরী: যাঁর কালকা স্টেশন পছন্দ তাঁর যে শিমলা স্টেশন মনে ধরবে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই কালকা স্টেশন নিয়ে লেখার পর দিনটা শিমলার জন্যই রাখাটা শ্রেয়। এই শিমলা স্টেশন একাধিকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সবাই শুনলে অবাক হতে পারেন, আমার শিমলা খুব পছন্দের জায়গা নয়। তবুও আমি বার বার সেখানে যেতে চাই শুধুমাত্র এই দুটো স্টেশনকে ছুঁয়ে দেখার জন্য। এখনও পর্যন্ত এই স্টেশনে দু’বার ট্রেন থেকে নেমেছি আর একবার এখান থেকে ট্রেন ধরে ফেরার পথ ধরেছি। আজ সেই স্বপ্নের মতো শিমলা স্টেশনের ভাললাগার কথা বলব।

পাহাড়ের মাঝখানে ছোট্ট স্যাঁত স্যাঁতে একটা স্টেশন। না সব সময় এমনটা থাকে না। আমি বার বার এমনটাই পেয়েছি কারণ সব বারই আমার পছন্দের সময় ছিল বর্ষা। বৃষ্টির মধ্যে ট্রেন থেকে নেমেছি আবার বৃষ্টির মধ্যেই ট্রেনে উঠেছি। এমনও দিন কেটেছে যখন সারাদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছে আর আমি শিমলার হোটেলের ঘরে বসে জানলায় চোখ রেখেই মেঘ-বৃষ্টির খেলা দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিয়েছি।

যাক সে সব কথা অন্য কখনও বলব। আজ বলি শিমলা স্টেশনের কথা। কালকা স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও মুগ্ধতা থেকে বেরতে পারিনি। আমার কাছে সব সময়ই ‘জার্নি ইস বেটার দ্যান ডেস্টিনেশন’। ওই চলতে থাকাটা আমি অনেক বেশি উপভোগ করি। কালকা থেকে শিমলা যাওয়ার ট্রেনের সেই দীর্ঘ সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ্য। আর তার পর যখন ডেস্টিনেশন হয় স্বপ্নের মতো স্টেশন তখন সবটাই ভাল লাগে। ঘোর লেগে থাকে রাস্তার। শীতে যখন তুষারপাত হয় তখন সাদা বরফের চাদরে ঢেকে যায় পুরো স্টেশন চত্তর। কালকা থেকে শিমলার রাস্তাও ঢাকা থাকে বরফে। তবে এখনও সেই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি।

শিমলা স্টেশন ঢোকার মুখেই একটা ছোট্ট টানেল রয়েছে। মোট ১০৩টি টানেল পেড়িয়ে পৌঁছতে হয় শিমলায়। শেষ টানেলটা শেষ হতেই চোখের সামনে খুলে যায় অসাধারণ শিমলার সৌন্দর্য্য। যদিও পুরো রাস্তাটাই সৌন্দর্য্যের ভাণ্ডার। তাহলে শিমলা স্টেশন স্বর্গ। খুব ধির গতিতে যখন ট্রেন প্ল্যাটফর্মের গা ঘেষে ক্রমশ নিজের লম্বা শরীরটাকে ভিড়িয়ে দেবে তখন অপর প্রান্তে পাহাড়ের গা দিয়ে ভাসতে ভাসতে মেঘের দল ঢুকে পড়বে ট্রেনের জানলা দিয়ে। সেই মেঘের আলিঙ্গন গায়ে মেখেই নেমে পড়তে হবে ট্রেন থেকে। মেঘের সঙ্গে প্রেমের আদান-প্রদান তো আগামী ক’দিন চলবেই তাই তাদের একটু ইগনোর করাই যায়।

প্ল্যাটফর্ম দেখলে মনে হবে এখনই কেউ জল ঢেলে ধুয়ে দিয়ে গিয়েছে। টিকিট কাউন্টারের পাশে খুব কম ছোট দুটো স্টল রয়েছে। ইতি-উতি যাত্রীরা ফেরার ট্রেনের অপেক্ষায়। এই ট্রেনই ফিরবে কালকা। মেঘের দল কিন্তু ট্রেনের বাধা পেড়িয়ে স্টেশন চত্তরেও সুযোগ পেলেই দাপট দেখাবে। স্টেশন থেকে বাইরে গেলেই অবশ্য এই রোমান্টিক অনুভূতি জোড় ধাক্কা খাবে। ভিড়, গাড়িওয়ালাদের হাঁক ডাক, যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতা, দর কষাকষি, আরও একগুচ্ছ শহুরে হুল্লোরের মধ্যে গিয়ে পড়তে হবে। তাতে অবশ্য স্টেশনের ভাললাগাটা নষ্ট হয় না।

