বোলপুর (Train station 15 শান্তিনিকেতন) স্টেশনের সঙ্গে প্রথম দেখা ঝটিকা এক সফরে। স্নাতক হওয়ার পর বোনের ইচ্ছে ছিল স্নাতকোত্তরে বিশ্বভারতীতে পড়বে। সেই লক্ষ্যে ফর্ম তুলতে বোলপুর। সকালে গিয়ে রাতে ফেরা। সেই সময় এই স্টেশনকে সে ভাবে অনুভব করা হয়নি। বলা ভাল, রবি ঠাকুরের রেল স্টেশন মনে দাগ কাটার সুযোগ পায়নি। সময়ের বিস্তারে সেই বোলপুরই যে এ ভাবে ভালবাসায় বেঁধে ফেলবে, তা কে জানত! বোলপুর আর শান্তিনিকেতন একে অপরের পরিপূরক যেন। বীরভূমের লালমাটির টান আর রবীন্দ্রনাথ— আবেগটাকে কোথায় যেন এক সুতোয় বেঁধে দেয়। ট্রেন বোলপুর ঢোকার বেশ খানিকটা আগে থেকেই প্রকৃতিবদল টের পাওয়া যায়। আর সে বদল স্পষ্ট হয় মাটির রঙে।
সে বার হাওড়া থেকে সকালের শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ধরে পৌঁছেছিলাম বোলপুরে। বন্ধুদের একটা বড় গ্রুপ। তো বাকিদের স্টেশন নিয়ে কোনও আদিখ্যেতা ছিল না। কেউ কেউ আমার এই স্টেশন-প্রেমকে আদিখ্যেতাই বলেন। তাতে অবশ্য আমার বয়েই গিয়েছে। ট্রেন আর স্টেশন আমার কাছে আবেগ। যাক সে সব কথা। ওই যে বললাম, বোলপুর ঢোকার বেশ খানিকটা আগে থেকেই মাটির রং বদলাতে শুরু করে। সঙ্গে প্রকৃতির গন্ধও। সেই প্রথম বীরভূমের লাল মাটির রুক্ষতায়ও আমি ডুব দিয়েছিলাম। বোলপুর স্টেশন ঢুকতে ঢুকতে বুঝে গিয়েছিলাম এ প্রেম আটকায় আর কার সাধ্যি। তার পর থেকে যে কত বার শান্তিনিকেতন গিয়েছি তার হিসেব নেই।
কখনও দুপুরের কড়া রোদে। কখনও আবার সূর্যোদয়ের সঙ্গেই। গোধূলিতে কখনও। কখনও মধ্যরাতে। হয় বোলপুর থেকে ট্রেন ধরেছি। অথবা এই স্টেশনে নেমেছি। মধ্যরাতে বোলপুরের সুনসান প্ল্যাটফর্মে হেঁটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ভ্রমণার্থীদের সাধারণত হওয়ার কথা নয়। আমার স্টেশন-প্রেম এতটাই গভীর যে, মধ্যরাতে গল্প করতে করতে বোলপুরের প্ল্যাটফর্মে হেঁটে বেড়ানোটাও সে দিন দারুণ উপভোগ করেছিলাম। সে বার ফেরার ট্রেন ছিল কাকভোরে। হোটেল থেকে বেরিয়ে রিকশা-টোটো-অটো পেয়ে সেই ট্রেন ধরাটা যে বেজায় কঠিন হবে তা বুঝতেই পেরেছিলাম। সেই সমস্যা মেটাতেই মাথায় বুদ্ধিটা খেলে গেল!
