মহালয়া ও দুর্গাপুজো, আদৌ কি কোনও সম্পর্ক আছে এই দুয়ের মধ্যে

মহালয়া

মহালয়া আসলে কী বা কেন? কেনই বা হয় এই মহালয়া যাকে জুড়ে দেওয়া হয় দুর্গাপুজোর সঙ্গে। হঠাৎ করেই সেই মহালয়া নিয়ে অন্য তথ্য উঠে আসছে। উঠে আসছে শুভ ও অশুভর কথা। তা নিয়েই লিখলেন জিকো রায়


রোজকার মতো ৭টায় নয়, আজ অ্যালার্মে ঘুম ভাঙল। তখন ভোর চারটে। ঘুম জড়ানো চোখেই দেখলাম, বড়দের চোখটা কেমন ছলছলে! দূর থেকে ভেসে আসছে পরিচিত কণ্ঠস্বর। পুজোর সুবাস যেন ফিরে আসছে। বাইরে আগমনী সুগন্ধ আর সাতসকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ফেসবুকের নিউজফিড আর হোয়াটস্‌অ্যাপের ঘন ঘন মেসেজ জানান দিচ্ছে যে আজ ‘শুভ মহালয়া’।

কিন্তু মহালয়াকে শুভ বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? মহালয়ার দিনটা কি সত্যিই শুভ? মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর সরাসরি কোনও সংযোগ আছে কি?

আসলে মহালয়া শব্দটি এসেছে মহা আলয় থেকে। মহাভারতের আখ্যান অনুযায়ী, কর্ণ মর্তে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপ্রতিপদ তিথিতে এসে নিজের পিতৃপুরুষকে পিণ্ড দান করেন এবং আশ্বিনের অমাবস্যা তিথিতে শেষ জলদান দান করে স্বর্গে ফিরে যান। এই বিশেষ পক্ষকাল সময়কে শাস্ত্রে পিতৃপক্ষ বলা হয়েছে। সেই থেকে কেবল একটি নির্দিষ্ট দিনেই বাঙালি তিল-জল দিয়ে তর্পণ করে তাদের পিতৃপুরুষকে পরিতৃপ্ত করতে। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে, আজকের দিনে পিতৃপুরুষের আত্মারা মর্তলোকে ফিরে এসে এক মহা আলয় তৈরি করে যা মহালয়া নামে পরিচিত।

তর্পণের এই বিশেষ দিনটি অর্থাৎ মহালয়ার দিনটিকে শুভ হিসেবে ধরা হবে কি না তাঁর নির্দিষ্ট কোনও উল্লেখ বা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। পণ্ডিতদের মতে, পঞ্জিকায় কোনও দিনকেই আলাদা করে শুভ বলা নেই। বিবাহ, অন্নপ্রাশনের মতো বিভিন্ন শুভকর্মের জন্য নির্দিষ্ট দিন বা সময়ের উল্লেখ থাকে। কিন্তু কোথাও শুভ দুর্গাপুজো বা শুভ কালীপুজো ইত্যাদি বলা হয় না। তাই যে ভাবে শুভ বিবাহ, শুভ অন্নপ্রাশন বলা হয় সে ভাবেই লোকমুখে প্রচলিত হয়েছে শুভ দীপাবলী বা শুভ মহালয়া। কোনও কোনও শাস্ত্রজ্ঞের মতে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পিতৃপুরুষ, আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিত সকলকে জল-পিণ্ড প্রদান করে তাদের তৃপ্ত করা হলে সেই কাজ বা দিনকে অশুভ বলা যায় না। সুতারং ফেসবুকের নিউজফিডে কিংবা হোয়াটস্যাপের ইনবক্সে ‘শুভ মহালয়া’ উইশ করাটা যথার্থই যুক্তিসঙ্গত হলেও ‘হ্যাপি মহালয়া’ কিন্তু একদমই মানায় না।

তর্পণের দিন অর্থাৎ মহালয়ায় সাধারণত পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের সূচনা। এমনকি এই দিনে পুজোর মরসুম শুরু বলেই আজকের বাঙালির জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গিয়েছে। অথচ হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, এটি প্রায় ভিত্তিহীন। এমনকি মহালয়া দিনটির সঙ্গে রেডিও, টিভিতে সম্প্রচারিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ স্তোত্র পাঠেরও সরাসরি কোনও সংযোগ নেই।

১৯৩২-এ দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর ভোরে তৎকালীন কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার হয়েছিল এক অভিনব আগমনী গীতি-আলেখ্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। রচনায় বাণীকুমার, সুর-সংযোজনায় পণ্ডিত হরিশচন্দ্র, রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং স্তোত্রপাঠ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বেতার সম্প্রচারের ইতিহাসে এই রকম অনুষ্ঠান আর কোনও দিন নির্মিত হয়নি, যার জনপ্রিয়তা এর ধারেকাছে আসতে পারে।

১৯৭৬-এ কেবল এক বারই মহালয়ার ভোরে বাঙালির প্রাণভোমরা উত্তমকুমারের কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনীর বদলে বেজে উঠেছিল এক নতুন গীতি-আলেখ্য ‘দুর্গতিনাশিনী’। কিন্তু সেই পরিবর্তন মেনে নেয়নি কোনও বাঙালি। জনগণের প্রবল প্রতিবাদে মহাষষ্ঠীর সকালে মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার করতে বাধ্য হয়েছিল সরকারি প্রচার মাধ্যম আকাশবাণী।

১৯৩২-এ কিন্তু মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান প্রথম বার সম্প্রচার হয়েছিল মহাষষ্ঠীর ভোরে, মহালয়ার দিন নয়। কিন্তু পরের বছর থেকে সেই অনুষ্ঠান মহালয়ার ভোরে সরিয়ে আনা হয় একটাই কারণে, মানুষজন ওই অনুষ্ঠান শোনার জন্য ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠবেন এবং তার পর তর্পণ করতে যাবেন। এ বার আপনারাই বলুন, মহালয়ায় পিতৃপুরুষকে জলদান করার তিথির সঙ্গে দুর্গাপুজোর এবং মহিষাসুরমর্দিনী গীতি-আলেখ্যটির সরাসরি কোনও সংযোগ আছে? না কি নেই?

(আরও ফিচার পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)