অবসরে যুবরাজ সিং, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন ছয় ছক্কার মালিক

অবসরে যুবরাজ সিং

সুচি সেন: অবসরে যুবরাজ সিং । ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডায় দিল্লির এক পাঁচতারা হোটেলের লবিতে চুপটি করে বসেছিল ছেলেটি। সঙ্গে বাবা-মা। হাতে রাংতায় মোরা একটা প্যাকেট। অনেকক্ষণ ধরে উসখুশ করছে দেখে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম কার জন্য অপেক্ষা করছেন তাঁরা। আসলে তার পিছনে কারন রয়েছে। সেই হোটেলের লবি জুড়ে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন সৌরভ, সচিন, নেহরা, হরভজন,মুরলীধরন, চামিন্ডা ভাসের মতো তারকা ক্রিকেটাররা। তাঁদের কারও দিকে একবারও তাকাচ্ছে না ছেলেটি। সামনে দিয়ে চলে গেলেও মাথা নামিয়ে নিচ্ছে। বেশ অবাক কাণ্ড, এই বয়সের ছেলে যে ক্রিকেট পাগল হবে সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু ক্রিকেটারদের দেখে কোনও আদিখ্যেতা নেই।

সেটা ২০০৫ সাল। তখনও ক্রিকেট আমার বেশ পছন্দের খেলা। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পাগল ফ্যানও ছিলাম। তার পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমারও অনেকটাই বদল হয়েছে। ক্রিকেট থেকে ফুটবলে চলে গিয়েছি। ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কভার করার ওই একটাই অভিজ্ঞতা। তখনই বুঝেছিলাম যুব সমাজের উপর যুবরাজ সিংয়ের প্রভাব কতটা।

পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে তখন ভারত সফরে শ্রীলঙ্কা দল। দিল্লিতে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেছে ভারত। সেরকমই একটা দিন খেলার শেষে টিম হোটেলের লবিতে দেখা সেই ছেলের সঙ্গে। জানা গেল সে যুবরাজ সিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। তাঁকে জন্মদিনের উপহার দেওয়ার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর নেমে এলেন যুবি। পৌঁছে গেলেন সেই ছেলেটির কাছে। তার সঙ্গে কথা বললেন, ছবি তুললেন, অটোগ্রাফ দিলেন। সেই ছেলে খুশি খুশি ফিরে গেলেন বাড়িতে। হাসতে হাসতে যুবরাজকে সেদিন বলেছিলাম, ‘‘চারদিকে প্রচুর ফ্যান। এই ছেলে কাউকেই আর দেখছিল না এতটাই যুবরাজভক্ত সে।’’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে, কলারটা একটু তুলে, হাতটা আকাশের দিকে তুলে যুবরাজ বলেছিলেন, ‘‘বহত হ্যায়।’’

হাত মিলিয়ে ভিরে মিলিয়ে গিয়েছিলেন। যুবরাজ সিংকে ঘিরে আমার এটুকুই অভিজ্ঞতা। পরদিন যখন মাঠে দেখা হল, হাত দেখিয়ে উঠে পড়েছিলেন টিম বাসে। সেই দিনই ভারত হেরে যাওয়ায় আমিও কলকাতার ট্রেন ধরেছিলাম। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। আমিও ক্রিকেট সাংবাদিকতাকে বিদায় জানিয়েছিলাম।

সেই যুবরাজ সিং আজ অবসর ঘোষণা করে দিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে। ভারতীয় ক্রিকেটের একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল সোমবার। ছয় ছক্কার মালিক খুলে রাখলেন দেশের জার্সি। সাংবাদিক সম্মেলন করে যুবরাজ সিং তাঁর অবসরের কথা ঘোষণা করেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘’২৫ বছর পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সরে দাঁড়ানোর। ক্রিকেট আমাকে সব কিছু দিয়েছে। আর এটাই কারন আমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি।’’

২০০০-এর অক্টোবরে নাইরোবিতে আইসিসি নক-আউট ট্রফি দিয়ে ওডিআই অভিষেক হয়েছিল যুবরাজ সিংয়ের। টেস্ট অভিষেক ২০০৩-এ মোহালিতে। টি২০ অভিষেক হয় ২০০৭-এর বিশ্বকাপে। যেখান থেকে টি২০-র বিশেষজ্ঞ প্লেয়ার হয়ে উঠেছিলেন তিনি। খেলেছেন ৪০০-র উপর ম্যাচ। ১৯ বছরের ভারতীয় ক্রিকেটে শেষ হল যুবি যুগ। খেলেছেন ৪০টি টেস্ট। করেছেন ১৯০০ রান। তার মধ্যে রয়েছে তিনটি সেঞ্চুরি ও ১১টি হাফ সেঞ্চুরি, গড় ৩৩.৯২। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৬৯ রানই সর্বোচ্চ তাঁর।

৩০৪টি ওডিআই খেলেছেন তিনি। করেছেন ৮৭০১ রান। তার মধ্যে রয়েছে ১৪টি সেঞ্চুরি, ৪২টি হাফ সেঞ্চুরিই। সর্বোচ্চ রান ১৫০ যা করেছিলন ২০১৭তে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সেই বছরই জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন। আর ফেরা হয়নি। তবে একটা আশা ছিল এত বছর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

বিশ্ব ক্রিকেটে যুবরাজের ব্যাট থেকে যে রেকর্ড হয়েছিল তা আজও ফেরে সবার মুখে মুখে। তাঁর নামের পাশেও লেগে গিয়েছিল ছয় ছক্কার যুবরাজ। ২০০৭ বিশ্বকাপে কিংসমেডে স্টুয়ার্ট ব্রডকে এক ওভারে ছয় ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেটের হার্ডহিটার, স্টাইলম্যান, দারুন ফিল্ডার যুবরাজ সিংকে বিদায়।

শেষ বেলায় তিনি বলেন, ‘‘আমি খুব ভাগ্যবাণ দেশের হয়ে ৪০০ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছি। যখন শুরু করেছিলাম তখন এতটা ভাবিনি।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘এই খেলার সঙ্গে আমার লাভ-হেট সম্পর্ক। আমি সত্যিই ব্যাখ্যা করতে পারব না এটা আমার জন্য কী। এই খেলা আমাকে লড়াই করতে শিখিয়েছে। আমি অনেকবার অকৃতকার্য হয়েছিল আবার ফিরে এসেছি। এবং আমি কখনও হাল ছেড়ে দিইনি।’’

ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। ক্রিকেটের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাক্তি জীবনেও তিনি অনেক মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা তিনি। হয়তো আজও কোনও হোটেলের লবিতে, কোনও বিমান বন্দরের লাউঞ্জে, তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তায় অপেক্ষা করে কোনও যুবরাজভক্ত, করবে সারা জীবন।

(ফিরে দেখার আরও খবরের জন্য ক্লিক করুন এই লিঙ্কে)