সুচরিতা সেন চৌধুরী: তিনি (Sourav Ganguly) বার বার বিতারিত হয়ে আবার ফেরেন, ফেরেন ভারতীয় ক্রিকেটের স্বার্থে। এভাবে যে তাঁকে রোখা যায় না। ক্রিকেটকে নিজের সেরাটা দিয়েছেন শুধু নয়, নিজেকে উজার করে দিয়েছেন। সে তিনি যখন শুধু প্লেয়ার তখনও বা যখন তিনি অধিনায়ক তখনও। আর সদ্য শেষ হওয়া ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব। সেরাটাই দিয়েছেন। সেরাটা বের করে নিয়েছেন অন্যদের থেকেও। তবুও এই মানুষটার বিদায় সুখকর হয়নি কখনও। কখনও সসম্মানে নিজের কেরিয়ার শেষ করতে পারেননি। পিছনে যেন কে বা কাঁরা সব সময় একটা শান দেওয়া ছুঁরি নিয়ে তৈরিই থাকেন। অদ্ভুত এক দুনিয়া। ভারতীয় ক্রিকেটের দুনিয়া। এখন তো আবার শাসন করছে রাজনৈতিক দল। তা বলে দেশের সেরা ক্যাপ্টেন, যে শুধু শুধু মাঠের মধ্যে নয়, মাঠের বাইরেও সেরা —তাঁকে সামান্য সম্মানটা দেওয়া যেত না?
গত কয়েকদিন ধরেই জল্পনাটা চলছিল। বিসিসিআই থেকে বিদায় হতে চলেছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। তাঁর আইসিসি-তে যাওয়ার জল্পনাটাও তখন নতুন করে উসকে উঠেছিল। কিন্তু সেটা যেন শুধুই একটা আইওয়াশ বলে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে। যদি সেটা সত্যি হয় তাহলে হয়তো অনেক খারাপ লাগাকে হজম করা যাবে কিন্তু যদি না হয় তাহলে প্রশ্নটা থাকছেই, কেন সরতে হল সৌরভকে? কেন সরতে হল না জয় শাহকে? কেন রজার বিনি? প্রশ্নের ঝাঁপি খুললে কয়েকশো এমন প্রশ্ন বেরিয়ে আসবে। তার থেকে ফিরে দেখা যাক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে।
ক্রিকেটার সৌরভকে এভাবে ধরা যায় না তবুও—
১৯৯২-এ একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল সৌরভের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। কিন্তু পরের ম্যাচেই তাঁকে বসিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল ঔধত্য। তার পর বেশ কয়েক বছরের বিরতি। এবার ফিরলেন ১৯৯৬-এ, তবে এবার রাজার মতো। তবে প্রথম টেস্টে জায়গা হল না দলে। ভাগ্য হতো একেই বলে। দ্বিতীয় টেস্টের আগে বিতর্কে জরিয়ে সিরিজ ছেড়ে দেশে ফিরে গেলেন নভজ্যোত সিং সিঁধু। সুযোগ এসে গেল সৌরভের। টেস্ট অভিষেক হল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। একই সঙ্গে সেই সময় অভিষেক হয়েছিল রাহুল দ্রাবিড়েরও। অভিষেকেই ছক্কা হাঁকালেন সৌরভ। রান ১৩১। পরের টেস্টে ট্রেন্ট ব্রিজে আবারও সেঞ্চুরি। এবার স্কোর ১৩৬। টেস্ট কেরিয়ারের প্রথম দুই ইনিংসে সেঞ্চুরির কৃতিত্ব খুব কম ক্রিকেটারেরই রয়েছে। সেখান থেকেই তৈরি হল সৌরভ-সচিন জটি। একই বছরে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে একদিনের ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি। রান ১১৩। টানা চারটি ম্যাচের সেরার পুরস্কার এল তাঁর ঝুলিতে। সাহারা কাপে বল হাতেও বাজিমাত করলেন। ১০ ওভার বল করে ১৬ রান দিয়ে তুলে নিলেন পাঁচ উইকেট। একটা খবরে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ইতিহাস ধরা সম্ভব নয়। এটা ছিল শুধু একটা উদাহরণ।
তার পর এলেন চ্যাপেল। জামাই আদর করে তাঁকে নিয়ে এলেন সৌরভই। কিন্তু কী হল? পিছন থেকে ছুঁরিটা মারলেন তিনিও। চূড়ান্ত হেনস্তা হতে হল সৌরভকে। বাদ পড়তে হল। আর তার আগের সময়টা? যখন গোটা ভারতীয় ক্রিকেট ডুবে গিয়েছে গড়াপেটার অতল সমুদ্রে। তখন বোর্ডের মনে পড়েছিল সৌরভকেই। তাঁর ঘাড়ে চাঁপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ধসে পড়া ভারতীয় ক্রিকেট দলকে। আর তার পরটা তো ইতিহাস। একদল আনকোড়া, নতুন ছেলেকে নিয়ে টিম ইন্ডিয়া তৈরি করলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। শেখালেন কী ভাবে চোখে চোখ রেখে প্রতিপক্ষকে পাল্টাটা দিতে হয়। এতদিন তো ভারতীয় ক্রিকেট ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের সামনে ভিজে বেড়াল হয়ে থাকত। তাঁর হাত ধরে ভারত ১৯৮৩-র পর আবার পৌঁছল বিশ্বকাপের ফাইনালে। যেখানে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারতে হল। কিন্তু সৌরভের ব্যাটে এল ৪৬৫ রান, গড় ৫৮.১২ সঙ্গে তিনটি সেঞ্চুরি।
