বিসমিল্লা, সানাইয়ের সুর ও বানা রস

বিসমিল্লা খানবিসমিল্লা খান

জাস্ট দুনিয়া ব্যুরো: বিসমিল্লা! ফের নাতি হওয়ার খবর শুনেই রসুল বক্‌শ এই শব্দটাই অস্ফুটে উচ্চারণ করেছিলেন।

বিসমিল্লা মানে আল্লার নামে। কোনও শুভ কাজ শুরু করার আগে বিসমিল্লা উচ্চারণ করার রীতি আছে মুসলমানদের মধ্যে। আবার, সূচনা অর্থাৎ আরম্ভ অর্থেও বিসমিল্লা ব্যবহৃত হয়। রসুল বক্‌শ তখন কি জানতেন, লোকশিল্পে ব্যবহৃত সানাইয়ের মতো একটি সাধারণ যন্ত্রের আন্তর্জাতিক সফরের সূচনা হবে তার ওই নাতির হাত ধরেই? সানাই আর বিসমিল্লা হয়ে উঠবে সমার্থক।

দাদা সামসুদ্দিনের সঙ্গে মিলিয়ে নবজাতকের নাম রাখা হল কামরুদ্দিন। কিন্তু, রসুলের সেই বিসমিল্লাই থেকে গেল আজীবন। কামরুদ্দিনের পরিচিতি আর বাড়েনি। ভোজপুরের রাজার ডুমরাও প্রাসাদে সভাসংগীতকার ছিলে‌ন রসুল বক্‌শ। বর্তমানে বিহারের ভিতরেই পড়ে ডুমরাও। রসুলের ছেলে পয়গম্বরও ওই সভাতেই সানাই বাজাতেন। দু’জনেরই সানাইবাদক হিসাবে বেশ খ্যাতি ছিল। কিন্তু, সানাইয়ের মতো যন্ত্রকে মার্গসঙ্গীতের স্তরে উন্নীত করে তাকে পূর্ণ অবয়ব দিয়েছিলেন পয়গম্বরের ছেলে উস্তাদ বিসমিল্লা খান

‘বাজাতে বাজাতে মনটা আমার বৃন্দাবনে চলে যায়।’
তাঁর পারফরম্যান্স যে কখন মানবদর্শন হয়ে উঠত, শ্রোতারাই টের পেতেন না।
‘‘এর চেয়ে আর আনন্দ কীসে আছে!’’

১৯১৬ সালের ২১ মার্চ ডুমরাওতে জন্ম বিসমিল্লার। তাঁর যখন ৬ বছর বয়স, তখন তাঁরা উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে চলে আসেন। সেখা‌নেই কাকা আলি বক্‌শের কাছে সানাই বাজানোর হাতেখড়ি। সানাইয়ের মতো এই শহরও ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে বিসমিল্লার সমার্থক শব্দ। বারাণসী মানে বিসমিল্লাও। তিনি ভীষণ রসিক ছিলেন। বারাণসীকে স্থা‌নীয় উচ্চারণে বানারস বলা হয়। তিনি মজা করে বলতেন, ‘বনা রস!’ অর্থাৎ যেখানে রস তৈরি হয়। সুরের রস। ডালমন্ড গলি খুবই বিখ্যাত বারাণসীতে। ওই পাড়ার সুর শুনে নাকি বিসমিল্লার কান পবিত্র হয়ে যেত।