স্টেশনের রিটায়ারিং রুমে থাকার অভিজ্ঞতা আমার অনেক পুরনো। বিভিন্ন স্টেশনের রিটায়ারিং রুমে থেকেছি। তবে সেটা দূরের কোনও জায়গায়। ঘরের কাছে কখনও ভাবাই হয়নি! এ বার সকালে ট্রেন ধরার লক্ষ্যে প্ল্যানটা করেই ফেললাম। সন্দিহান ছিলাম, আমার সঙ্গের মানুষটির এটা পছন্দ হলে হয়! হল উল্টোটাই। তাঁরও এতটা পছন্দ হল যে, পরের বার গিয়েও হোটেলে না-থেকে রিটায়ারিং রুমই বেছে নিয়েছিলাম। বোলপুর স্টেশনের প্রতি ভালবাসা যেন এই থাকাটা এক ধাক্কায় অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
শিয়ালদহ থেকে সে বার সকালের কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরে সকাল ৮টার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম বোলপুরে। সময়টা ডিসেম্বরের একেবারে অন্তিম লগ্ন। বছরের শেষ আর নতুন বছরের শুরু— এই দু’দিন কাটাতে চেয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে। তত ক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছে পৌষমেলাও। ভিড়ভাট্টা প্রায় নেই বললেই চলে। এই সব ভেবেই বছরের শেষ আর শুরুটা একটু অন্য রকম ভাবে কাটানোর ইচ্ছেয় পৌঁছে গেলাম শান্তিনিকেতন। বোলপুর স্টেশনের রেলের দফতরে রিটয়ারিং রুম বুকিংয়ের সব কিছু জমা দিয়ে পৌঁছলাম আমাদের আগামী দু’দিনের আস্তানায়। রুম নম্বর ‘এক’। বিশাল ঘর। ততোধিক বড় চানঘর। তবে ডিসেম্বরের শীতে গরম জলের অভাবটা সমস্যায় ফেলেছিল।
ভোর ৬টায় শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরেছিলাম। তাই না হয়েছে ঘুম, না কিছু খাওয়া। দুটোই তখন চেপে বসেছে।
দ্রুত ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম রেলের ক্যান্টিনে। গরম গরম টোস্ট, অমলেট আর চা সহযোগে ব্রেটফাস্ট সেরে একটু ঘুম। ঘণ্টাদুয়েকের ঘুম সেরে একদম ফুরফুরে লাগছিল। এখানে বলে রাখি, রিটায়ারিং রুম একদম স্টেশনের মধ্যে হওয়ায় ট্রেনের হর্ন থেকে অ্যানাউন্সমেন্ট ঘুমের ঘোরেও আমাদের সঙ্গী ছিল। তাতে যে খুব সমস্যা হয়েছে তেমনটা নয়। বরং বোলপুর স্টেশনের সঙ্গে সম্পর্কটা আরও নিবিড় হয়েছে। দুপুর দুপুরই বেরিয়ে পড়েছিলাম। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢোকার অনুমতি ছিল। কোভিডের পর থেকে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইউনিভার্সিটির ভিতর পরিকল্পনাহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানোর তো মজাই আলাদা!
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৫৯ সালে প্রথম রেললাইন তৈরি করে, যখন সাহেবগঞ্জ লুপলাইন অজয় নদীর ও পার পর্যন্ত বিস্তারিত হয়। ১৮৬০ সালে তৈরি হয় বোলপুর স্টেশন। বোলপুরে কোর্ট, থানা, সাব রেজিস্ট্রি অফিস— এ সবও তৈরি হয় স্টেশনের সঙ্গে। তার পর এখানে লোকজনের বসবাস শুরু। বোলপুর স্টেশনের ইতিহাস প্রাচীন। তবে সাধারণের কাছে বোলপুর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের কারণেই। রবি ঠাকুর বিশ্বভারতী তৈরি করার আগে এখানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তৈরি করেছিলেন একটি মেডিটেশন সেন্টার। পরবর্তীতে এখানে পা পড়েছিল নেতাজিরও। আর এখন দেশ-বিদেশের কাছে শান্তিনিকেতন একটি পরিচিত নাম। বোলপুরে কোনও বিমানবন্দর নেই। স্টেশনের গুরুত্ব তাই স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বেশি। আর বোলপুর স্টেশন ছুঁয়েই তো পৌঁছতে হয় শান্তির ঠিকানায়।
