সুচরিতা সেন চৌধুরী: হাতে সময় নেই। অফিসে ছুটি নেই। ব্যস্ততা তুঙ্গে। তাও মনটা বড্ড উড়ু উড়ু করছে। কিছুতেই মন বসছে না কাজে। ঘরেও টিকছে না মন এই পরিস্থিতিতে মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ছোট্ট করে যদি ছুঁয়ে আসা যায় প্রকৃতি। আসলে প্রকৃতি আমাদের আশপাশেই নিজের রূপের ডালি সাজিয়ে বসে রয়েছে। আমরা দেখতে পাই না। আমরা শুধু ছুটি চেনা সেই চিরপরিচিত পাহাড় বা সমুদ্রে। সব সময় প্রকৃতির কাছে যেতে হলে পাহাড় বা সমুদ্রেই যেতে হবে কোথায় বলা আছে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের ওপরে একটি শিশিরবিন্দু…’’। খুব সত্যি কথা। তাই এমন অস্বস্তিকর সময়গুলোতে আমরা ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়াই যদি দেখি তাহলেই শান্তি। তেমনই একটি জায়গা মালঞ্চ (Malancha)।
শহর থেকে একটু বেরিয়ে কিছুটা গেলেই মালঞ্চ। উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর। উত্তর ২৪ পরগনার গা দিয়েই বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী। বা বলা যায় নদীর গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছোটছোট জায়গাগুলো। তার মধ্যে অন্যতম ব্যারাকপুর। তবে তার নাম এখন আর মালঞ্চ নেই বদলে হয়েছে মঙ্গলধারা ট্যুরিজম প্রপার্টি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই গেস্ট হাউসে একটা দিন-রাত কাটিয়ে আসা যেতেই পারে। আমি সোদপুর নিবাসী হওয়ায় সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায়। অটো অটো করে পৌঁছে গিয়েছিলাম গঙ্গার পাড় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অসাধারণ সুন্দর জায়গাটিতে।
বর্ষার টিপ টিপ বৃষ্টি তখন সারাদিনই চলছে। সেই বৃষ্টির জল গায়ে মাখজতে মাখতে যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন বেস ঝেঁপে নেমে বর্ষা। গঙ্গা জলে টইটম্বুর। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা নদীর জলে পড়ে ছলকে উঠছে খানিকটা। যেন প্রতিযোগিতা চলছে কে আগে পড়তে পারে। সাময়িক আস্তানা নিতেই হল মালঞ্চর ঘরে। তাতে কোনও অসুবিধে নেই। ঘরের জানলায় চোখ রাখলে সামনে শুধুই গঙ্গার বয়ে যাওয়া। দূরের দিগন্তে আকাশ মিশেছে শহুরে ঘর-বাড়ির পিছনে। তার মধ্যেই অঝোর ধারায় ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। এমন পরিবেশ ঘরের কাছে থাকলে দূরের পাহাড় ভ্রমণ মাঝে মাঝে স্কিপ করাই যায়। ট্রেনের টিকিট থেকে গাড়ি, হোটেল বুকিংয়ের ঝামেলা নেই। তবে এখানে যদি থাকতে হয় আগে থেকে বুক করে নেওয়াই ভাল।
জানলায় চোখ রেখে দেখতে দেখতে কখন যেন দুপুর হয়ে গিয়েছে টেরই পাইনি। লাঞ্চের ডাক আসতেই সম্বিত ফিরল। বিশাল ডাইনিং হল। সুস্বাদু রান্না। স্টাফদের অসাধারণ ব্যবহার—সবই মুগ্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। একদিন কেন, একাধিক দিন এভাবেই এখানে কাটিয়ে দেওয়া যায়। আর ওয়ার্ক ফর্ম হোমের জমানায় তো এর থেকে ভাল বিকল্প আর কিছু হতেই পারে না। শহরের কাছেও থাকা গেল আবার প্রকৃতির সঙ্গে। অফিসের হঠাৎ ডাক এলে পৌঁছে যাওয়াও যাবে। সব মিলে অনবদ্য বিকল্প বেড়ানোর। দুপুরের খাওয়া সেরে একটু গড়িয়ে নিলাম। বৃষ্টি তখনও চলছে। বিকেল হতেই বৃষ্টি কমল।
বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় হালকা শিরশিরানি। গঙ্গার জলে এতক্ষণ বৃষ্টির দাপাদাপি চলছিল আর এখন খেলা করছে ফুরফুরে হাওয়া। লজ থেকে বেরিয়ে পৌঁছে গেলাম একদম গঙ্গার ঘাটে। জেটি মতো করা রয়েছে। সেখানে বসে গঙ্গার হাওয়া খেতে খেতে জমে উঠল আড্ডা। গঙ্গার জলকে রাঙিয়ে সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত ধরা পড়ল মনের ক্যামেরায়। এমন সূর্যাস্ত দেখার জন্য কত জন্ম অপেক্ষা করতে হয়। মাঝ নদী থেকে মাঝি হাঁক দিলেন, ‘‘যাবেন নাকি নৌকো ভ্রমণে?’’ আকাশে পেজা তুলোর মতো মেঘও তখন সূর্যের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত। বিকেলের চা-টা ওই জেটি বসেই জমে উঠল। বিকেলেই ঘুরে নেওয়া যায় পাশের গান্ধী ঘাট। আর না চাইলে শুধুই গঙ্গারপাড়। সন্ধে নামতেই আবার বৃষ্টি এল। রাতের গঙ্গা এভাবে আগে কখনও দেখা হয়নি। অদ্ভুত সুন্দর। বিদ্যুতের আলোর প্রতিবিম্ব ঘষে যাচ্ছে জলের উপর।
অনেক রাত পর্যন্ত গঙ্গার বয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে ঘুম এল। সকালে ঘুম ভাঙতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম গঙ্গার ঘাটে। সকালের শহর, শহরতলীরও একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। নিত্যদিনের জটিল জীবনে নিজের বাড়ির ব্যালকনীতেও চোখ রাখা হয় না তাই টের পাওয়া যায় না। শান্ত, স্নিগ্ধ এই জায়গাগুলোই দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে। তবে এই জায়গাটা এমনই থাকে সারা দিন জুড়ে। প্রকৃতির অপূর্ব রূপে ঢাকা।
কী ভাবে যাবেন— শিয়ালদহ থেকে লোকাল ট্রেনে পৌঁছে যান ব্যারাকপুর। স্টেশন থেকেই পেয়ে যাবেন রিক্সা। ভাড়া বেশ খানিকটা বেশি রিক্সা হিসেবে। তবে রাস্তাটাও অনেকটা। নিজের গাড়ি নিয়ে যেতে হলে বিটি রোড ধরে ডানলপ পেড়িয়ে সোজা ব্যারাকপুর।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google