বিসমিল্লা খান

বিসমিল্লা খান

প্রতি দিন গঙ্গায় স্নান করতেন। তার পর মসজিদে নমাজ পড়ে বালাজি মন্দিরে সারা দিন সানাই বাজাতেন। এটাই ছিল তাঁর প্রতি দিনের রুটিন। তাঁর নিজের জীবনটাই সম্প্রীতির একটা আস্ত উদাহরণ। প্রতি অনুষ্ঠানে ‘রঘুপতি রাঘব’ অবশ্যই বাজাতেন। শুনতেন রাধাকৃষ্ণের লীলা। সানাইয়ে রাধাকৃষ্ণের লীলা পরিবেশন করতে করতে বলতেন, ‘বাজাতে বাজাতে মনটা আমার বৃন্দাবনে চলে যায়।’ তাঁর পারফরম্যান্স যে কখন মানবদর্শন হয়ে উঠত, শ্রোতারাই টের পেতেন না। বলতেন, ‘‘এর চেয়ে আর আনন্দ কীসে আছে!’’ কখনও দাঁড়িয়ে সানাই বাজাতেন না। সব সময় বসেই বাজাতেন। কিন্তু, মহরমের দিন তাঁকে সানাই হাতে রাস্তায় দেখা যেত। নগর পরিক্রমার সময় প্রাণ খুলে কোনও রাগ বাজাতেন না। বাজাতেন, বিলাতগীতি নৌহা। বারাণসীর সেই মহরম দৃশ্য বড়ই মনোরম।

বিসমিল্লা খান

বিসমিল্লা খান

কলকাতায় ১৯৩৭ সালে সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনে তিনি প্রথম সানাই উপস্থাপন করেন। চমকের সেই শুরু। আজীবন সেই চমকেই মজিয়ে রেখেছেন শ্রোতাদের। মার্গসঙ্গীতের ভক্তদের পাশাপাশি সেই তালিকায় অগুনতি মানুষ রয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিন লালকে‌ল্লায় বাজিয়েছিলেন বিসমিল্লা। ১৯৪৭-এর পর থেকে প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী ভাষণের পরেই দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হত উস্তাদ বিসমিল্লা খানের সানাইবাদন— লাইভ। আবার ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে তিনি ওই লালকেল্লাতেই সানাই বাজিয়েছেন। সে বার শুনিয়েছিলেন রাগ কাফি।

অনিলের জলসাঘর

কিরানা, আগরা, ডাগর, বানারসি প্রভৃতি গায়কি অঙ্গে একই রাগ বিভিন্ন ঘরানায় কী ভাবে পরিবেশন করা হয় তা বারে বারেই দেখিয়েছেন বিসমিল্লা। কী ভাবে পারেন এমন দুরূহ কাজ? তিনি বলতেন, ‘বিভিন্ন ঘরানা থেকে ফুল তুলে এনে আমার সানাইয়ে ভরে দিই। তৈরি হয়ে যায় গুলদস্তা। আমার আঙুল, আমার ফুঁ— এ সব নিয়ে অনেকে চর্চা করে। আমি বলি, আমি কে? আমাকে যিনি তৈরি করেছেন, তাঁরই তো তারিফ করা উচিত।’ নমাজও সুরে গেয়ে তিনি বলতেন, ‘এ-ও তো সঙ্গীত!’ কখনও কখনও নমাজের সঙ্গে মিশিয়ে দিতেন ভজন। বলতেন, ‘ভজনই বলো, আর নমাজ, সবই তো আসলে সাত সুরে বাধা।’

পেয়েছেন ভারতরত্ন ও পদ্মবিভূষণ, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি ও তানসেন সম্মান। বারাণসী ছেড়ে কোথাও থাকতে চাইতেন না। তাই আমেরিকায় থাকার আহ্বান সহজেই প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলেন। স্ত্রী মৃত্যুর পর সানাইকেই মনে করতেন তাঁর ‘বেগম’। ২০০৬-এর অগস্ট মাসে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন উস্তাদজি। তাঁকে বারাণসীর হেরিটেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চার দিন পর ২১ অগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন বিসমিল্লা। তাঁর শেষ ইচ্ছে মতো তাঁর দেহের সঙ্গেই কবরে দেওয়া হয়েছিল একটি সানাই।

ইন্ডিয়া গেটে বসে সানাই বাজানোর ইচ্ছে ছিল বিসমিল্লার। কিন্তু, সে স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গিয়েছে তাঁর।