এই কাবুল-কে চিনতে পারছেন না যারা আগের কাবুলকে দেখেছেন। যারা ওই রাস্তায় হেঁটেছেন, কোনও দোকানে বসে স্থানীয় খাবার খেয়েছেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, কতটা সময় কাটিয়েছেন। তেমনই একজন যাঁর এত বছর পরও ওই মানুষগুলোর কথা ভেবে মন কেঁদে উঠছে। কিন্তু কেমন ছিল সেই সময়টা, নিজের অভিজ্ঞতা জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে ভাগ করে নিলেন জয়ন্ত দত্ত।
সেটা ২০০৮ সাল। কর্মসূত্রে তখন মুম্বইতে রয়েছি। কাজের সুবাদেই এ দিক ও দিক যেতেও হয়। এক দিন বস নিজের চেম্বারে ডেকে পাঠালেন। যেখানে যেতে হবে বললেন, শুনে প্রথমেই যেন একটা ধাক্কা খেলাম! আফগানিস্তান! নিজের ভেতরে ভয় নিয়েই মুম্বই থেকে রওনা দিলাম। দিল্লি হয়ে যাওয়া। রাজধানী শহর থেকে সকাল ৮টার বিমানে চড়ে বসলাম। কিছু ক্ষণ পরেই নীচে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম! হিন্দুকুশ রেঞ্জের উপর দিয়ে চলেছি। কোনও বিশেষণই খুঁজে পাচ্ছি না। হাত নিশপিশ করছে! একটা ছবি তোলার জন্য। কিন্তু বিমানে ওঠার পর থেকেই বার বার বলে দেওয়া হয়েছে, পুরো বিমানসফর তো বটেই, বিমান থেকে নামার পরেও ফোটো তোলা এক্কেবারে নিষিদ্ধ। পুরো পথটাই তাই কাচের জানলার বাইরে চোখ রেখে গেলাম। মনোমুদ্ধকর ছবিগুলো ধরে রাখলাম মন-ক্যামেরায়।
বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করার পর চার জন ষণ্ডামার্কা ‘হ্যান্ডলার’ অর্থাৎ ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে বেরোলাম। কোনও জায়গায় গেলে যাওয়ার আগে আমি সেখানকার স্থানীয় ভাষায় কয়েকটা শব্দ জেনে যাওয়ার চেষ্টা করি। এটা অচেনা ওই জায়গায় কথাবার্তা চালাতে খুব কাজে দেয়। সেই দিয়েই কথা শুরু করলাম। এই আমার প্রথম কোনও বুলেটপ্রুফ গাড়িতে ওঠার পালা। তখনও জানি না ওটা বুলেটপ্রুফ। গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে একটা ক্ষতচিহ্ন দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ওটা কী? জানা গেল, গুলির দাগ! চমকে গেলাম ভেতরে ভেতরে। মুখের উপর সেই চমকানো ব্যাপারটা ফুটে উঠল কি না কে জানে! এক জন নিরাপত্তারক্ষী বললেন, ‘‘ভয় নেই এটা তো বুলেটপ্রুফ গাড়ি।’’
এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর ১০ মিনিটের মধ্যে কাবুল হাইওয়েতে ওঠামাত্র মুগ্ধ হয়ে গেলাম। রাস্তা যেন সোজা বরফঢাকা পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে ছবি তুললাম। ছবিগুলো বাজে আসছিল। কাচ নামিয়ে ছবি নেবো কি না জানতে চাইতে জবাব এল, গাড়িতে থাকলে কাচ নামানোটা এক্সপ্রেসওয়েতে খুব বিপজ্জনক। কারণ, এই রাস্তায় দিনে ২০০ রাউন্ড গুলি চলাটা নাকি খুবই স্বাভাবিক। আমার মনের ভেতরে তত ক্ষণে গুড়গুড় শুরু হয়ে গিয়েছে।
মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করছিলাম। রাস্তার অনেক জায়গায় কোথাও ধারে, কোথাও বা একেবারে মাঝখানে হলুদ মার্ক করা আর ছোট মতো একটা গার্ড দেওয়া। সব গাড়ি ওই জায়গাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করে যা উত্তর পেলাম, তাতে আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল। ওরা বলল যে, ওগুলো ল্যান্ডমাইন কিন্তু তোলা যাবে না। তাই মার্ক করা যাতে সবাই এড়িয়ে চলে। আমার সেলফ মোটিভেশন তত ক্ষণে তলানিতে।
ভয়ের সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শহরে ঢুকে গেলাম। রাস্তার পাশে অনেক জায়গায় অনেকটা করে জায়গা জুড়ে এক একটা বাড়ির ধ্বংসস্তূপ। এগুলো যে ‘এয়ার বম্বিং’-এর চিহ্ন তত ক্ষণে বুঝে গিয়েছি। দেশে আর হয়তো ফিরতে পারব না। এমন ভাবনাও মনে মনে চলছে। অবশেষে হোটেলে এসে পৌঁছলাম। এই এলাকাটা দেখলাম পুরো পুলিশ আর সামরিক বাহিনীতে ভর্তি। হোটেলের কর্মীরাই জানালেন, এখানেই পর পর বিভিন্ন দেশের দূতাবাস। সব বাড়িতেই তাই দোতলা সমান উঁচু পাঁচিলের উপর তার লাগানো। আর চারপাশে সিকিউরিটি ঘেরা অফিসিয়াল বাংলো। ওগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানির বিদেশি কর্মচারীরা থাকেন।
