ভয়ঙ্কর ঝড়-বৃষ্টির পুরী ভ্রমণ, দেখেছিলাম সমুদ্রের ধ্বংসাত্মক রূপ

ভয়ঙ্কর ঝড়-বৃষ্টির পুরী ভ্রমণ

ভয়ঙ্কর ঝড়-বৃষ্টির পুরী ভ্রমণ -এর অভিজ্ঞতা হয়েছিল লেখকের। পুরী মানে তো সব বাঙালির পছন্দের ডেস্টিনেশন। অনেক বাঙালি হিসেব করে বলতেও পারেন না কতবার গিয়েছেন সেখানে। সমুদ্র মানেই সারাক্ষণই একটা ঝোড়ো হাওয়া আর তার সঙ্গে যদি একটু বৃষ্টি হয় তাহলে তো দারুণ কিন্তু সেটাই যখন বিভৎস রূপ  নেয় তখন কী অভিজ্ঞতা হয় সেটাই তুলে আনলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


প্রতিবারের মতো সেবারও পুরী ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম সপরিবারে। মানে বাবা-মা-আমি-বোন আর আমার এক মাসি-মেসো আর ভাই। অনেক বছর আগের কথা। সালটা ৯০’র শুরুর দিকে। ছোট তবে অতটাও নয় যে ভুলে যাব, সবটাই মনে আছে দারুণভাবে। আর সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা যা ভোলার নয়। যতদূর মনে পড়ছে বর্ষার সময়। সমুদ্রে বর্ষাকাল আমার পছন্দ। আসলে বৃষ্টিই আমার খুব পছন্দ। সে পাহাড় হোক বা সমুদ্র বা জঙ্গল।

বাঙালির পুরী মানে সেই সময় হলিডে হোম। নিজেরা রান্না করে খাওয়া। সকালবেলা সমুদ্রে পাড়ে মনিং ওয়াক করতে করতে বিচ থেকে মাছ কিনে ফেরা। মাছভাজা, মাছের ঝোল দিয়ে ভাত। সে এক এলাহী ব্যাপার। আমার কাছে পুরী ভ্রমণের ভাললাগাই ছিল এই পুরো বিষয়টা। বেশিরভাগ সময়ই এই ফ্লেভারটাই পেয়েছি। সেবার অবশ্য রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। তবে ঘরটা ছিল দারুণ। ঘর লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়ালে আর বিচে যাওয়ার প্রয়োজন হত না। স্বর্গদ্বার থেকে কিছুটা আগে।

প্রথম দু’দিন দারুণ কেটেছিল। কখনও মেঘ, কখনও রোদ আবার কখনও হালকা বৃষ্টি। বিচের ঘুরে, সমুদ্রে স্নান করে, মার্কেট থেকে কটকির জামা-কাপড় কিনে, বাইরে খেয়ে ভালই কেটেছিল সময়টা। তৃতীয় দিন সব গন্ডোগোল হয়ে গেল। সেদিন আমরা বাসে করে কোনারক ঘুরতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথেই বৃষ্টি শুরু হল। যতক্ষণে পুরীতে এসে নামলাম ততক্ষণে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে সঙ্গে ঝড়। কোনও রকমে ভিজতে ভিজতে হোটেলে এসে পৌঁছলাম। লোকজন ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। দোকানপাট দুমদাম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

এর মধ্যেই বাবা একটা ভাল কাজ করেছিলেন, রাতের খাবার কিনে নিয়েছিলেন আগে থেকেই। যে কারণে রাতটা না খেয়ে কাটেনি। যাইহোক, হোটেলে ফিরলাম সবাই কাকভেজা হয়ে। জামা-কাপড় বদলে রাতের খাওয়ার সেরে নিলাম। ততক্ষণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে গিয়েছে। হোটেলের ম্যানেজার মোমবাতি দিয়ে গেল দু’ঘরের জন্য দুটো। কিন্তু প্রকৃতির তাণ্ডব দেখে আমরা রাতে এক ঘরে থাকারই পরিকল্পনা করলাম। হাওয়ার তেজে মনে হচ্ছে দরজা-জানলা সব ভেঙে যাবে। সমুদ্রের গর্জন এতটাই কাছে যে মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে ঢুকে আসবে। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত বারান্দায় কাটিয়েছি আগের দু’দিন। কিন্তু এদিন খাট থেকে নিচে নামতেও ভয় লাগছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে পুরো বাড়িটা দুলছে।