এখানেই শেষ নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে যখন কলকাতা নাইট রাইডার্সের মুখ হয়ে উঠলেন তখন সেটাও পছন্দ হল না কারও কারও। কাউকে ছাপিয়ে সৌরভের আইকন হয়ে ওঠাটা মেনে নিতে পারলেন না। অপমানে নিজের শহরের দল ছাড়তে হল তাঁকে। তাঁর পরও আইপিএল-এ খেলেছেন সৌরভ। দিল্লি দলের মেন্টরের ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। ব্যাট, প্যাড তুলে রেখে যখন ভাবলেন প্রশাসনে আসবেন তখন সেই রাস্তাটাও তৈরি হয়ে গেল। আসলে ক্রিকেট প্রশাসনের সৌরভকে দরকার ছিল। প্রথমে বাংলার ক্রিকেটের মাথায় বসলেন, সেটা ২০১৫ থেকে ২০১৯। এর পর এল বিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্ট পদের আহ্বান। জামাই আদর করে যারা নিয়ে গেলেন সৌরভকে সেখানে আসলে তাদের উদ্দেশ্যটা অন্য ছিল। তারা চেয়েছিল, সৌরভকে সামনে রেখে বাংলাকে জয় করবে। কিন্তু তেমনটা হল না। সৌরভ রাজনীতির মঞ্চকে বার বার এড়িয়ে গেলেন। তাহলে আর কী কাজ তাঁর। বরং বিদায় কর। ২০১৯-এর অক্টোবরে ভারতীয় ক্রিকেটের শীর্ষ আসনে বসেছিলেন তিনি। শুরু হল অন্য এক অধ্যায়ের। ২০১৯-এর নির্বাচনে যেখানে সর্ব সম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন সৌরভ সেখানে তিন বছর পরে সেই লোকগুলোই আর সম্মতি দিলেন না!
বিসিসিআই-এর সভাপতি হয়ে কী করলেন?
ভারতের মাটিতে আয়োজন করলেন দিবা-রাত্রির টেস্ট। যা হল ইডেনে। ভারত-বাংলাদেশ সেই ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল। যে ম্যাচ ঘিরে সমর্থকদের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। ভারত সে ম্যাচ জিতে নেয় সহজেই। এর পর কোভিড পরিস্থিতিতে যখন আইপিএল বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগার তখন সৌরভই উদ্ধার করলেন বিসিসিআইকে বিপুল ক্ষতির হাত থেকে। ২০২০-র আইপিএল পুরোটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে আর ২০২১-এর আইপিএল দেশে শুরু হলেও কোভিড বেড়ে যাওয়ায় তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সে দেশে। ডোমেস্টিক ক্রিকেটারদের স্যালারি বৃদ্ধিও করেন তিনি। জাতীয় সিনিয়র দলের একনায়কতন্ত্রও ভেঙে দেন যা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। রবি শাস্ত্রীকে সরিয়ে রাহুল দ্রাবিড়কে কোচ করেন।
যা খবর সৌরভকে লজেন্স হাতে ধরাতে চেয়েছিলেন নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিরা। তাঁকে আইপিএল চেয়ারম্যানের পদ অফার করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি যে তাতে আগ্রহী নন তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। তিনি আইসিসি চেয়ারম্যান অথবা বিসিসিআই সভাপতির পদ ছাড়া আর কিছুতেই আগ্রহী নন। কিন্তু জানা যাচ্ছে, আইসিসি চেয়ারম্যান পদের দাবিদার হিসেবেও দেখা যাবে না তাঁকে। সেখানেও অন্য নাম নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। তবে ভারতীয় ক্রিকেট মনে রাখবে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা দুষ্টু লোকেদের দুষ্টুমিকে উপেক্ষা করেই। তাঁর নামে জয়ধ্বনী আজও উঠবে। যা সহ্য হবে না অনেকেরই। তাতে বয়েই গিয়েছে সৌরভের। তিনি তো আসল মহারাজ। বার বার ভারতীয় ক্রিকেটকে উদ্ধার করতে তাঁকেই যে লাগে।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google