আমার মহালয়া থমকে গেছে তিস্তা বাঁধের ও পারে

আমার মহালয়া

‘আমার মহালয়া মানে দোমোহনীর বাড়িতে বেজে ওঠা বাবার কালো রেডিওতে সেই সুর। আমার মহালয়া মানে দোমোহনীর মেঠো পথের সোদা গন্ধ। আমার মহালয়া মানে দারিয়াবান্দা-ফুটবল, নতুন জামা, মাইকে আশা ভোঁসলে। আমার মহালয়া থমকে গিয়েছে তিস্তা বাঁধের ও পারে, হারিয়ে যাওয়া কালো ধুসর রেডিওতে।’ লিখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


উত্তরবঙ্গের গ্রামের বাড়ির সকালটা মাঝে মাঝেই অন্য রকম হত। বিশেষ করে মহালয়ার দিন। মহালয়া শুভ না অশুভ, তা নিয়ে হঠাৎ করেই বছর কয়েক ধরে অনেক আলোচনা হচ্ছে। সবাই জেনে বুঝেই হয়তো করছেন। বাঙালির কাছে মহালয়া মানে কিন্তু সব থেকে বড় উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়া। পুজোর গন্ধে ভরে ওঠা আশপাশ। নতুন জামা, বেড়ানোর প্ল্যান করে টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং, আত্মীস্বজনের যাতায়াত— এগুলো সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাকে সুন্দর করে বৈকি।

মানুষের জীবনধারা বদলেছে অনেক। তবে আজও কিন্তু সকলে সেই ঘুম ঘুম চোখে, বিছানায় হালকা চাদর গায়ে টেনে রেডিওতেই মহালয়া শুনতে ভালবাসে। ইউটিউব খুললে সারা বছরই পাওয়া যায়, কিন্তু ভাললাগাটা এই এক দিনেরই। আমাদের ছোটবেলাতেই মহালয়ার ক্যাসেট বাজারে চলে এসেছিল।

মনে আছে, আমাদের দোমোহনীর বাড়িতে একটা শোওয়া টেপরেকর্ডার ছিল কালো রঙের। আর একটা ফিলিপসের রেডিও। তখনও টিভি আসেনি। আমাদের গ্রামে সেই সময় একমাত্র টিভি ছিল আমার জেঠুর বাড়িতে। তাই খবর থেকে খেলা, গান থেকে মহালয়া— সবই ছিল ওই রেডিওতেই। সে সব আজও কানে বাজে। মোহনবাগানের অন্ধভক্ত বাবা ফুটবল ম্যাচ থাকলে রেডিও চালিয়ে বারান্দায় রেখে দিতেন। রাস্তা দিয়ে লোকজন যেত আর স্কোর জানতে চাইত।

সেই রেডিওই মহালয়ার আগের রাতে ঠিক করে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে রেডি করে রেখে দিতেন বাবা। পরের দিকে দেখেছি, মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে গেলে বাবা চড়চাপাটি মারত, আর রেডিও ফের চলতে শুরু করত। ভোরে উঠে সেই রেডিও চালিয়ে আবার শুয়ে পড়তেন। আমরা আধো ঘুমে শুনতাম সেই মায়া। ছোটবেলায় কী-ই বা বুঝতাম! তবুও ভাল লাগত! সেটা মায়া ছাড়া আর কী!
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই অসাধারণ গলা গমগম করত গ্রাম জুড়ে। সবার বাড়িতে একসঙ্গে বেজে উঠত। শেষ হতেই পাড়ার বড়রা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত। দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের কাজ তখন শেষ পর্যায়ে। সে দিন তো ছুটি। সে দিন ভিখারিকে কেউ ফেরাত না বাড়ি থেকে। কেউ চাল-ডাল, কেউ সব্জি— যা থাকত তাই দিয়েই সাহায্য করত। একটু পুরনো হয়ে যাওয়া জামাকাপড় থাকলেও দিয়ে দেওয়া হত।