এর মধ্যেই হঠাৎ দরজায় প্রবল জোড়ে জোড়ে ধাক্কা। খুলে দেখি একটা বাচ্চা প্রায় আমার মাসতুতো ভাইয়ের বয়সী দাঁড়িয়ে রয়েছে। মোমের আলোতে দেখে চিনতে পারলাম, আমাদের পাশের ঘরেই ছিল ওরা। বাবা-মা-ভাই-বোন। কিন্তু বাকিরা কোথায়। বাচ্চাটা এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছে যে কিছুই বলতে পারছে না তার উপর চুপচুপে ভেজা। ভাইয়ের জামা কাপড় পরিয়ে, ওকে খাইয়ে কিছুটা স্বাভাবিক করা গেল। তার পর সে জানাল, ওর মা আর বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা সবাই মিলে বিচে গিয়েছিল। ঝড়ের সময় ওর মা আর বোন আর ও আর ওর বাবা আলাদা হয়ে যায়। বাবা ওকে হোটেলের বাইরে ছেড়ে দিয়ে মা-বোনকে খুঁজতে গিয়েছে। ছেলেটি যে বুদ্ধি করে উঠে এসে আমাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছেছে সেটাই বড় বিষয়। ভাবলেই আতঙ্ক হচ্ছিল। অনেক কিছু হতে পারত।

এদিকে ঝড়-বৃষ্টি কমার কোনও লক্ষ্মণ নেই। বেড়েই চলেছে ক্রমশ। আতঙ্ক গ্রাস করছে। আরও ভয়ঙ্কর কিছুর ভাবনায়। যে ভাবে সমুদ্র ফুলে ফেপে উঠেছে তাতে যেকোনও সময় আমাদের হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। জানলা, দরজার ফাঁক দিয়ে গতিতে জল ঢুকছে। আমরা হাত-পা গুটিয়ে সবাই মিলে বিছানার উপর বসে। প্রায় মাঝ রাতে দরজায় আবার ধাক্কা। বাবা দরজা খুলতেই দেখি ওই বাচ্চাটির পরিবার দাঁড়িয়ে, ঠান্ডায় কাঁপছে। ছেলেকে পেয়ে ওরা‌ নিশ্চিন্ত হয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে গেল। জানা গেল, মেয়ে-বৌকে অনেক কষ্ট করে খুঁজে পেয়েছেন ভদ্রলোক। তবে সবাই সুস্থ রয়েছেন সেটাই বড় কথা। উনিই জানালেন, টুরিস্টদের অনেকেই মিসিং। সেই সময় মোবাইল ফোন ছিল না। থাকলেও কতটা কাজ করত বলা মুশকিল।

সারারাত চলল প্রকৃতির তাণ্ডব। তার মধ্যেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন ঝড়-বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু গোটা পুরী ধ্বংসস্তুপের রূপ নিয়েছে। ভেঙে পড়েছে দোকানপাট। বিচের ছোট ছোট দোকানগুলোর কোনও চিহ্ন নেই। বিচে ভিড় জমিয়েছে স্থানীয় মানুষরা। সকলের পরিবারের কেউ না কেউ নৌকো নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিল, তাঁরা কেউ ফেরেনি। সে এক অদ্ভুত পরিবেশ। একটা করে নৌকো পাড়ে এসে থামছিল আর বিচ জুড়ে উচ্ছ্বাস প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার। যতক্ষণ খেয়াল করেছি তখনও প্রচুর মানুষ বসে প্রিয় মানুষের ফেরার অপেক্ষায়। হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুঁজতে ডুবুরি নেমেছে। শেষ পর্যন্ত কেউ ফিরেছে কেউ ফেরেনি আর কখনও। পুরী আবার সুস্থ হয়ে উঠেছে। সেই রাতের দাগ আমার মতো অনেকেরই মনে থেকে গেছে নিশ্চই।

সেদিন আর হোটেলের বাইরে যাইনি আমরা কেউ। বিচে যাওয়ার অনুমতিও ছিল না। তবে বারান্দা থেকে দেখেছি সমুদ্র অনেক শান্ত হয়েছে। রাতে আতঙ্কে বার বার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তবে সেই রাতে আর ঝড়-বৃষ্টি হয়নি। পর দিন মেঘলা আকাশকে সঙ্গী করেই পুরীকে বিদায় জানিয়েছি। প্রার্থণা করেছি ফিরে আসুক মানুষগুলো তাঁদের প্রিয় মানুষগুলোর কাছে, পরিবারের কাছে।

ছবি: সংগৃহিত

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)