এখানে এসে কোনও বাঙালির দেখা পাব, সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সোমনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি ওই কোম্পানির চিফ টেকনোলজি অফিসার। পরের দিন অফিস, তার আগে সিকিউরিটি অফিসার এসে বুঝিয়ে গেলেন, লিফ্টে নীচে নামার আগে সিকিউরিটি অফিসারকে ফোন করতে হবে। তিনি ‘ওকে’ বললে তখনই নীচে যেতে পারব। কম্পাউন্ড ছেড়ে বেরোনোর কথা ভুলেও মনে আনতে বারণ করলেন। এ ছাড়া রাস্তায় যদি আমার সামনে বম্বিং হয়, তা হলে কাকে ফলো করব, কাকে ফোন করব ইত্যাদি নানাবিধ সতর্কতামূলক বাণী।
শুরু হয়ে গেল কাজ। রোজ সকাল ৭টার মধ্যে রেডি হয়ে থাকতে হত। এর পর এক বা দু’জন করে গ্রুপ করে গাড়ি করে অফিস। বিকেল ৫টার মধ্যে অফিস থেকে বেরিয়ে ফের হোটেল। মাঝেমধ্যেই ভারতীয় দূতাবাস থেকে এসএমএস ঢুকত। কিছুই না, সেখানে লেখা থাকত, ওই রাস্তায় অ্যাটাক হয়েছে। ওই রাস্তা অ্যাভয়েড করো। ওই এলাকায় অ্যাটাকের সম্ভাবনা আছে। ওই এলাকা দিয়ে ফিরো না! ইত্যাদি।
আমার গাড়ির চালক ছিলেন আহমদ। আমার খুব ভাল বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। ও কেমন আছে কে জানে? ওঁর থেকেই শোনা, এখানকার বাসিন্দাদের রোজকার অনিশ্চয়তার কাহিনি… স্কুল কলেজ বছরের বেশির ভাগ সময়েই বন্ধ থাকে। যখন-তখন গুলি বোমা চলছে, কিন্তু সাধারণ নাগরিক কী করবে, কোনও দেশের সাধারণ নাগরিক কবে যুদ্ধ চেয়েছে! তাঁর কথাগুলো যে কতটা সত্যি, তার সাক্ষ্য দিত রাস্তার পাশে বিমান হানায় উড়ে যাওয়া একটার পর একটা বাড়ি। একটা দেওয়ালও দেখিনি যেখানে বুলেটের দাগ নেই! একটা রাস্তা দিয়েও যাইনি যেখানে কোনওদিন গুলি চলেনি। রাস্তায় রোজ দেখতাম, ট্রাফিক পুলিশ ট্যাঙ্কের সারি কন্ট্রোল করছে। কিন্তু কথায় বলে না, যাই হয়ে যাক, জীবন চলতে থাকে। এর পরও হয়তো জীবন চলবে। কিন্তু যা চলে গেল তা কি আর ফিরবে? বিমানের চাকা আঁকড়ে ধরা মানুষগুলো, যে মানুষ দুটো উড়ন্ত বিমান থেকে পড়ে গেল তাঁরা কে ছিল? জানতে ভয় করছে খুব।
প্রায় ৫ মাস এ ভাবেই কেটে গেল। অফিসের যে কাজের জন্যে এসেছিলাম, সেটাও প্রায় শেষের মুখে! কিছু দিন পরেই অফিসিয়াল লঞ্চ সেরে ফিরে যেতে হবে। তার আগে এক দিন একটা দুঃসাহসের কাজ করেই ফেললাম। একা বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের মাথায়, একটা রেস্তরাঁ পেলাম। চুপচাপ ঢুকে পড়লাম। ভেতরে বেশ কিছু লোকজন বসে। সবার চোখ আমার দিকে। থাকব, না বেরিয়ে যাব ভাবছি— কাউন্টারে বসে থাকা বয়স্ক এক জন লোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইন্ডিয়ান?’ হ্যাঁ, বলে বললাম যে, এখানকার খাবার রোজ যেতে যেতে দেখি, খেতে ইচ্ছে করছিল তাই চলে এসেছি। বেশ খুশি হলেন। সঙ্গে অবাকও হলেন! জিজ্ঞাসা করলেন, কী করে এলাম? কেউ তো আসে না ভয়ে! আমাকে বললেন, এ ভাবে আসা ঠিক হয়নি। বিপদ এখানে না বলেই আসে।
খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর টাকা দিতে গেলে কিছুতেই নিলেন না। বললেন, এত বছর হোটেল চালাচ্ছেন কিন্তু আজ অবধি কোনও বিদেশি একা এসে এখানে বসে খাননি। উনি হোটেলের এক কর্মচারীকে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন বাংলোর গেট অবধি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। অবাক হয়ে গেলাম… এ রকম আতিথেয়তাতে অভ্যস্ত নই তো! আর এটাও বুঝলাম, কিছু ভাল মানুষ সব জায়গাতেই আছেন। আর খুব খারাপ পরিস্থিতিতে তারা ভালই থাকেন! ও কি নিজে ভাল আছে? আর যে ছেলেটা নিজের দায়িত্বে আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল?
কখনও ভুলব না ড্রাইভার সাহেব, কুক আর যারা আমায় সুরক্ষিত রেখেছিলেন তাঁদের কথা। ওদের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ফোন করার চেষ্টা করতেও ভয় করছে, না জানি কী খবর পাব। হয়তো ফোনটাই পৌঁছবে না ওঁদের কাছে। হয়তো আর কোনওদিন ওদের খবরই পাব না। অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে। যদি কোনও দিন আবার ওখানে যাই আর সেই দোকানটা যদি থাকে, আর এক বার যাব! ওঁর হাত ধরে বলে আসব, ‘তাশাখুর’! মানে ধন্যবাদ, তত দিন পর্যন্ত ‘তা দিদার বাদ’ অর্থাৎ বিদায়!
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)