পেশাদার জীবনের প্রায় পুরো সময়টাই কাটিয়ে দিয়েছেন আমেরিকাবাসী হয়ে। সেখানেই কাজ, সেখানেই সংসার। অবসর নিয়েছেন চাকরী থেকে। দীর্ঘদিন সে দেশে বসবাস করার সুবাদে তার লুকিয়ে থাকা দিকটা ভীষনভাবে জানেন। আর সেটাই আতঙ্কিত করে তাঁকে। মঙ্গলবার টেক্সাসের স্কুলে বন্দুকবাজের হামলার ( (Texas School Shooting)) ঘটনা যেন সে দিকটাই তুলে ধরল আবার। আমেরিকা থেকে লিখলেন ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়।
টেক্সাসের স্কুলের ঘটনা (Texas School Shooting) আরও এক বার আমাকে নাড়িয়ে দিল। এত বছর আমেরিকায় বসবাসের সুবাদে বার বার এ রকম পরিস্থিতিকে সামনে থেকে দেখেছি। আর তত বার আতঙ্কে ডুবে গিয়েছি। মনে হয়েছে এই ঘটনা তো আমার পরিবার, আমার মেয়ে, আমার নাতনির সঙ্গেও ঘটতে পারে! হতাশা গ্রাস করেছে। ভেবেছি এর থেকে বেরিয়ে আসার কী উপায়। অনেক খুঁজেও সে রাস্তা পাইনি। আমেরিকায় সাধারণ মানুষের দরকার নিরাপত্তা। তাই আইন করে সবার হাতে তুলে দাও বন্দুক। আর তাতেই নিরাপত্তার দফারফা। আমেরিকা থেকে লিখলেন ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাগ হয়েছে? চালিয়ে দাও গুলি। কেউ সমস্যা করছে? সটান পকেট থেকে বেরিয়ে আসবে বন্দুক। বন্দুক আমেরিকার মানুষের অধিকার। প্রাচীন এক নিয়মের জাতাকলে পড়ে মানুষ যেন আগ্নেয়াস্ত্রের দাস হয়ে গিয়েছে। বহু বহু বছর আগে যখন সাধারণের নিরাপত্তার জন্য এই আইন চালু হয়েছিল, তখন পরিস্থিতিটা একদম অন্য রকম ছিল। তখন নিরাপত্তার দরকার ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে পরিস্থিতি। মানুষকে এখন নিরাপত্তা দেয় পুলিশ, প্রশাসন। এই পরিস্থিতি নিরাপত্তা আইনের আওতায় থাকায় এই বন্দুক ব্যবহারের আইন তুলে দেওয়ার সময় এসেছে।
যত বার এমন ঘটনা শুনি, ঠিক এটাই মনে হয়। আর ঠিক তার পরেই বুঝতে পারি এই আইন বদলের নয়। এই আইন বদলাতে হলে রাস্তায় নামতে হবে যুব সমাজকে। অতীতে এক বার একটা অংশে এই আন্দোলন সাময়িক সময়ের জন্য মাথাচাড়া দিয়েছিল। কিন্তু তার পর সব যে কে সেই।
রাজনৈতিক দলগুলো চায় না। আমেরিকার শক্তিশালী রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনও নয়। তারা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের বিরোধিতা কেউ করে না। যার ফলে কত মায়ের কোল শূন্য হয়ে যাচ্ছে, শুধুমাত্র কারও সাময়িক ক্ষোভের কারণে। টেক্সাসের উভালদের রব এলিমেন্টারি স্কুলের ঘটনা শুনে চমকে যাইনি। কিন্তু আতঙ্কটা আরও এক বার গ্রাস করছে। শুনলাম, ছেলেটির বয়স ১৮। সে নাকি এই স্কুলে হামলা চালানোর আগে বাড়িতে তার ঠাকুমাকে মেরেছে। তিনি এখন সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। তার পর ওই স্কুলে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছে। কে আটকাবে। হয়তো ওর ঠাকুমা ওকে আটকাতেই চেয়েছিলেন, জানি না। ঠিক কী হয়েছিল। কিন্তু যাঁদের গেল তাঁদের তো সারাজীবনের জন্য চলে গেল।
আজ স্কুল, কাল কলেজ, পরশু শপিংমল, তার পরের দিন সিনেমা হল, কখনও খোলা রাস্তায় অচেনা, অজানা সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালিয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে এই প্রজন্ম। এটা আরও বেশি আতঙ্কের। আসলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা তো তাঁদেরই ছিল। হয়তো এই ছেলেটির জীবনে এমন কোনও ঘটনা রয়েছে। হয়তো প্রত্যেকেরই থাকে। কেউ তাঁকে অপমান করেছে, কেউ তাঁকে সমস্যায় ফেলেছে, কোথাও সে র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছে— সব বদলা নিয়ে নাও, চালাও গুলি। পুলিশের গুলিতে সে-ও মারা গিয়েছে। কারও কাছে বাবার বন্দুক তো কারও নিজের। ২০১২-তে কানেকটিকাটে ২০ জন শিশু ও ৬ জন স্টাফের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা এখনও তাজা রয়েছে তার মধ্যেই আরও এক বার।
একটা ঘটনা মনে পড়ছে। অনেক বছর আগে আমরা আলবেনিতে থাকতাম। একটা ছোট্ট জায়গা। সারা ক্ষণ বরফে ঢাকা থাকত। তখন আমার মেয়ে ছোট। আমাদের পাশের পাড়া থেকে একটি মেয়েকে বন্দুক দেখিয়ে অপহরণ করে নিয়ে চলে গেল। জানতে পেরে আঁতকে উঠেছিলাম। হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, এ তো আমার মেয়ের সঙ্গেও হতে পারে। প্রতি দিন এই আতঙ্কেই বাঁচতে হয়। বাইরের জগতের কাছে আমেরিকার যে রূপ দেখা যায়, আসলে আমেরিকা তা নয়। অশিক্ষা, অপসংস্কৃতি আমেরিকার মানুষের অবক্ষয়ের কারণ। এখানের মাত্র ৩৩ শতাংশ মানুষ কলেজ গ্র্যাজুয়েট। এটাকে অশিক্ষা বলব না তো কী বলব। তাই বিকল্পের অভাব। রাগ, ক্ষোভ মানেই মানুষকে মেরে দাও। ভাবনা-চিন্তার জগতটা ক্ষুদ্র। আমেরিকার মতো আইন কোনও দেশে নেই। এ এক আজব দেশ। চাকচিক্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে মানসিক অবক্ষয়ের কাহিনি।
(বিদেশের আরও খবরের জন্য এখানে ক্লিক করুন)
(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)