প্রথম যে বার এই স্টেশনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সেদিন বিস্ময় ছিল, এই ভেবে যে একটা রেল স্টেশন ঘিরে এত ভাললাগা তৈরি হতে পারে? কিন্তু ক্রমশ বুঝেছি রেল স্টেশন নিয়ে আমার একটা অদ্ভুত রোমান্টিসিজম কাজ করে। আমি রেল স্টেশনের প্রতিটি কোণায় আলাদা আলাদা গল্প খুঁজে পাই। কোথাও মিলন, কোথাও বিচ্ছেদ, কোথাও উচ্ছ্বাস আবার কোথাও হতাশার সে গল্প। কিন্তু চলা থামে না। চলাই জীবন বার বার শিখিয়ে যায় রেল স্টেশনগুলো। পাহাড়ের বুক চিরে যে রেল লাইনগুলো গন্তব্যে পৌঁছয় তারও আলাদা গল্প থাকে।

এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে একলাফে নেমে লাইন পেড়িয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় রেলিংয়ের ধারে। শিমলার পুরো শহরটাই রেলিং দিয়ে ঘেরা। স্টেশনের পাশটাও তাই। সেখান থেকে বিশাল পাহাড়, পাহাড়ের গা দিয়ে ছোট ছোট ঘর, মেঘেদের ওড়াউড়ি—সব দেখা যায়। শেষ বেলায় এই স্বর্গ সুখ কে ছাড়ে? অনেকেই দেখলাম ক্যামেরা হাতে ওই প্রান্তেই ঘোরাঘুরি করতে ব্যস্ত। ট্রেন এল কিনা তা নিয়ে কোনও মাথা ব্যথা নেই। না যেতে চাইলেও অসুবিধে নেই, প্ল্যাটফর্মে বসেও সে দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ও, এখানে বলে রাখি এই ট্রেনটির বিশেষত্ব এর সিট। আপনি কোন দিকে মুখ করে বসবেন সেটা আপনি নিজেই সেট করে নিতে পারবেন। অনেকেরই পছন্দ যে দিকে গাড়ি যাচ্ছে সেদিকে মুখ করে বসা। অনেকের উল্টোদিকে বসলে শরীর খারাপও হয় বিশেষ করে পাহাড়ি রাস্তায়। তাই সেই সমস্যা নেই এই ট্রেনে। স্টেশনের ভাললাগার সঙ্গে সঙ্গে তাই জার্নিটাও জমে যায়।

১১ বছর পর যখন শিমলা স্টেশনে নামলাম তখন রোদ ঝলমল করছে। সেই রোদের ফাঁক গলেই কোথা দিয়ে হাজির হল এক দল মেঘ। বুঝলাম, এটাই বৈশিষ্ট্য এই অপূর্ব সুন্দর স্টেশনের। প্রথম বার মনে আছে, ম্যাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিলাম। তার পর ফেরার সময় তো হাল বেহাল। তখন জানতাম না এখানে লিফটে করে সোজা উঠে পড়া যায় ম্যাল রোডে। পরের বার অবশ্য লিফটই ব্যবহার করেছিলাম। তিন দিন শিমলায় ছিলাম। ঘোরার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে গিয়েছে বার বার স্টেশনের সেই মেঘ-রোদের খেলা। সেবার যদিও ফেরাটাও ছিল একই পথে। তাই মনে মনে একটা ভাললাগা কাজ করছিলই।

Train Station 1: একবার হঠাৎ ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়ল ঝাঝায়

তিন দিন শিমলায় কাটিয়ে ফেরার পথ ধরতেই হল। আবার সেই একই পথে পৌঁছলাম স্টেশনে। একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। বিকেলের ট্রেন। তবে একটুও বিরক্ত লাগেনি। ভিড় নেই। অল্প কিছু পর্যটক আমাদের মতই ট্রেনের অপেক্ষায়। তাঁরাও মেঘ-বৃষ্টির খেলা দেখতে ব্যস্ত। তার মাঝেই মেশিন দিয়ে পরিষ্কার করে গেল স্টেশন। এক প্যাকেট চিপস কিনে স্টেশনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত বার কয়েক চক্কর দিলাম। তার মধ্যেই শুনতে পেলাম ট্রেনের সেই চেনা শব্দ। এবার বিদায়ের পালা। তবে এই পথে ঝুপুৎ করে পাহাড় থেকে নেমে পড়ার কোনও সুযোগ নেই। বরং পুরো রাস্তাটাই পাড়ারের সঙ্গে কথা কথা বলতে বলতে যাওয়া।

Train Station 2: নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশনে ছোটবেলার স্মৃতি

রাত হল ট্রেনেই। রাতের অন্ধকারে ছোট পাহাড়ি ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ট্রেনেই রাতের খাবার এল, ভাত, রুটি, ডাল, সবজি, চিকেন। মাঝে একবার চা, স্ন্যাক্সও জুটেছে। সঙ্গে অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভা। একবার বৃষ্টি এল। কিছুক্ষণের জন্য জানলা বন্ধ করতে হল। এই রুটের ভৌতিক স্টেশন বারোগে কিছুক্ষণের বিরতির পর বেশ রাতে কালকা পৌঁছে দিল ছোট্ট সেই ট্রেন। এক ভালবাসার স্টেশন থেকে আর এক ভাললাগার স্টেশনের মধ্যের রাস্তাটাও স্মৃতির ফ্রেমে ধরা থাকল।

Train Station 3: ‘ম্যাজিক্যাল বিউটি’ আর আমার অনুভূতি

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle