অমল-পিকে দ্বৈরথ আর ভারতীয় ফুটবলের লাকি থার্টিন, ফিরে দেখা ২২ বছর পর

ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান

অমল-পিকে দ্বৈরথ কোথায় পৌঁছতে পারে সেটা দেখেছিল এই দিনটি। এই প্রজন্মের সেই সময়ের ভারতীয় ফুটবলের সাক্ষী থাকা হয়নি। তাই সেদিন কাছ থেকে দেখার সেই স্মৃতি জাস্ট দুনিয়ার কাছে তুলে ধরলেন কুনাল দাশগুপ্ত

এমন তো নয় সেদিন সাত বা আটের দশকের ফুটবলাররা মাঠে দাঁপিয়ে বেরিয়েছিল। আবীর, শ্যাম, সুভাষ, ভাস্কর, সুব্রত, মনোরঞ্জন, কৃশানুরা ছিলেন না। অবশ্য ছিলেন ভাইচুং, শেষ লঙ্গে চিমা, কেনিয়া থেকে সদ্য আসা ওমেলো, অ্যাজেন্ডারা। এঁদের জন্য তো আর ফুটবল দেখতে যুবভারতী ফুটবলের গঙ্গাসাগর হয়ে ওঠেনি। দু’চারদিন আগেও যাঁরা ভ্রু, নাক কুঁচকে দেশীয় ফুটবলকে কিশোর কুমারের চলতি কা নাম গাড়ি (৪২৯) আর বিদেশী ফুটবলকে ঝকঝকে মার্সিডিজ বেঞ্চ বলে মনে করতেন তাঁরাও চেত্তা দিয়ে পড়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান মাঠ আর আইএফএ-র টিকিট কাউন্টারে। পূর্ব পুরুষদের কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করতে করতে পরি কী মরি করে ছুটেছিলেন যুবভারতীর দিকে।  ১ লাখ ৩১ হাজারের যুবভারতীয় সেদিন বাঙালিয়ানার ধ্বজা উড়িয়ে বলতে পেড়েছিল ওহে মারাদোনা দেখ আমার কাণ্ড কারখানা।

উদ্বেল উন্মাদনা সেদিন গন হিস্টিরিয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল কেন? কারিগর ছিলেন তিনজন। অমল দত্ত, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তদানিন্তন ইএফএ সচিব রঞ্জিৎ গুপ্ত। ঘোর পেশাদারিত্বের যুগে ময়দানের সেই বর্ণময় চরিত্রগুলো অতীতের সাক্ষী হয়ে ইতিহাসের পাতার ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করছেন। আর ময়দান ফ্যাকাশে যন্ত্রের মতো দেখিয়ে চলেছে তার কর্ম ব্যস্ততা। এক্কেবারে নিয়ম করে। আউটপুট ইলেকট্রনিস্ক মাইক্রোস্কোপেও ধরা পড়ে না। হাল ফিলি ময়দান তাই বড়ই উসকো খুসকো।

সেদিনের দুই তারকা, মোহনবাগান কোচ অমল দত্ত (বাঁ দিকে) ও ইস্টবেঙ্গল কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (ডানদিকে)


সলতেটা পাকিয়েছিলেন সেই অমল দত্তই। টিএফএ-র এক ঝাঁক প্রতিভাবাণ তরুণ আর চিমা, সত্যজিৎ অমিত, হেমন্তদের পেয়ে তাঁর গবেশনার খিদেটা উঠেছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আন্তর্জাতিক আঙিনা থেকে ডায়মন্ড সিস্টেমকে প্রতিষ্ঠা করলেন কলকাতার মাঠে। অমলের হিরের ধারে কাটা পড়তে লাগল ফেডকাপে দেশের অন্যতম সেরা ক্লাবগুলো। শুধু মাঠের মধ্যে ট্যাকটিক্যাল ফুটবলেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন না। হিউমারকে পুঁজি করে প্রতিপক্ষ সম্পকের্ তীর্যক মন্তব্যের মাধ্যমে মানসিকভাবে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। ভাইচুংকে চুংচং, ওমেলোকে অমলেট, সোসোকে শসা—ব্যাঙ্গের পসরা সাজিয়ে বসলেন অমল দত্ত।

