সুচিস্মিতা সেন চৌধুরী
তেরো বছর আগের কথা। সদ্য বাবাকে হারিয়ে মনে হয়েছিল একটা চাকরির খুব দরকার।
আর ঠিক সে সময় খবর পেলাম সিকিম এর একটা কলেজে শিক্ষক নেওয়া হবে সমাজতত্ত্বের। নৃতত্ব পড়ার সুবাদে আবেদন করে দিলাম। এ বার যেতে হবে ইন্টারভিউ দিতে। জানতাম চাকরিটা হবে। কারণ সিকিমের এক ছোট শহর পাকিমে তখন যেতে চাইছেন না কেউ।
বেশির ভাগ বাঙালির পাহাড়ে যাওয়ার কথা শুনলেই মনটা ভাল হয়ে যায়! আমারও হল। কিন্তু একদম অচেনা অজানা জায়গায় একা যাওয়ার কথা শুনে মা ভয় পেলেন, হয়তো আমিও। সত্যি… সঙ্গী পেলাম না তেমন কাউকে। সময়টা জুলাই মাসের শেষ। শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে পৌঁছলাম রানিপুল। এখান থেকে দুটো রাস্তা, একটা চলে গিয়েছে গ্যাংটক আর একটা পাকিয়ং বা পাকিম। রানিপুলে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মেঘলা পাহাড়। বৃষ্টিও পড়ছে। একটা মারুতি ভ্যান রিজার্ভ করতে হল পাকিম যাওয়ার জন্য। পথের দু’ধারে বড় বড় গাছ। খুব একটা গাড়ির চলাচল নেই। ইতিউতি ঝর্নার দেখা। পেরোলাম গা ছমছম করা সেতু আন্ধেরি খোলা। পরে শুনেছি, জায়গাটা ভুতুড়ে, রাতে কেউ ও পথে যায় না। সে দিন পাকিম পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। এক ঘণ্টার পথ, কিন্তু মনে হচ্ছিল কত ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে।
বেতলার অরণ্যে দিন থেকে রাত হল, মনে থেকে গেল বন্যপ্রাণের নিস্তব্ধ চলাচল
রাস্তার ধারেই পাকিম প্যালাটাইন কলেজ, সিঁড়ি নেমে গিয়েছে অধ্যক্ষের ঘরে। দক্ষিণ ভারতীয় অধ্যক্ষ, স্থানীয় কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং বাঙালি সহ-অধ্যক্ষের সামনে ইন্টারভিউ দিতে হল। প্রধান জিজ্ঞাসা একটাই— এখানে থাকা যাবে তো? উত্তরে ‘না’বলিনি। সে রাতে ফেরা হল না শিলিগুড়ি। কোথায় থাকব? জানা গেল, একটি মাত্র হোটেল আছে— সিলভার লজ। সেখানেই রাত্রিযাপন অনেক অনিশ্চয়তা নিয়ে। রাতে হোটেলের জানলা থেকে দেখলাম পাহাড়ের গায়ে তারাদের জ্বলে ওঠা। দূরের গ্যাংটক শহরের আলোর রোশনাই। আর নীচের ছোট ছোট গ্রামের আলো। মন খারাপ-ভাল মেশানো অদ্ভুত এক অনুভূতি। কখন যে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে, কখন যে মনের কোনায় উঁকি দিয়েছে বাবার স্মৃতি— বলতে পারব না। জায়গাটা ভাল লেগে গেল। পরের দিন ফিরলাম, কথা দিয়ে যে, আবার আসব বাক্স গুছিয়ে।
পরের মাসে যোগ দিলাম কলেজে। একটা বাড়ির চিলেকোঠার ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। ছাদের এক কোণ দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথা উঁকি দিত পরিষ্কার আবহাওয়ায়। একটা গ্যাসের ব্যবস্থা হয়েছিল। সপ্তাহে এক দিন মাছ বা মাংস, তা ছাড়া বেশির ভাগ দিনই ডাল, তরকারি, ডিম আর পাঁপড় দিয়ে চলে যেত। মাঝে মাঝে বাড়িওয়ালি দিদি রান্না করে দিত তিলের সব্জি। বেশ খেতে, কিন্তু খুব ঝাল। টিফিনে স্থানীয় দোকানের মোমো, ম্যাগি বেশ চলত। ধীরে ধীরে পাড়ার সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বড় থেকে ছোট— সবাই মিস বলত। বাড়ির ছোট্ট মেয়ে অণ্বেষা ঘরে এসে বিস্কুট খেয়ে যেত। রাস্তা দিয়ে নেপালি ভাষায় গান করতে করতে যেত ময়লাচাচা।
ছুটি থাকলে মন খারাপ হত। ভাবতাম কী ভাবে সময় কাটবে। এক এক দিন আমার বন্ধু কিরণের সঙ্গে চলে যেতাম গ্যাংটক। সারা দিন ঘুরে খেয়ে ফেরা। আবার কোনও সময় ওর বাড়িতেই থেকে যেতাম রাতে। ওরা সবাই মিলে মোমো বানাতো। সে এক জমজমাট ব্যাপার।
ওই স্বাদ আর খুঁজে পাই না। রবিবার দু’তিন জন শিক্ষক মিলে হাঁটতে যেতাম। কখনও কার্তকে আবার কখনও গানজং গুমফায়। ডিকলিং-এ তো একটা ছোটখাটো সার্ভে করে ফেললাম স্থানীয় মানুষদের নিয়ে। এক বার খুব বৃষ্টি হল। ধস নামল বাড়ির সামনে। রাস্তা বন্ধ ছিল। কিন্তু তাতে কী? আমার কর্মক্ষেত্র তো পাশের বাড়ি।
পাহাড়ের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকতো মেঘ। শীতকালটা আবার খুব কষ্টের। কেউ থাকত না। সবাই শিলিগুড়ি চলে আসত ঠান্ডার জন্য। কলেজ ছুটি থাকত ২ মাস। কিন্তু এক বার পরীক্ষার জন্য যেতে হয়েছিল। দু’দিন থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। গরমকাল বেশ মনোরম। মা আর দিদি যখন যেত দারুণ কাটতো সময়। মায়ের হাতের রান্নাও খাওয়া যেত।
দেখতে দেখতে ১০ মাস কেটে গেল। অনেক বার ভেবেও বাড়িবদল করতে পারিনি। আমাদের এক শিক্ষক বলতেন তোমার ঘরটা ঠিক যেন পাখির বাসা। সে বাসা ছেড়ে যখন বেরোলাম তখন পাকিয়ং আর অচেনা নেই। সবাই আমার খুব কাছের মানুষ। সে সময় ফেলোশিপ না পেলে হয়তো আজও থেকে যেতাম পাকিয়ং-এ। আর সাক্ষী থাকতাম নতুন এয়ারপোর্ট উদ্বোধনের।
হঠাৎ সেই অচেনা-অজানা সিকিমের গ্ৰামকে নিয়ে হইচই ফিরিয়ে দিল ফেলে আসা দিনগুলোতে। যখন কেউ এই জায়গাটার নামই শোনেনি। একটা শান্ত পাহাড়ি গঞ্জ। এখন হয়ত শহর হবে আমার পাকিম। আমার স্মৃতিতে কিন্তু শুধুই ভালবাসার সেই পাহাড়।