ওই যে প্রথমেই বলেছিলাম, শান্তিনিকেতন আর বোলপুর একে অপরের পরিপূরক। শান্তিনিকেতন শুরুই হয় বোলপুর থেকে। যাঁরা ট্রেনে করে শান্তিনিকেতন যাননি তাঁরা এই স্বাদে বঞ্চিত। আমাদের শান্তিনিকেতন ভ্রমণ অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল সকাল আটটা থেকে। দুপুরে বেরিয়ে সোজা ইউনিভার্সিটি। তার পরটা শুধুই ঘুরে বেড়ানো। আমবাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাইকেলে চাপিয়ে বিক্রি করা মিষ্টি দই আর রাবড়ি। যদি না-চেখে দেখেছেন তা হলে এই ট্যুর বৃথা। ঠিক যেমন শান্তিনিকেতনে গিয়ে যদি সোনাঝুরির হাট থেকে পকেট ফাঁকা করে শপিং না-করেছেন, তেমনই। সোনাঝুরিতে হরেক পসরা সাজিয়ে বসা স্থানীয়দের তৈরি নানা জিনিস কিনতে কিনতে যখন সূর্য অস্ত যাবে তখন বাউলের একতারার সুরে সুর মেলাতেই হবে। ইচ্ছে হলে সাঁওতাল মহিলাদের সঙ্গে মেতে ওঠা যেতেই পারে নাচের তালে। সব মিলিয়ে শান্তিনিকেতন সত্যিই শান্তির আশ্রয়।
ফেরার পথে পাত পেড়ে বাঙালি ভূরিভোজ সেরে যখন আবার আমার বোলপুর স্টেশনের আস্তানায় ফিরলাম তত ক্ষণে অনেকটাই শান্ত হয়ে গিয়েছে স্টেশন চত্বর। সকালের সেই ব্যস্ততা আর নেই।
সেটা ছিল ৩১ ডিসেম্বর। রাত ১২টায় যখন বছর শেষের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরের আগমন বার্তা এল, তখন আমি সেই নতুন বছরকে স্বাগত জানালাম বোলপুর স্টেশনের লম্বা প্ল্যাটফর্মে হাঁটতে হাঁটতে। যেন নিজের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়েই সেই অচেনাকে আহ্বান জানালাম।
পর পর দু’বছর নতুন বছরকে আহ্বান জানাতে ছুটে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে। থেকেছিলাম বোলপুর স্টেশনের সেই রিটায়ারিং রুমে। দ্বিতীয় বার বদলে গিয়েছিল ঘর। কিন্তু অনুভূতি, না একটুও বদলায়নি। একই ভাবে, একই ভাল লাগা নিয়ে সে দিনও রাত ১২টায় বোলপুর স্টেশন-বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে আহ্বান জানিয়েছিলাম— ‘হেথা হতে যাও, পুরাতন। হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।’
স্টেশনের ক্যান্টিন তত ক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই পথে সারারাত চলে দূরপাল্লার অনেক ট্রেন। মধ্যরাতে ট্রেন থেকে নেমে গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার যাত্রীরও অভাব নেই। তাঁদের জন্যই স্টেশন চত্বরে যে দোকান সারা রাত খোলা থাকে, সে দিন আমিও নতুন বছরের প্রথম চায়ের চুমুকটা দিয়েছিলাম বোলপুর স্টেশনে।
রাতের রেল স্টেশনের এক অমোঘ মায়া রয়েছে। যা ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য সব সময় হয় না। ঘুমের ঘোরে দাঁড়িয়ে পড়া ট্রেনের জানলা দিয়ে নাম না-জানা স্টেশনকে দেখি। কখনও আবার ট্রেনের গতির সঙ্গে হুশ করে পেরিয়ে যাই নিস্তব্ধ মধ্যরাতের স্টেশন। কিন্তু মধ্যরাতের বোলপুর স্টেশনকে আমি ছুঁয়ে দেখেছি বার বার। কাকভোরে ঘুম চোখে প্রথম ভোর দেখেছি বোলপুর স্টেশন থেকে। ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখেছি দিনের প্রথম সূর্যকে। বোলপুর স্টেশন আমার কাছে শুধুই রবি ঠাকুর নয়, বোলপুর স্টেশন আমার কাছে একটা বছরের সমাপ্তি, একটা বছরের শুরু। বোলপুর স্টেশন আমার কাছে মধ্যরাতের নির্বাক উপস্থিতি।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google