মন্তব্য উড়ে এল ইস্টবেঙ্গলের তরফেও। প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু জ্বালা তো ছিলই। ১৯৭৭ সালের লিগে অমল দত্তের কাছে ০-২ গোলে হার কিংবা ১৯৭৮-এর ডুরান্ড ফাইনালে ০-৩ গোলে হারের জ্বালা তো ছিলই। অমল দত্তর তীর্যক মন্তব্য বাধ্য করল তাঁকেও মুখ খুলতে। ইস্ট-মোহনের লড়াই বদলে গেল পিকে অমলের দ্বৈরথে। লড়াইয়ে রঙ লাগিয়েছিলেন প্রাক্তনীরাও। ম্যাচ প্রিভিউয়ের জন্য ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে যেতে হয়েছিল। ঝড়ের মতো প্রবেশ করলেন কাঠ বাঙাল পিন্টু চৌধুরী। নিএর মতো করেই বললেন, ‘‘প্রদীপদা সকলরেই কইছি ম্যাচ ডা আমরা জিতুম। আপনার কিছু একটা করতে হৈবো।’’ মুহূর্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে পিকে বলেছিলেন, ‘‘ওরে ডায়মন্ড সিস্‌টেম কারও অজানা নয়। ওটা উনি মঙ্গলগ্রহ থেকে নিয়ে আসেনি।’’

দুই কোচের বাক্যালাপের অন্তাক্ষরী আবার নতুন করে বাঙালির মনে সেই স্বপ্নের সেপারেশন তৈরি করল। আবার সেই বাঙাল ঘটিতে বিভক্ত হল কলকাতা। টিকিটের চাহিদাও ছিল তুঙ্গে। আস্ত একটা সাতের দশককে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ৯০-এ। জন বিস্ফোরণ ঘটতে লাগল প্রতিদিন আইএফএ অফিসে। তখন আইএফএ অফিস আজকের মতো শুধুমাত্র ইট-বালী-সিমেন্টের পারমুটেশন-কম্বিনেশন ছিল না। সারাদিন বিভিন্ন ক্লাবকর্তা, প্রাক্তন ফুটবলাররা আসতেন। বিকেলে আসতেন সাংবাদিকরা। কারও বা দাবি, ‘‘রঞ্জিতদা খবর দিন।’’ আবার কারও দাবি ছিল, ‘‘রঞ্জিতদা টিকিট দিন।’’

ম্যাচের দিন সকালে তো বাড়ি ঘেরাও হওয়ার উপক্রোম। তৎকালীন সচিবের মা সেদিন বাধ্য হয়ে বলেছিলেন, ‘‘ভোলা (রঞ্জি গুপ্তের ডাক নাম) তুই এ বার ফুটবলটা ছেড়ে দে।’’ কিন্তুউ ওই আগুনে ম্যাচও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করেছিলেন। মাঠের ফল যাই  হোক মাঠের বাইরে ফুটবলটাই জিতেছিল। এখন টিফো আসবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝোড়ো হাওয়া উঠবে। কিন্তু বিদেশি কোচেরা মাঠের বাইরের এই খেলাটা দিতে পারবেন না। তার প্রয়োজন বোধহয় হবে না। পরিবর্তনশীল জগতে অনেক কিছুই ভুলে যেতে হয়। বিস্তৃতির অতলে তলিয়ে যাবে সেই ঐতিহাসিক বাকযুদ্ধ। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে লাকি থার্টিন হয়ে বেঁচে থাকবে ১৯৯৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর।

(খেলার আরও খবরের জন্য ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)