দোমোহনী রেল স্টেশন নতুন করে আবার চালু হয়েছে

১৯৭৬ থেকে ১৯৮৯-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত আমরা ছিলাম দোমোহনীর বাবাদের পৈত্রিক বাড়িতে। মানে জন্ম থেকে বুঝতে শেখাটা ওই গ্রামেই। মেঠো পথ ধরে স্কুল, সপ্তাহান্তে বাবার হাত ধরে তিস্তার পাড় বা দু’তিন মাস অন্তর জলপাইগুড়িতে সিনেমা দেখতে যাওয়া, সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খাওয়া আর হাতে সময় থাকলে পিসির বাড়ি ঘুরে আসা। পুজোর আগে অবশ্য পুজোর বাজার করতেও জলপাইগুড়ি যেতেই হত এক বার। রুটিনটা এটাই থাকত। সেটা বেশির ভাগই হত মহালয়ার দিন।

পূজোর বাজার বলতে, আমার আর বোনের একটা করে এক রকমের ফ্রক, মায়ের একটা শাড়ি। বাবা কিছু কিনত কি না এখন আর মনে নেই। পুজোর চার দিন আগের পুজোর জামাগুলোকে মি‌লিয়ে পরতাম। অষ্টমীতে নতুনটা। তাতেই কত আনন্দ ছিল। অনেক পেতে পেতে আনন্দগুলো আর অনুভব করা যায় না। কিন্তু ওই অল্প পাওয়ার আনন্দটা আজ বড্ড মিস করি।

তখন উত্তরবঙ্গের আবহাওয়া এমনই ছিল যে পুজোর আগে থেকেই একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব চলে আসত। সকাল থেকেই গরুরহাটির মাঠে শুরু হয়ে যেত আমাদের দারিয়াবান্দা খেলা। স্কুলের মাঠে চলত ফুটবল। সেই দিন প্রতিযোগিতা হত দলে ভাগ করে। আমি সেরা প্লেয়ার ছিলাম দারিয়াবান্দার। দুই দলে টানাটানি শুরু হয়ে যেত আমাকে নিয়ে। ক্লাবের দাদারা দল তৈরি করে দিত। যে দলে আমি, সেই দল নিশ্চিত চ্যাম্পিয়ন।


তিস্তা ব্রিজ থেকে দেখা যাচ্ছে রেল ব্রিজ

আর যদি মহালয়া বুধ বা রবিবার পড়ে যেত তা হলে তো কথাই নেই। হাট বসত ওই দু’দিন আমার দোমোহনীতে। সেই হাট থেকে কাচের চুরি ছিল আমার মাস্ট। বিভিন্ন রঙের কাচের চুরি হাতে পরে বাড়ি ফিরতাম। সেই চুরি ভেঙে যে কত বার হাত কেটেছে। কখনও হাটে কম দামে জামা পেলেও বাবা কিনে দিত। দুটো জামা হওয়ায় সেই পূজো অন্য মাত্রা পেত।

প্রতি পুজোর আগে নতুন করে আবার শুনতাম ১৯৬৮-র বন্যার গল্প। পুজো এলে সেই আতঙ্ক অনেক দিন পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল বাবাদের মনে। সে বার মহালয়া থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। পাহাড়েও চলছিল প্রচণ্ড বৃষ্টি। লক্ষ্মীপুজোর রাতে হঠাৎই তিস্তার বাঁধ ভেঙে ভেসে যায় দোমোহনী। তার পর টানা এক সপ্তাহের বেশি সময় কী ভাবে জলের মধ্যে বেঁচে ছিল গোটা গ্রাম বা বন্যা কমলে দোমোহনীর বিধ্বস্ত চেহারার গল্প অন্য কোনও দিন বলব যা আমারও শোনা।


তিস্তা বাঁধের উপর থেকে

আজও হয়তো পুজো এলে সেই সময়ের মানুষদের মনে এই আতঙ্ক কাজ করে। প্রতি বর্ষায় তিস্তা ফুলে ফেঁপে উঠত আর দোমোহনী জুড়ে যখন ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি হত, তখন বুঝতাম, আসলে আতঙ্কটা কোথায়। বাবা বলতেন, ‘‘এটা কিছুই নয়। তিস্তার ওই ভয়াল রূপ আর যেন কাউকে দেখতে না হয়।’’

আমার কাছে মহালয়া থমকে গিয়েছে দোমোহনীর সেন চৌধুরী বাড়ির বেড়ার দেওয়ালে, দাড়িয়াবান্দার মাঠে, মেঠো পথে, বাড়ির আমবাগানে, তিস্তার বাঁধে। যেখানে কান পাতলে হয়তো আজও শোনা যাবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর সেই গলা। বেজে উঠবে, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু…’

(ফেলে আসা মুহূর্তকে ফিরে দেখতে ক্লিক করুন এখানে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)