সুচরিতা সেন চৌধুরী: ছোটবেলার অনেকটাই কেটেছে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম দোমহানিতে। সে কারণে সেখানকার ছোট ছোট বিষয়েও অনেকবেশি আবেগ কাজ করে যায়। সেই সময় দোমহানি থেকে কলকাতায় মামাবাড়ি আসাটা ছিল একটা উৎসবের মতো আর অদম্য ভাললাগা। ওই যে বলে না মামা বাড়ির আবদার। ঠিক তেমনটাই। সারা বছর গ্রামের জীবন ছেড়ে ক’টা দিন কিছুটা শহুরে স্পর্শ সঙ্গে দিদা, দাদু, মামা, মাসিদের আদর। সব মিলে এই যাত্রাটা ছিল সারা বছরের অপেক্ষা (Train Station 2)। কখনও কখনও বছরে দু’বার। এর থেকে বেশি নয়। তখন এতো উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় আসার ট্রেন ছিল না। হাতে গোনা কিছু ট্রেন ছিল। তবে তখন এত ভিড়ও হত না। মানুষ এভাবে উত্তরবঙ্গমুখি ছিল না। অদ্ভুত শান্তির বাস ছিল তিস্তার পাড়ে উত্তরবঙ্গের ওই প্রত্যন্তগ্রামে।
যখনই কলকাতায় আসতাম তখন আমরা ট্রেন ধরতে পৌঁছতাম নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশনে। কারণ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূর। সেখান থেকে ট্রেন ধরতে হলে আগের রাতে গিয়ে থাকতে হত। সেই সময় সরকপথও খুব মসৃণ ছিল না। মনে আছে, আমরা বাড়ি থেকে রিক্সা করে নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশনে পৌঁছতাম। বেশ খানিকটা সময় লাগত ঠিকই কিন্তু রিক্সা চলত সে পথে। উৎসবের শুরু সেই থেকেই। আমার আর আমার বোনের মজা কে দেখে। বাড়ি থেকে স্টেশন যাওয়ার পথটা ছিল সবুজে মোরা। দু’দিকে বড় বড় গাছ পুরো রাস্তাটাকে ছায়া দিত।
স্টেশন ঢোকার কিছুটা আগে ছিল দুটো রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচুড়া গাছ। আমরা বছরের যে সময় মামা বাড়ি যেতাম তখন গাছগুলো ফুলে ভরে থাকত। রাস্তায়ও ছড়িয়ে থাকত ফুল। অপূর্ব লাগত দেখতে। ওই দেখতে দেখতে কখন যেন আমাদের রিক্সাটা পৌঁছে যেত স্টেশন চত্তরে। খুব বড় না হলেও সেই সময় মনে হত কত বড় স্টেশন। এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার ফুট ওভার ব্রিজ। সিঁড়ি বিষয়টির প্রতিও খুব আকর্ষণ ছিল। দোমহানিতে সে সময় ঘনঘন ভূমিকম্পের কারণে দোতলা বাড়ি তৈরি হত না। যা দোতলা ছিল সেটা কাঠের। তাই পাঁকা সিঁড়ি বেয়ে বার বার ওঠা-নামাটাও ছিল আমার আর আমার বোনের কাছে একটা খেলা।
নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশন থেকে কখনও কাঞ্চনজঙ্ঘা আবার কখনও কামরূপ ধরে আমরা কলকাতা যেতাম। আমার বাবা ছিলেন সব কিছু সময়ে করা মানুষ। তাই অনেক আগেই স্টেশনে পৌঁছে যেতাম। তার পর বাকি সময়টা অপেক্ষা। তবে ওই বিরাট লম্বা প্ল্যাটফর্মের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌঁড় প্রতিযোগিতা করতে করতেই আমাদের সময় কেটে যেত। স্টেশনে কয়েকটা ছোট ছোট দোকান ছিল। সেখান থেকে বিস্কুট কেনা হত। মা-বাবা চা খেতেন। কিছুটা ঝাপসা নিউ ময়নাগুড়ির স্মৃতি ধূসর হলেও মনের মণিকোঠায় আজও রয়ে গিয়েছে ভাললাগা হয়ে। ওই স্টেশন চত্তর ছিল নানা রকমের গাছে ঢাকা। খুব ভুল না করলে সে সময় স্টেশনের পাশেও ছিল দুটো রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া গাছ।
একবার স্টেশনে দেখা হয়ে গিয়েছিল আমাদের স্কুলের এক স্যারের সঙ্গে। ট্রেন আসা পর্যন্ত স্যার আমাদের সঙ্গেই সময় কাটিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, সব জায়গায় রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া গাছ পাশাপাশি রাখা হয়। রাধা-কৃষ্ণকে কেউ আলাদা করে না। পাশাপাশি থাকলে দুটো গাছেই অনেক ফুল হয়। শুনে অদ্ভুত রোমান্টিক একটা অনুভূতি হয়েছিল। খেলার ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে ওই গাছদুটোকে দেখতাম। গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুল কুড়োতাম আর মা-র কোলে জমাতাম। সেই নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশনটা আজও চোখ বুজলে স্পষ্ট দেখতে পাই। দেখতে পাই সেই উত্তরবঙ্গের ছোটবেলা আর ছোট ছোট কিছু আনন্দের মুহূর্ত।
যেদিন সারাজীবনের জন্য উত্তরবঙ্গ ছেড়ে কলকাতায় চলে এলাম সেদিন গ্রামের কত মানুষ আমাদের সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত এসেছিল। বেশিরভাগই সাইকেল চালিয়ে। আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে ফিরেছিল। সেই শেষ দেখা হয়েছিল এই স্টেশনের সঙ্গে। তার পর কলকাতা থেকে যখন উত্তরবঙ্গে যেতাম তখন শিলিগুড়িতেই গিয়ে থাকতাম। তাই নিউ জলপাইগুড়িই মূল স্টেশন হয়ে ওঠে। আর কখনও যাওয়া হয়নি নিউ ময়নাগুড়িতে। না যাওয়া হলেও ভাললাগায় নিউ ময়নাগুড়িকে ছাঁপিয়ে যেতে পারেনি নিউ জলপাইগুড়ি।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google